- সন্দীপন নন্দী
বাদলদিনের প্রথম প্রণয় ভীতি হোক বা অনভিপ্রেত রূঢ় রৌদ্র, সবার মাঝে এক বিস্ময়কর জীবনসঙ্গীর নাম ছাতা। কালের যাত্রাপথে নাগরিকের মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে হাতে যে হনহন হেঁটে যায়, দীর্ঘ দগ্ধদিনেও যে হয়ে ওঠে পথিকের অনন্য মসিহা। যার সৌজন্যে বৃষ্টিভেজা বিকেলে ঘরে ফেরে নির্জলা দিদিমণি, ধুম জ্বরেও শিশুকে ছাতা মাথায় স্কুল পৌঁছে দেয় গৃহসহায়িকা ‘অখ্যাত’ মা।
আসলে ভগ্ন হোক বা জীর্ণ, এক পিস ছাতা সঙ্গে থাকলেই জলে-স্থলে নির্ভয়ে নিরাপদ গন্তব্যে এগিয়ে গিয়েছে বাঙালি, এ তো নতুন কথা নয়। সে খেলার মাঠ থেকে আত্রেয়ীপাড় বা গজলডোবা হতে তিস্তাবাজার, ভ্রমণপথ- সর্বত্র সচেতন মানবের লটবহরে কীভাবে যেন স্মরণীয় হয়ে ওঠে রংবেরংয়ের সমস্ত ছাতা। তাই ক্রমে দৈনন্দিন মানবজীবনে এক অনিবার্য আশ্রয়ের দ্যোতক হয়ে উঠেছে এই ছাতা। অলক্ষ্যে বিস্তৃতি বেড়েছে তার আর ছাতার ছায়াবীথিতলে দু’দণ্ড শান্তির খোঁজে প্রীতি ও প্রেরণাকে উৎসর্গ করেছে নবীন কিশোর থেকে ওল্ডেজ হোমের সহায়হীন বৃদ্ধা।
তাই যুগে যুগে প্রত্যেকের বীতস্পৃহ জীবনে সদর্থক ভূমিকায় নিয়োজিত হয়েছে ‘সামান্য এক ছাতা’। পিতার মুখাগ্নিরত পুত্রকে বিলাপ করতে শুনি, মাথার ছাতাটা চলে গেল। আবার দুর্দান্ত ভিড় থেকে গৃহহীন দম্পতির আক্ষেপের কথামালা ভেসে আসে, মাথার উপর পাকা ছাতাটা যে কবে হবে? এখানে ছাতাই এক অদৃশ্য ছাদের অযুত সম্ভাবনা ইঙ্গিত করে। একদিন এভাবেই সংবাদ আসে, বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক কর্মীদের বহুদিন পর একই ছাতার তলে আনা সম্ভব হয়েছে। ফলে একদল একছাতা নীতির ভিত্তিতে সকলকে বেঁধে বেঁধে রাখার যে অঙ্গীকার, তাতেও লিপিবদ্ধ রয়ে যায় এক নগণ্য ছাতার ভূমিকা।
ফলে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও বিপুল বিশ্বে ছাতার নামভূমিকা আজও অনস্বীকার্য। তাই বর্ষায় ছাতা আর শীতের কাঁথা, জরুরি প্রয়োজনের প্রবাদ হয়ে লোকমুখে ঘুরে বেড়ায়। সময়ে-অসময়ে বাসে, ট্রেনে আসন সংগ্রহের অন্যতম হাতিয়ারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ওই ছাতা। সহসা দেখে মনে হয়, রক্তিম, নীলাভ কিংবা পীতাভ বর্ণের ছাতাগুলোতেই যেন মিলেমিশে আছে বেঁচে থাকা মানুষের ‘ব্যক্তিত্ব’। তবে সদ্য ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষটির ব্যবহৃত ছাতাও তো ঘরে ঘরে ঝুলে থাকে সে কথাও তো সত্যি। মানুষ নেই তবু তার অস্তিত্বের স্মারক হয়ে ছাতাটা থেকে যায়। হাতলের পরশে, মাথায় মেলে ধরা নিবিড় ছায়াতেই চিরকালের মানুষটি আড়ালে অক্ষত থাকেন। এই সেই ঋতু, এক অঝোরবৃষ্টির কালসূচক আষাঢ়। যখন স্মৃতিরা ছত্রছায়ায় ভিজতে ভিজতে প্রাণ পায়, ব্যবহারের যৌথ উদ্যোগে একটি ছাতা আছে না আছে, তবু মনে রেখোর মতো রয়ে যায় চিরকাল।
আর ছাতা হারাননি জীবনে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেননা পুরাতন প্রেমের মতোই কোনও ব্যবহৃত ছাতার মায়া আজীবন ঘুরঘুর করলে তাকে তো জঞ্জাল স্তূপে নিক্ষেপ করা যায় না, ইচ্ছে করেই হারিয়ে ফেলতে হয়। ফলে হাতবদলে নতুন মানুষের কাছে পুরাতন ছাতাও বেঁচে ওঠে, কথা বলে, ছুটে বেড়ায় নব উন্মাদনায়। দেখতে পাই সম্পর্কে বহু অদ্বিতীয় রোমান্টিক দৃশ্যের জন্ম দিয়ে যায় এই টুকরো কাপড়ের ছাতা। সেই বর্ষার মাহেন্দ্রক্ষণেই খেয়ালবশে ছাতাহীন যুগলরা পথে নামে। হাসমি চক থেকে হাসিমারা, বাবুপাড়া থেকে বানারহাটের মাঠঘাট, সড়কপথ পবিত্র উচ্ছ্বাসে ভিজে যায়। ছাতায় আকাশের জল ঝরে অনিবার, এমনও দিনে তারে ভোলা যায়?