রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫

তৃণমূলের ‘আদবানি’ হতে নারাজ মমতা

শেষ আপডেট:

রন্তিদেব সেনগুপ্ত

শোনা যাচ্ছে, তৃণমূল কংগ্রেসের যেসব নেতা-কর্মী এক মাস আগেও ক্যামাক স্ট্রিটে নিত্য যাতায়াত করতেন, তাঁরা এখন আর ও পথ মাড়াচ্ছেন না। তাঁরা এখন যাচ্ছেন বাইপাসের তৃণমূল অফিসে। সপ্তাহে অন্তত দু’দিন তৃণমূল অফিসে যাতায়াত করেন, সেরকম একজন বললেন, ‘এখন তৃণমূল অফিসে সুব্রত বক্সীকে ঘিরে ভিড়। বক্সীদাও আবার প্রবল উৎসাহে কাজ করছেন।’

এই সুব্রতই বছরখানেক আগে দলের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেবেন ভেবেছিলেন। দলের অনেকেই বলেন, ক্ষোভ এবং অভিমান থেকেই তিনি এরকম ভেবেছিলেন। ক্যামাক স্ট্রিটের ভিড়টা তিলজলায় পার্টি অফিসে চলে আসায় বক্সীর সেই ক্ষোভ-অভিমান কমেছে, সেটা আশা করাই যায়। সপ্তাহে দু’দিন ক্যামাক স্ট্রিটে যাতায়াত করা ব্যক্তিটি রসিকতা করে বলছিলেন, ‘সব পথ এসে মিলে গেল শেষে…’

ইতিমধ্যে তৃণমূল সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি টিভি চ্যানেলে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেই সাক্ষাৎকারে আকারে ইঙ্গিতে অনেক কথাই বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। যাঁরা বোঝার, তাঁরা সভানেত্রীর বলা কথাগুলির নিগূঢ় অর্থ বুঝে গিয়েছেন। তারও আগে দলের জেলা সভাপতি, বিধায়ক, সাংসদদের সঙ্গে বৈঠকে নেত্রী বলেছেন, ‘কেউ যদি প্যাঁক প্যাঁক করে কিছু বলতে আসে আপনারা শুনবেন না। দরকার হলে তাদের ফোনই ধরবেন না।’

নেত্রীর এহেন উক্তি যে দলের সমীক্ষার কাজে নিয়োজিত সংস্থাটিকে উদ্দেশ্য করে, এ বুঝতে কারও বাকি থাকেনি। এই সংস্থাটিকে কে সমীক্ষার কাজে নিয়োগ করেছিলেন তা প্রত্যেকেই জানেন। এই সংস্থাটির কাজকর্ম নিয়ে বেশ অনেকদিন ধরেই জেলার নেতারা, এমনকি রাজ্যের প্রবীণ অভিজ্ঞ নেতারাও নেত্রীর কাছে অসন্তোষ প্রকাশ করছিলেন। নেত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন এই ‘প্যাঁক প্যাঁক’ করা সংস্থাটিকে তিনি অনুমোদন করছেন না।

এই রকম একটি পরিপ্রেক্ষিতে নেত্রীর নির্দেশেই জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে দলের বিশেষ অধিবেশনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে তৃণমূল। এই অধিবেশনে কারা প্রতিনিধি হিসেবে থাকবেন, তা বাছাই করে দেবেন নেত্রী স্বয়ং। দীর্ঘদিনের ‘কমরেড ইন আর্মস’ সেই সুব্রত বক্সীকেই এই সম্মেলন আয়োজন করার দায়িত্ব দিয়েছেন নেত্রী।

তৃণমূলের অন্দরের খবর, এই সম্মেলন থেকেই নেত্রী দলীয় সংগঠনে বেশ কিছু রদবদল করবেন। তাঁর একান্ত আস্থাভাজনদের দায়িত্ব অনেক বাড়াবেন তিনি। প্রবীণদের সরিয়ে সর্বস্তরে নবীনদের আনার যে আওয়াজ দলের ভিতর কেউ কেউ তুলেছিলেন, সেই প্রস্তাব নেত্রী ইতিমধ্যেই খারিজ করে দিয়েছেন। পরিষ্কার জানিয়েছেন, প্রবীণদের সরিয়ে নয়, প্রবীণের সঙ্গে নবীনের সংমিশ্রণ চান তিনি। ফলে, সৌগত রায়ের মতো প্রবীণরা যাঁরা ভেবেছিলেন, ‘তৃণমূলে নতুন দিন আসছে। অতএব মুখটা কালীঘাট থেকে একটু অন্যদিকে ঘোরানো যাক’, তাঁরা এবার পড়বেন সমূহ বিপদে।

এইসব ঘটনাপ্রবাহ থেকে কী বোঝা যাচ্ছে? একটি বিষয়ই পরিষ্কার। তা হল, মমতা ২৬-এর নির্বাচনের আগে দলের রাশ সম্পূর্ণ নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান। যাতে ’২৬ -এর নির্বাচনের পরেও তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে দলে কোথাও কোনওরকম প্রশ্ন না ওঠে। তিনি যে তৃণমূলের ‘আদবানি’ হতে চান না, দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে মমতা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। দলের ভিতর কোনও বিকল্প নেতৃত্ব তৈরির প্রচেষ্টা তিনি মানছেন না। জানুয়ারি মাসে দলের বিশেষ সম্মেলনে মমতা এই বার্তা আরও পরিষ্কার করবেন, এখন থেকেই আঁচ করা যাচ্ছে।

এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, দলের ভিতর একটি বিকল্প নেতৃত্ব তুলে ধরার চেষ্টা গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি সেই প্রচেষ্টাটিতে আরও জোরদার মাত্রা দেওয়া হয়েছিল। দলনেত্রী যে সেটি বুঝতে পারছিলেন না এমনও নয়। তাঁর ঘনিষ্ঠ কাউকে কাউকে তিনি বলেছিলেন, সবকিছু তিনি নজরে রাখছেন। সময়মতো ব্যবস্থা তিনি নিয়ে নেবেন। আরজি কর আন্দোলনে বিকল্পপন্থী নেতাদের একাংশ যে আড়াল থেকে মদত দিয়ে প্রশাসনকে অস্বস্তিতে ফেলতে চেয়েছে, এটা বুঝে মমতা আর দেরি করতে চাননি। আর দেরি করলে তাঁর হাত থেকে যে দলের রাশ সম্পূর্ণ বেরিয়ে যাবে এবং বেরিয়ে গেলে নির্বাচনে দলকে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে, পোড়খাওয়া নেত্রীর সেটি বুঝতেও দেরি হয়নি। ফলে, দ্রুত দলে বিকল্পপন্থীদের ছেঁটে দিয়ে নিজের মতো করে সংগঠনকে সাজিয়ে ’২৬-এর প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন।

মমতার এই পদক্ষেপে সন্তুষ্ট কারা? অবশ্যই তাঁর পুরোনো এবং বিশ্বস্ত সঙ্গীরা। দলে বিকল্প নেতৃত্বের উত্থান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই পুরোনো সঙ্গীরা নিজেদের অবহেলিত মনে করছিলেন। অনেকের ভিতরই ক্ষোভ সঞ্চারিত হচ্ছিল। মমতার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলিতে তাঁরা উৎসাহিত হয়েছেন। দলে বিকল্প নেতৃত্বের উত্থান ঠেকাতে তাঁরাও এবার মমতার হাত শক্ত করবেন। ছাব্বিশের ঘুঁটি সাজাতে যা মমতার পক্ষে সহায়ক হবে।

তাহলে বিকল্পপন্থীরা কী করবেন? তাঁরা অন্তত বুঝে গিয়েছেন, মমতাকে আগামীদিনে মার্গদর্শক সাজিয়ে রেখে প্রশাসন এবং দলের দখলদারিত্ব নেওয়ার চেষ্টা সহজ হবে না। বিশেষ করে যেভাবে বাইপাসের তৃণমূল অফিসে ভিড় বেড়েছে, ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন সুব্রত বক্সী, ফিরহাদ হাকিম, অরূপ বিশ্বাসরা, তারপর এখন নিতান্ত মূর্খ না হলে কেউ শান্তনু , সুখেন্দুশেখর, সৌগত বা হুমায়ুন কবির সাজতে যাবেন না। এটা বিকল্পপন্থীরা বুঝতে পেরেছেন। আসলে, সব পথ এসে মিলে গেল শেষে…।

শেষকথাটি হল আনুগত্য। ছাব্বিশের আগে তাঁর প্রতি অনুগত থাকতে হবে- এই বার্তাটা দলের সর্বস্তরে দিয়ে দিয়েছেন মমতা।

Categories
Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

লাঠিচার্জের আগে ভাবুন, কার পাপে তালা ভাঙেন শিক্ষকরা

গৌতম সরকার অন্যায়, অপদার্থতা, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা... কোনও শব্দই যেন যথেষ্ট...

পাকিস্তানের স্বর্ণভূমিই মৃত্যু-বিপ্লবের অন্য নাম

রূপায়ণ ভট্টাচার্য একটার পর একটা নোংরা মর্গ ঘুরে সেই বালোচ...

ঘনাদার সঙ্গে পাল্লা দিলেন ব্রজদা

আশিস ঘোষ শুধু মিসাইল, ড্রোনের হিসেবই নয়, একটা যুদ্ধ আমাদের...

সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব জনতা, নেতাদেরও 

দীপককুমার রায় উত্তরবঙ্গ ভারতবর্ষের ক্ষুদ্র সংস্করণ। বিভিন্ন জাতি, জনজাতির মানুষ...