- অশোক ভট্টাচার্য
অপেক্ষার মুহূর্ত
কিছু দেশ কেবল মানচিত্রে স্থির থাকে না, মনে দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়। শ্রীলঙ্কা তেমনই এক অপেক্ষার নাম। কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে ২০২২ সালে সেই প্রবল জনজাগরণের খবর শুনে এই দ্বীপরাষ্ট্রের মাটি ছুঁয়ে দেখার বাসনা ছিল। অবশেষে গত ১৩ সেপ্টেম্বর কলম্বোর উপকূলে পৌঁছে মনে হল, ইতিহাস পুরোনো হিসেব চুকিয়ে এক নতুন গণিতের দিকে হাত বাড়িয়েছে।
আমার ৮ দিনের শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ শুরু হয় কলম্বোর সেই বিখ্যাত গলফেস গ্রিনে। ভারত মহাসাগরের তীরে বিস্তৃত সেই ভূমিখণ্ড, যেখানে ঢেউয়ের গর্জন আর জনগণের সম্মিলিত স্লোগান এক হয়ে গিয়েছিল সেসময়। স্থানটি কেবল সৈকত নয়, সেই ‘আরাগালায়া’র (জনতার সংগ্রাম) জন্মভূমি, যেখানে এক জীর্ণ শাসনের পতন ঘটিয়েছিল। গলফেস গ্রিনের বিশালতা তার রাজনৈতিক তাৎপর্যের কাছে ম্লান। কারণ, এখানে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিদ্রোহের প্রথম বীজ বুনেছিল। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর ২০২৪ সালে প্রথম যে পরিবর্তন হল, তা শুধু শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন নয়, বলা যায় সিস্টেমেটিক পরিবর্তন। অথচ কোনও বিপ্লবী পরিবর্তন নয়, নয় র্যাডিক্যাল পরিবর্তন।
রাজাপাক্ষে পর্বের অন্ধকার
শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক ইতিহাস বুঝতে হলে, রাজাপাক্ষে পরিবারের দুই দশকের অপশাসন ও তার ফলস্বরূপ সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। এই সময়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল পরিবারতন্ত্রের দাপট। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী সহ রাজাপাক্ষে পরিবারের মোট আটজন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে ছিলেন। এই অভিজাত শ্রেণির স্বার্থে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারিত হয়েছিল, ফলস্বরূপ কিছু মন্ত্রী, সাংসদ ও প্রভাবশালী মানুষ দ্রুত বিপুল অর্থের মালিক হন। এই প্রবণতা দুর্নীতিকে বেপরোয়া করে তুলেছিল।
এই পরিবার একাধারে উগ্র সিংহলি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি অনুসরণ করত এবং বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতি চালিয়ে যেত। তাদের উগ্র জাতীয়তাবাদী কৌশল একদিকে সিংহলি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন ধরে রাখতে সাহায্য করত, অন্যদিকে তামিল, মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে অর্থনৈতিক দুর্দশার মূল কারণগুলি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখত। দীর্ঘদিনের এই অপশাসন রাষ্ট্রকে ভয়াবহ আর্থিক সংকটের দিকে ঠেলে দেয়।
যখন আগুন লাগে ঘরে
গোতাবায়া রাজাপাক্ষের সরকারের ভ্রান্ত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত, অপরিকল্পিতভাবে এলিটদের জন্য কর হ্রাস এবং কোভিড মহামারির সম্মিলিত প্রভাবে দেশটি আর্থিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যায়। যা সাধারণ মানুষের জীবনে তীব্র আঘাত হানে। দেশের ২৬ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যায়। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়, অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বাড়ে ৪৫ শতাংশ।
বিদ্যুৎ ছিল না প্রায় ১৩ দিন ধরে। গাড়ি চালানোর জন্য পেট্রোল বা ডিজেল ছিল না, রান্না করার জন্য গ্যাস ছিল না এবং চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ওষুধ ছিল না। এই চরম দুর্ভোগ এবং দুর্নীতিই জন্ম দেয় আরাগালায়া আন্দোলনের।
জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম
২০২২ সালের মার্চে শুরু এই গণসংগ্রাম বা ‘আরাগালায়া’ ছিল দুর্নীতি ও অপশাসনের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত, অরাজনৈতিক নাগরিক আন্দোলন। যে আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল না। আরাগালায়া আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, এর অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র। এই আন্দোলনে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ও পেশা নির্বিশেষে সমাজের সকল স্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। বৌদ্ধ ভিক্ষু, খ্রিস্টান পাদ্রি, মুসলিম মৌলবি থেকে শুরু করে গৃহযুদ্ধে চরমভাবে অত্যাচারিত তামিল সম্প্রদায় এতে অংশ নেন। এই অভূতপূর্ব সংহতি প্রমাণ করে যে, অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ জাতিগত বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের জন্ম দিয়েছিল।
এই আন্দোলন শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুকে জাতিগত বিদ্বেষ থেকে সরিয়ে দুর্নীতি এবং ব্যবস্থা পরিবর্তনের দিকে চালিত করে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এই গণবিদ্রোহের ফলে গোতাবায়া রাজাপাক্ষে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার জয়ী হয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন অনুরা কুমারা দিশানায়কে।
নতুন রাজনীতির দর্শন
শ্রীলঙ্কার রাজনীতির নতুন গতিপ্রকৃতি বুঝতে বাটারা মুল্লাতে জনতা বিমুক্তি পেরেমুলা’র সদর দপ্তরে এক দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ হয়েছিল। কলম্বো থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে এই কেন্দ্রটি এক নতুন সংগ্রামের দলিল। জেভিপি অতীতে কঠোর বামপন্থী বিপ্লবী দল হিসেবে পরিচিত ছিল, যারা ১৯৭১ এবং ১৯৮৭-’৮৯ সালে ব্যর্থ সশস্ত্র অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। ১৯৯০ সাল থেকে দলটি সশস্ত্র পথ ছেড়ে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসে।
আদর্শের পুনর্নির্মাণ
এখনকার রাষ্ট্রপতি অনুরা কুমারা দিশানায়কে (একেডি) ১৯৯৪ সাল থেকে জেভিপির মূল নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি অনুধাবন করেন, কেবল বামপন্থী ভোট দিয়ে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়লাভ সম্ভব নয়। দরকার বৃত্তের বাইরের ভোটারদের সমর্থন অর্জন। এই বাস্তব উপলব্ধি থেকে তাঁর নেতৃত্বে ২০১৯ সালে ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার জোটের সৃষ্টি।
এনপিপি পুঁজিবাদ বিরোধী বা সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের মঞ্চ নয়। এটা মূলত মধ্য-বামপন্থী মঞ্চ, যা জেভিপি সহ মোট ২১টি রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, এনজিও, সিভিল সোসাইটি, ট্রেড ইউনিয়ন এবং বুদ্ধিজীবী সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত। জেভিপি মার্কসবাদী হলেও এই বৃহত্তর মঞ্চ একটি প্রগতিশীল ও বাস্তববাদী কৌশল গ্রহণ করেছে।
সিস্টেম চেঞ্জ
এনপিপি’র মূল স্লোগান ছিল, কাঠামোগত পরিবর্তন। নিছক শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন নয়। তাদের মতে, শ্রীলঙ্কার অধঃপতনের মূলে ছিল অসৎ রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অগণতান্ত্রিকভাবে অর্থনীতির পরিচালনা এবং ব্যক্তিস্বার্থে স্বজনপোষণ। এই কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য সরকার দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন, আইনের শাসন এবং নাগরিকদের প্রতি গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে চায়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের রাজনীতিকরণ বন্ধ করার অঙ্গীকার। এই দর্শন ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল, যা ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিশাল ম্যান্ডেটে প্রমাণিত হয়।
ইতিহাসের বাঁক বদল
আরাগালায়া’র পর ২০২৪-এর নির্বাচনে শেষপর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটে, যা শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক মেরুকরণকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। এই বিজয় কেবল অনুরা কুমারা দিশানায়েকে’র উত্থান নয়, বরং প্রতিষ্ঠিত দলগুলির বহু দশকের আধিপত্যের অবসান ঘটায়। একই বছরের ১৪ নভেম্বর সাধারণ নির্বাচনে এনপিপি ৬১.৬ শতাংশ ভোট পেয়ে ২২৫টি আসনের ১৫৯টিই লাভ করে, যা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এই জয় ছিল আরাগালায়া আন্দোলনের সাফল্যের প্রত্যক্ষ প্রতিফলন। এটা ইঙ্গিত করে যে, জনগণের তীব্র ক্ষোভ ইউএনপি সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছিল, যার প্রতিফলন ঘটেছে ব্যালট বাক্সে।
নতুন নেতৃত্ব
অনুরা কুমারা দিশানায়েকে রাষ্ট্রপতি হয়ে সমাজবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও গবেষক হারিনি আমারাসুরিয়াকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। হারিনি জেভিপি দলভুক্ত নন। তিনি শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে তৃতীয় মহিলা প্রধানমন্ত্রী। প্রথমদিকে মাত্র তিনজন নিয়ে গঠিত হয়েছিল মন্ত্রীসভা, যা ছিল বিশ্বের ক্ষুদ্রতম মন্ত্রীসভাগুলির অন্যতম। এই পদক্ষেপ নতুন সরকারের স্বল্প-ব্যয়ী ভাবমূর্তিকে প্রতিফলিত করে। নতুন সংসদ সদস্যদের অনেকেরই রাজনীতি বা প্রশাসনের পূর্ব অভিজ্ঞতা কম ছিল। তাঁদের মূল পরিচয় ছিল দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে।
অর্থনীতির কাঁটাপথ
এনপিপি সরকার বিপুল জনসমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় এলেও, তাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কঠোর শর্তাবলি। যা এনপিপি’র বামপন্থা এবং বাস্তবতার মধ্যে এক তীব্র সংঘাত তৈরি করে। শ্রীলঙ্কার বেশিরভাগ বৈদেশিক ঋণ আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ডের (১২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) আকারে রয়েছে। আইএমএফের ২.৯ বিলিয়ন ডলার Extended Fund Facility (EFF) প্রোগ্রামটি ২০২৭ সালের মার্চ পর্যন্ত চলবে। জেভিপি নেতৃত্বাধীন সরকার এই ঋণ বাতিল করতে অস্বীকার করেছে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন ছিল। কারণ, ভবিষ্যতে দেশের রাজস্ব আয়ের ৩০ শতাংশ এই বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যয় করতে হবে।
এটা সরকারের সবচেয়ে বড় আদর্শগত দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে। জেভিপি/এনপিপি নীতিগতভাবে উদারীকরণের বিরোধী। অতীতে অনুয়া কুমারা নিজেই আইএমএফের শর্তের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। অথচ ক্ষমতায় এসে দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে তাঁদের পূর্বতন সরকারের আইএমএফ সমর্থিত আর্থিক সংস্কারগুলি মেনে নিতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিকে অনেকে কাঠামোগত পরিপালন (Structural Compliance) মনে করছেন, যেখানে সরকারের হাত বাঁধা।
সামাজিক, আর্থিক পদক্ষেপ
গৃহীত কিছু পদক্ষেপ নতুন সরকারের নীতিগত অবস্থানকে স্পষ্ট করে—
১. কৃষিনীতি : পূর্বতন সরকারের রাসায়নিক সার নিষিদ্ধকরণ নীতি বাতিল। কৃষকদের রাসায়নিক সারের ভরতুকি ১৫,০০০ থেকে বৃদ্ধি করে ২৫,০০০ টাকা করা। ২. স্বচ্ছতা ও আচরণবিধি : সরকারি অর্থের অপচয় বন্ধ, মন্ত্রী বা সাংসদদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বা সংসদ অধিবেশনে উপস্থিতির ভাতা বাতিল ইত্যাদি। রাজনৈতিক ও সরকারি আধিকারিকদের সম্পদের ঘোষণা বাধ্যতামূলক। ৩. অর্থনৈতিক পুনর্গঠন : অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি, পর্যটন, চা ও সৃজনশীল শিল্পের (যেমন আর্ট, সিনেমা, সাহিত্য) উপর বিশেষ গুরুত্ব।
শ্রমিকের স্বপ্ন ও আরাগালায়া
শ্রীলঙ্কার সমাজ ও রাজনীতিতে জাতিগত বিভেদ এবং শ্রমিকের বঞ্চনা একটি দীর্ঘকালীন ক্ষত। এনপিপি সরকারের সামনে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হল ইতিহাসের এই বোঝা থেকে মুক্তি এবং জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা।
তামিল প্রশ্ন : ইতিহাসের বোঝা
প্রায় তিন দশকের গৃহযুদ্ধ শ্রীলঙ্কার উত্তর ও পূর্ব প্রান্তে বসবাসকারী তামিল সম্প্রদায়ের উপর চরম নিপীড়ন নিয়ে এসেছিল। এই দীর্ঘ সংঘাতের সমাধান আজও অধরা। এনপিপি সরকার তামিল প্রশ্নের সমাধানে স্বচ্ছ নীতি গ্রহণে আগ্রহী। আরাগালায়া আন্দোলনে তামিলদের অংশগ্রহণ নতুন সরকারকে এই সমস্যা সমাধানে অনুপ্রাণিত করেছে। সাধারণ নির্বাচনে এনপিপি জোট শুধু সিংহলি বৌদ্ধদের সমর্থন পায়নি, বরং উত্তর-পূর্ব শ্রীলঙ্কায় পাঁচটি আসনে তামিল, মুসলিম ও খ্রিস্টানদের সমর্থন পেয়ে বিজয়ী হয়েছে। যা ইঙ্গিত করে যে, এনপিপি সফলভাবে জাতিগত মেরুকরণ পার করে জাতীয় স্তরের অ্যাজেন্ডা তৈরি করতে পেরেছে।
প্রতিবাদের বিশ্বজনীনতা
আরাগালায়া আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করে যে, শ্রীলঙ্কার তরুণ প্রজন্ম দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় নির্ধারক শক্তি হিসাবে সামনে এসেছে। শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যার প্রায় ৩৮ শতাংশ (৮৫ লক্ষ মানুষ) তরুণ প্রজন্মের। এই বিপুল সংখ্যক তরুণ ছিল ২০২২ সালের গণসংগ্রামের মূল চালিকা শক্তি। যেমন হালের নেপাল ও বাংলাদেশের মতোই শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো (যেখানে ৫৫ শতাংশ মানুষের বাস) ছিল অস্থিরতার কেন্দ্র। তরুণদের অসন্তোষের মূল কারণ ছিল শাসকগোষ্ঠীর দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, অপশাসন ও সম্মানজনক কাজের অভাব। উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি এবং সমাজমাধ্যমে প্রতিবাদের ডাক দিয়ে তরুণ প্রজন্ম খুব অল্প সময়ে সংগঠিত হয়, যা গণবিদ্রোহকে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছিল।
বিপর্যয় বনাম লভ্যাংশ
যুবশক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করে এনপিপি সরকার ‘প্রতিদ্বন্দ্বী, সংস্কৃতিমনস্ক ও স্বাধীন চিন্তাবিদ যুবসমাজ’ নীতি গ্রহণ করেছে। এখন যুবকদের কাজের অধিকার সংরক্ষণ, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধিত্বের কোটা নির্ধারণ এবং ন্যাশনাল ইউথ সার্ভিস কাউন্সিলকে পুনর্গঠনের মাধ্যমে যুবসমাজের ক্ষমতায়ন করতে চাইছে। সরকার বুঝতে পেরেছে, যুবসমাজকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের সঙ্গে একীভূত করা না হলে, দেশের ‘জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ’ (Demographic Dividend) দ্রুত ‘জনসংখ্যাগত বিপর্যয়ে’ (Demographic Disaster) পরিণত হতে পারে ।
ব্যতিক্রমী পথে
শ্রীলঙ্কার গণ অভ্যুত্থান দক্ষিণ এশীয় প্রেক্ষাপটে কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী। নেপাল বা বাংলাদেশে তরুণদের নেতৃত্বে সরকারের পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু সেখানে মৌলবাদ বা রাজতন্ত্রের সমর্থকদের তৎপরতা দেখা গেছে। শ্রীলঙ্কায় ছাত্র-যুবসমাজ মূল ভূমিকা পালন করলেও এনপিপি বা জেভিপি নির্বাচনে জয়লাভ করে গণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় এসেছে। সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ বা নির্বাচন পরবর্তী হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি। এটা শ্রীলঙ্কার পরিবর্তনকে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পথে সামাজিক রূপান্তরের ইঙ্গিত বহন করে।
স্বপ্ন ও পথের বাঁকে
আমার শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ কেবল রাজনৈতিক পালাবদলের সাক্ষী হওয়ার জন্য নয়, বরং দেশটির নাগরিক মনন ও সভ্যতার প্রতিচ্ছবি দেখার জন্য। কলম্বো, ক্যান্ডি বা গলের মতো শহরগুলিতে ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের ছাপ যেমন রয়েছে, তেমন আধুনিক নাগরিক শৃঙ্খলার স্পষ্ট প্রমাণ মেলে। শহরগুলি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং ট্রাফিকের ক্ষেত্রে পথচারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
এদেশের মানুষ অত্যন্ত আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, প্রতিবাদী এবং সুশৃঙ্খল। সবচেয়ে লক্ষণীয় পরিবর্তন হয়েছে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। সদ্য নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা অন্য কোনও নেতার প্রতিকৃতি বা কাটআউট কোথাও চোখে পড়েনি, যা অতীতে ছিল দক্ষিণপন্থী শাসনের সাধারণ দৃশ্য। এনপিপির লক্ষ্য কেবল অর্থনীতি সংস্কার নয়, বরং এমন সমাজ প্রতিষ্ঠা, যেখানে মহিলারা সমান অধিকার ভোগ করবেন এবং শারীরিক বা আবেগগত হিংসা থেকে মুক্ত থাকবেন। তাদের লক্ষ্য ৫০ শতাংশ মহিলাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা।
গরিব কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা অনুরা কুমারা দিশানায়েকের নেতৃত্বাধীন এই নবীন সরকার ইতিহাসের কঠিন পথে হাঁটতে শুরু করেছে। তাদের সামনে আইএমএফের শর্তপূরণ, দুর্নীতি দূরীকরণ, বেকারদের কাজ দেওয়া, এবং মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের মতো কঠিন চ্যালেঞ্জ রয়েছে। জনগণের পূর্ণ আস্থা রয়েছে এই নেতৃত্বের প্রতি। কিন্তু এই আস্থা ও আন্তর্জাতিক পুঁজির শর্তাবলির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষাই হবে তাদের আসল পরীক্ষা। গলফেস গ্রিনের তীরে সমুদ্রের ঢেউ যেমন চিরন্তন, তেমন জনগণের সংগ্রামও। শ্রীলঙ্কার নবজাগরণ সেই সংগ্রামের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে।

