আলপনা ঘোষ
নির্বাসিত বাংলাদেশি কবি, বন্ধু দাউদ হায়দারের বার্লিনে প্রয়াণের খবর শুনে মনে পড়ে গেল তাঁর ‘তোমার কথা’ কবিতার সেই স্মরণীয় লাইনগুলো।
‘মাঝে মাঝে মনে হয়/ অসীম শূন্যের ভেতর উড়ে যাই।/ মেঘের মতন ভেসে ভেসে, একবার/ বাংলাদেশ ঘুরে আসি/ মনে হয়, মনুমেন্টের চূড়ায় উঠে/ চিৎকার ক’রে বলি;/ আকাশ ফাটিয়ে বলি-/ দ্যাখো সীমান্তে ওই পাশে আমার ঘর/এইখানে আমি একা, ভিনদেশি’।
১৯৮৩ সালে রচিত ‘তোমার কথা’ কবিতায় মাতৃভূমির জন্য নির্বাসিত কবি দাউদের যে যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে, সেই বেদনার অন্ত ঘটল অবশেষে স্বজনহীন ভিনদেশের মাটিতে।
পাঁচ দশকেরও বেশি সময় আগে দাউদ সেই যে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, আর কোনও দিন ফিরে যাননি ভূমি মায়ের কোলে। শুধু মাত্র একটি কবিতা লেখার অপরাধে বিতাড়িত হয়েছিলেন তিনি স্বভূমি থেকে। সেটা ১৯৭৪ সাল। আমৃত্যু নির্বাসনে কাটিয়েছেন। যতদিন কিংবদন্তি সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় জীবিত ছিলেন, কলকাতায় এলে তাঁর জন্য অবারিতদ্বার ছিল কবির আলয়ে। পুত্র জ্ঞানে স্নেহ করতেন তিনি এই নির্বাসিত তরুণ কবিকে।
১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের নির্দেশে দাউদকে তুলে দেওয়া হয়েছিল একটি কলকাতাগামী উড়োজাহাজে। কবির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল মুজিব সরকার। ১৯৭৬ সালে দাউদ পাসপোর্ট নবীকরণের জন্য কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে জমা দিলে এরশাদ সরকার পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পাসপোর্ট ছাড়া কোনও দেশই দাউদকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে।
কবির এই দুঃসময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন নোবেল বিজয়ী জার্মান কবি গুন্টার গ্রাস। তিনি জার্মান সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে নির্বাসিত কবির রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেন। রাষ্ট্রসংঘের অনুমতিপত্রই হল তখন কবির দেশান্তরে ঢোকার ছাড়পত্র। জার্মানি যাওয়ার পর থেকে বেশ কিছুদিন তিনি রেডিও চ্যানেল ‘ডয়েচে ভেলে’র একজন প্রভাবশালী সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন।
দাউদের সঙ্গে আমার পরিচয় আমার সাংবাদিক স্বামী শংকর ঘোষের সুবাদে। শংকর তখন যে কাগজের সম্পাদক, সেখানে দাউদ বার্লিন থেকে প্রায়শই লিখতেন। কলকাতায় এলে বাঁধাধরা ছিল আমাদের বাড়িতে আসা। ভারী স্নেহ করতেন শংকর অনুজ এই প্রবাসী কবিকে। কত গল্প, কত কবিতা পাঠ হত সে সব দিনে।
২০০৯ সালে যেদিন শংকর চলে গেলেন চিরতরে, পরের দিন বিকেলে দাউদ এসে হাজির আমাদের বাড়িতে। সে দিন সকালেই বার্লিন থেকে কলকাতায় ফিরেছেন। খবরের কাগজেই পেয়েছিলেন দুঃসংবাদ। তাই এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। শংকরের কথা বলতে গিয়ে দেখি ওঁর চোখ ভর্তি জল।
দাউদ দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতার সম্পাদক ছিলেন সত্তর দশকের শুরুতে। ১৯৭৩ সালে লন্ডন সোসাইটি ফর পোয়েট্রি দাউদ হায়দারের একটি কবিতাকে ‘বেস্ট পোয়েম অফ এশিয়া’ স্বীকৃতি দিয়েছিল।
জার্মানিতে কী নেই? সব ছিল। শুধু ছিল না দাউদের ইছামতী নদী। দেশে ফেরার জন্য শিশুর মতো চোখের জল ফেলেছেন তিনি সকলের অন্তরালে। আজ সে সবের অবসান ঘটল। যেখানেই থাকুন, শান্তিতে থাকুন কবি দাউদ হায়দার।
(লেখক সাংবাদিক)