রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

গুমরে মরছে দিনাজপুর ও মালদা

শেষ আপডেট:

অভিজিৎ সরকার

উত্তরবঙ্গের নাম উচ্চারিত হওয়ামাত্রই পর্যটন প্রসঙ্গটি অনিবার্যভাবে আমাদের মনে চলে আসে। প্রকৃত অর্থেই উত্তরবঙ্গে পর্যটনশিল্পে রয়েছে বিস্তর সম্ভাবনা। গঙ্গা নদীর ওপার অর্থাৎ দক্ষিণবঙ্গের বেশিরভাগ মানুষই উত্তরবঙ্গ বলতেই বোঝেন ভ্রমণের জন্য এক উল্লেখযোগ্য ডেস্টিনেশন। আর উত্তরবঙ্গ বলতেই বোঝেন পাহাড়বেষ্টিত দার্জিলিং বা ঘন জঙ্গলে মোড়া ডুয়ার্স অথবা কোচবিহার রাজবাড়ি। এই ভাবনাতেই তৈরি হয়েছে যত সব সমস্যা।

শুধুমাত্র অন্য রাজ্যে নয়, আমাদের রাজ্যের অন্য প্রান্তেও কখনও নিজ জেলার নাম দক্ষিণ দিনাজপুর বললে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায় শ্রোতা বা প্রশ্নকর্তাকে। তখন বোঝাতে হয় আমি উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা আর এই উত্তরবঙ্গ মানেই সর্বত্র পাহাড়-পর্বত, জঙ্গলে মোড়া নয়। তবে হ্যাঁ, এ সবের বাইরেও রয়েছে অনেক ভ্রমণের স্থল যা পর্যটনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হতে পারে। তবে প্রশ্ন, ‘হয়নি কেন’? কেন-‘হতে পারে’ শব্দটি বলতে হচ্ছে? যাঁরা উত্তরবঙ্গ বলতে শুধুমাত্র দার্জিলিং, ডুয়ার্স, কোচবিহারকে বোঝেন এ ক্ষেত্রে তাঁদের কী ত্রুটি? আসলে ত্রুটি পর্যটকদের নয়, ত্রুটি তাঁদের যাঁরা রয়েছেন এগুলোর দায়িত্বে। বিভাগীয় মন্ত্রী, কর্তা, আধিকারিক, নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রতিনিধিদেরই ত্রুটির দায় নিতে হবে।

পর্যটন ব্যবসায়ীদের মধ্যেও মালদা বা দুই দিনাজপুর নিয়ে বড় কিছু পরিকল্পনার কথা শোনা যায় না। তাদের যা উদ্যোগ সেগুলো মূলত পাহাড় ও ডুয়ার্সকেন্দ্রিক। এর বড় কারণ হয়তো, যেভাবে পাহাড়ের ওপর কংক্রিটের নির্মাণ ও জঙ্গল কেটে রিসর্ট তৈরি করে তাঁরা লাভবান হবেন সেভাবে গৌড়বঙ্গের তিন জেলা থেকে খুব একটা অর্থসমাগম হবে না।

যাই হোক যেভাবে উত্তরবঙ্গের আর পাঁচটি জেলাকে পর্যটন মানচিত্রে তোলা গিয়েছে, সমগুরুত্ব দিয়ে প্রচেষ্টা করলে বাকি পাঁচ ভাইবোনের মতো মালদা, উত্তর দিনাজপুর ও দক্ষিণ দিনাজপুরকেও পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় ভ্রমণের গন্তব্যস্থল করে তোলা যেত। এমন তো নয় যে পর্যটকরা শুধুমাত্র পাহাড় ও জঙ্গল বেষ্টিত স্থানেই ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যান। রুক্ষ মরুভূমি বা সমতলেও পর্যটক যান যদি সেই জায়গা সম্বন্ধে উপযুক্ত তথ্যাদি প্রদানের দ্বারা পর্যটকগণকে আকৃষ্ট ও আগ্রহী করে তোলা যায়। এর জন্য অবশ্যই দরকার প্রচার ও প্রসার। আর এই প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমেই যখন জায়গাটির মাহাত্ম্য অর্থাৎ গুরুত্ব তুলে ধরা সম্ভব।

দক্ষিণ দিনাজপুরের কথাই ধরা যাক। এক বাণগড় ছাড়া এই জেলার বাইরের কোনও ব্যক্তি আর অন্য কোনও ভ্রমণ স্থানের নাম বলতে পারবে বলে মনে হয় না। কিন্তু এই দক্ষিণ দিনাজপুরে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক স্থান যা আমাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে। কিন্তু তার বিন্দুমাত্র চেষ্টা নেই। অনেকেই আক্ষেপ করে বলেন প্রান্তিক জেলা বলেই এই অবস্থা। সেটা ভুল নয়।

দক্ষিণ দিনাজপুরের ঐতিহাসিক বিশেষত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির সর্বাধিক অংশ রয়েছে গঙ্গারামপুরে। তারপরেও এখনও অবধি বাণগড়কে কেন্দ্র করে তৈরি হল না কোনও সংগ্রহশালা। সেটা হলে বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত মূর্তি সহ প্রত্নতাত্ত্বিক ভগ্নাবশেষগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা যেত আরও ভালোভাবে। একটি সংগ্রহশালা পর্যটনের জন্য অনেক সম্ভাবনা তৈরি করে। বহু পর্যটনস্থলে আমরা শুধুমাত্র সংগ্রহশালা দেখতেই ভিড় করি। এছাড়াও রয়েছে পঞ্চরথ মন্দির, বিরূপাক্ষ বাণেশ্বর মন্দির, আতাশাহের দরগা, কালদিঘি ও ধলদিঘি প্রভৃতি। এগুলো সব গুরুত্বের বিচারে এক একটি পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারত। মালদা জেলাতেও এরূপ প্রচুর ঐতিহাসিক স্থাপত্য রয়েছে যেগুলো অল্প হলেও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে প্রচারিত হয়েছে এবং পর্যটক যাচ্ছেন। কিন্তু সেদিক থেকে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর একেবারেই পিছিয়ে রয়েছে।

দক্ষিণবঙ্গের কোনও জেলায় একটি ঐতিহাসিক মূর্তি বা ইট পাওয়া গেলেও সেখানে গড়ে ওঠে পর্যটনকেন্দ্র। নেতা, মন্ত্রীরা কে কার আগে সেখানে পৌঁছোবেন তার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। অথচ আজও বাণগড় অসংরক্ষিত (দেখভালের দায়িত্বে কেউ নেই) স্থান হবার কারণে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর পেছনে বড় কারণ হল কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ঠেলাঠেলি। একে অপরকে শুধু দোষারোপ করে দায় সারছে আর ভোটের মুখে নির্বাচনি ললিপপ হিসেবে বাণগড়কে ব্যবহার করছে। বারবার শুনছি বরাদ্দ হচ্ছে। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে কাজ হচ্ছে না এবং খননকার্য শুরু হয়েও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পরিদর্শনের পরেও বাণগড়ের ভাগ্যের শিকে ছেঁড়েনি।

সবমিলিয়ে পর্যটনের প্রসারে ব্রাত্য উত্তরবঙ্গের মধ্যেই কার্যত দুয়োরানির দশা দুই দিনাজপুর এবং মালদা জেলার। সুধীজনেরা এবার এগিয়ে এসে একটু আওয়াজ করুন, যাতে নেতা ও প্রশাসনের বাবুদের কানে সেই শব্দ পৌঁছায়।

Categories
Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

রাজনীতির প্রসাদ পান নেতারা, ভাগ জাতিগোষ্ঠীতে

গৌতম সরকার দিঘায় মন্দির গড়ছে তৃণমূল সরকার। জাতের, ধর্মের লড়াইয়ে...

জমি মানেই খাঁটি সোনা, রামরাজ্যে হরির লুট

 আশিস ঘোষ ‘রাম রাজ বৈঠে ত্রিলোকা/ হর্ষিত ভয়ে...

রিজিওনাল স্কুল সার্ভিস কমিশন ফিরুক

মৈনাক কুন্ডা উন্নয়নের এক অমোঘ প্রশ্ন চিরকালীন। শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ...

আশ্বাস যেন শিক্ষকদের উপহাস না হয়ে ওঠে!

গৌতম সরকার ধম্মে সইবে না। সইছেও না। শিক্ষকের গায়ে হাতে তাই...