পূর্বা সেনগুপ্ত
গঙ্গার ওপরে দ্বিতীয় সেতু ছাড়িয়ে শিবপুরের মন্দিরতলা স্টপ পৌঁছাতে আজ পাঁচ মিনিটও লাগে না। কিন্তু কিছুদিন আগেও শিবপুর যে গঙ্গার ওপার তা ভালোভাবেই বোঝা যেত। শোনা যায়, রাজা নন্দকুমারের ফাঁসির আদেশ হলে শাসক ইংরেজদের ওপর তীব্র বিদ্বেষ সৃষ্টি হয় কলকাতার ব্রাহ্মণশ্রেণির। নব্য কলকাতার সমাজ ব্যবস্থায় তখন নতুন ধনীর উত্থানের পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ধন মর্যাদা নয়, বংশ মর্যাদায়, জাতি মর্যাদায় ব্রাহ্মণই তখন শ্রেষ্ঠ! তাঁরাই সমাজের মাথা! তাঁদের উপস্থিতিতে এতবড় একটি অন্যায় সিদ্ধান্ত বিদেশি শাসক গ্রহণ করবে! – এ ছিল অসহ্য। প্রতিবাদ করে লাভ নেই, ব্রাহ্মণের মর্যাদা বিদেশি জানে না, তাই একদল ব্রাহ্মণ দুষ্ট শাসকের শাসনকে উপেক্ষা করে, তার প্রতিবাদ স্বরূপ কলকাতা নগরী ত্যাগ করে গঙ্গার ওপারে গিয়ে বসতি স্থাপন করলেন।
ব্রাহ্মণ সমাজের এই নতুন বসতিই হল শিবপুর। মন্দিরতলা দিয়ে শিবপুর রোড ধরে একটু এগোলেই একটি শিবমন্দির চোখে পড়বে। এই শিবমন্দিরই হয়তো ‘শিবপুর’ নামের উত্স। গঙ্গার ধারে মন্দির ও রমতা সাধুর আস্তানা বেড়ে ওঠে। বর্তমানের গঙ্গা নয়, তৎকালে জলপথে গঙ্গা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করত, আর কলকারখানা আর চিমনির ধোঁয়ার পরিবর্তে সেখানে ঝোপ-জঙ্গল আর নীরবতা।
মন্দিরতলার বড় শিবমন্দির ছাড়িয়ে শিবপুর রোড ধরে একটু এগিয়ে গেলেই মুখোপাধ্যায় পরিবারের প্রাচীন বাড়ি ‘সুন্দর ভবন’। এই পরিবার শিবপুরের আদি অধিবাসী নয়। বেশ কয়েক পুরুষ আগে এঁরা ছিলেন চন্দননগরের গোদলপাড়ার অধিবাসী| চন্দননগর ফরাসি অধ্যুষিত অঞ্চল, ১৭৫৭-এর পলাশীর যুদ্ধের পর লর্ড ক্লাইভ চন্দননগর আক্রমণ করলে গোদলপাড়ার মুখোপাধ্যায় পরিবারের এক শরিক রামকান্ত নিজ পরিবার নিয়ে সেই রাজনৈতিক গোলযোগের মধ্যে শিবপুরে চলে আসেন। শিবপুরের এক হালদার পরিবারের সঙ্গে রামকান্ত পরিচিত ছিলেন। সেই হালদার পরিবারই রামকান্তকে শিবপুরে স্থায়ী বসবাসে সহায়তা করে।
রামকান্ত সেখানেই সপরিবার বাস করতে থাকেন, তখন তাঁরা হালদার পরিবারের যজমানি করতেন কি না সে সম্বন্ধে স্পষ্ট কোনও ধারণা পরিবারের বর্তমান সদস্যদের নেই। তবে কারও মতে, এই হালদার বংশীয় পরিবার কালীঘাটের হালদারদেরই এক অংশ ছিল। রামকান্তের বাসস্থান থেকে গঙ্গা কাছেই, তাই ঘাটে নেমে সাধু, সন্ন্যাসীরা সেই বাড়িতে ভিক্ষার জন্য উপস্থিত হতেন। রামকান্তের কোন দেবতা আরাধ্য ছিলেন কিংবা তিনি কোনও দেবতাকে নিয়ে মূল গৃহ থেকে শিবপুরে এসেছিলেন কি না- এ তথ্যও এখন কেউ স্পষ্টভাবে বলতে অক্ষম। কিন্তু এই পরিবার ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, রামকান্তের পুত্র রামসুন্দরের সময়।
রামসুন্দরের পাঁচ পুত্র। রামসুন্দরের সময় পরিবারটি যে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল তা বুঝতে পারা যায় রামসুন্দরের তৈরি বাড়ি দেখে। সমৃদ্ধ এই পরিবারে তখনই গৃহদেবীর শুভাগমন। রামসুন্দর পরিবারের জন্য বড় বাড়ি তৈরি করেন, বাড়ির নাম রাখেন ‘সুন্দর ভবন’। চারদিকে চকমেলানো বাড়িটির সদর দরজার দিকের পাঁচিলটি ছিল ফোর্টের মতো! খাঁজ কাটা। লোকে তাই বাড়িটির নাম দিয়েছিল, ‘ফোর্ট বাড়ি’। এখন সেই পাঁচিলের কোনও অস্তিত্ব নেই। তা ধ্বংসপ্রাপ্ত।
গৃহের গৃহদেবী কেমনভাবে এসেছিলেন তা নিয়ে দু’-একটি কাহিনী পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। সেই কাহিনী অনুসারে প্রথমটি হল এমন, -চন্দননগর থেকে আসার পর দিন এগিয়েছে, রামসুন্দর একদিন স্বপ্নে দেখলেন, এক দেবী তাঁকে নির্দিষ্ট একটি জায়গা দেখিয়ে বলছেন, ‘এইখানে আমি বহুদিন ধরে পড়ে আছি।’ বাড়িতে ঢুকতে ডানদিকে বাড়ির গা লাগোয়া বিরাট পুকুর। বর্তমানে যে পুকুরটির নাম ‘বোলপুকুর’। শিবপুর মন্দিরতলার ঘিঞ্জি জনবসতির মধ্যে এই বিরাট পুকুরটি দেখে বেশ আশ্চর্য লাগে | শোনা যায়, অনেকবারই এই জলাশয় বুজিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু কোনওমতেই তা সম্ভব হয়নি। যিনি উদ্যোগ নিয়েছেন, তিনি হয় অসুস্থ হয়েছেন নয়তো অন্য কোনও দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
পুকুর পাড় ধরে এগোলে কচুবন। সেই কচুবনের ধার থেকে রামসুন্দর পেলেন একটি অভূতপূর্ব জিনিস! কোনও মূর্তি নয়, কোনও পাথর নয়, একটি তামার টুকরো। চারকোনা এক ইঞ্চি বাই আড়াই ইঞ্চি একটি পুরু তামার পাতে খোদাই করা আছে দেবীযন্ত্র। তিনি মাথায় করে নিয়ে এলেন দেবীকে। তারপর গৃহে প্রতিষ্ঠা করলেন| সেই থেকে দেবী হলেন রামসুন্দর প্রতিষ্ঠিত মুখোপাধ্যায় পরিবারের ‘গৃহদেবী’। দেবীর নাম ‘শ্রীশ্রীলক্ষ্মীহরি মাতা ঠাকুরাণী’। মুখোপাধ্যায় পরিবারের পাশের যে ব্রাহ্মণ পরিবার বাস করত, এখন তাঁদের বড় বাড়ি ফ্ল্যট হয়ে গিয়েছে। সেই পরিবারে অবিকল একই ধরনের ‘দেবীযন্ত্র’ লাভের কাহিনী প্রচলিত আছে। এবং সেই পরিবারে এখনও দেবী সেই যন্ত্রেই পূজিত হন।
কথায় বলে ‘যেখানেই বাঙালি, সেখানেই মা কালী’। বাংলার পাড়ায় পাড়ায় দেবীকালিকার মূর্তি, কোথাও তিনি পাথরের উপর চোখ, নাক দিয়ে সজ্জিত দেবীমুখ, কখনও বা লোলজিহ্বাধারী মুণ্ডমালা হাতে মাতৃমূর্তি! একটি রূপের পূজা! দেবীরূপের সম্মুখে কালীযন্ত্রের উপর পুজো করেন পূজক! দশমহাবিদ্যার দশটি দেবীর পৃথক পৃথক যন্ত্র রয়েছে। কিন্তু দেবী কালিকা গৃহদেবী রূপে কোনও মূর্তিতে নয়, কেবল যন্ত্রে পূজিত হন- এ ঘটনা কিন্তু খুবই বিরল। এখন প্রশ্ন হতে পারে, যন্ত্রটি কেমন! তার বিশেষত্ব কী? কিন্তু দুঃখের বিষয় এই দেবী পরিবারের অজ্ঞনতাবশত বা বহুকাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য তাঁকে স্নান ইত্যাদি করাতে গিয়ে যন্ত্রটি প্রায় মুছে গিয়েছে। কোন কোন স্থানে রেখা ছিল- এটাই বোঝা দুঃসাধ্য। কিন্তু দেবীর সঙ্গে মা লক্ষ্মীর একটি সংযোগ আছে। দীপান্বিতা অমাবস্যার দিন প্রতিবছর দেবীর বিশেষ পুজো। সেইদিন সন্ধ্যার সময় বাড়িতে আগে লক্ষ্মীপুেজা হয়, লক্ষ্মীপুজো সম্পন্ন হয়ে গেলে দেবী নাটমন্দিরে আসেন ও মূল কালীরূপে পুজো শুরু হয়। সাধারণত দেবী কালিকা গৃহে কিংবা বারোয়ারি পুজোমণ্ডপে সাধারণত গভীর রাতের দিকে আরাধিত হন। কিন্তু এ পরিবারে কালীপুেজা হয় সন্ধের সময়, নাটমন্দিরে আগে কেবল মোমবাতির আলোয় বা প্রদীপের আলোয় পুজো হত। কোনও জোরালো আলো নিষিদ্ধ ছিল। এখনও সেই ধারাকে মান্য করে মোমবাতির আলোয় পুজো সম্পন্ন হয়। পরিবারের সকল আত্মীয়পরিজন, পুজোয় অংশগ্রহণ করতে ভিন্ন পরিবারের সদস্যরা পরিবারের মঙ্গলের জন্য নাটমন্দিরের একপাশে মোমবাতি প্রজ্বলিত করেন, প্রত্যেক সদস্যের জন্য একটি করে বাতি দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়। পুজোয় বলিদান প্রথা প্রথম থেকেই চলে আসেছে। যতক্ষণ বলি না হয় ততক্ষণ আতশবাজি পোড়ানো বন্ধ থাকে। বলি হয় নাটমন্দিরে সম্মুখে ছোট্ট মাঠে। অমাবস্যার রাতে পাটকাঠি জ্বালিয়ে সাতজন বাড়ির ছেলে হাড়িকাঠ ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই পাটকাঠির মশালের আলোয় দেবীর সম্মুখে বলি প্রদত্ত হয়| বলি পর্যন্ত যেন দেবী মৃদু আলোয় উপাসিত হতেই বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু যেই মাত্র বলিদান হয়ে যায়, ছাগের কাটামুণ্ড দেবীর সম্মুখে ধরামাত্রই বাজিপোড়ানোর উত্সব শুরু। নাটমন্দিরে সম্মুখের ছোট্ট মাঠে, দু’ধারের বারান্দায় প্রচুর বাজি, তুবড়ি ইত্যাদি পোড়ানো হয়। এই পরিবারের সদস্যরা কেবল কেনা বাজির উপর নির্ভর করেন না, পুজোর আগে বাড়িতে বাজি তৈরি হয়, বিশেষ করে তুবড়ি!!
কালীপুজোতেই এই গৃহদেবী বিশেষভাবে পূজিত হন। এছাড়া নিত্য দেবীর পুজো ও ভোগ সম্পন্ন হয়। যদিও দিন এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের মূল অংশ গৃহ থেকে চারপাশে ছড়িয়ে গিয়েছে অনেক বেশি। কিন্তু সকলেই দেবীপুজোয় শামিল হতে ভালোবাসেন। কেউ বাড়ি থেকে দূরে কোথাও গেলে দেবীকে প্রণাম করে যান। বিশেষ অনুষ্ঠানে দেবীকে প্রণাম করেন সকলেই। পরিবারের সকলে শুনেছে, দেবীপুজো সূচনার সময় মুখোপাধ্যায় পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না। কী করে দেবীকে ভোগ দেবেন? দেবী স্বপ্নে জানালেন, কেবল বাতাসা মিষ্টান্নেই তিনি খুশি হবেন। কিন্তু পুজো যে হবে তার জন্য বাসনপত্র পাব কোথা থেকে? দেবী চিন্তা করতে নিষেধ করলেন।
আশ্চর্য ব্যাপার, দেবীপুজোর আগের দিন নাকি পুজোর প্রয়োজনীয় সমস্ত বাসনপত্র পুকুরে ভেসে উঠত। পুজো শেষ হলে সেই বাসনপত্র পুকুরের পাড়ে রেখে এলে কে যেন এসে নিয়ে যেত। এইভাবে বহু বছর, দেবী স্বয়ং তাঁর পুজোর বাসনপত্র জুগিয়েছেন। কিন্তু মানুষের মনের লোভই তাকে সত্য থেকে বিচ্যুত করে, একবার পুজোয় দেবীর প্রেরিত বাসনের মধ্য থেকে একটি বাসন চুরি যায়। দেবীকে সেটি আর ফেরত দেওয়া সম্ভব হল না মুখোপাধ্যায় পরিবারের। তার পরের বছর থেকে আর বাসন পাঠান না দেবী। বংশধর বিহারীলাল মুখোপাধ্যায়ের সময় এই পরিবার সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। সেই সময় কোনও দরিদ্র ছাত্র পড়াশোনার জন্য অর্থ বা কোনও দরিদ্র পিতামাতা সন্তানের বিবাহদানের জন্য অর্থ যাঞ্চা করে এ বাড়ির দুয়ারে এসে দাঁড়ালে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার হুকুম ছিল না বিহারীলালের। সেই সময় দেবীপুজোর বাসনের অভাব হয়নি! বিরাট পরিবারে তখন বহুলোক সমাগম। এই সমৃদ্ধির দিন অতীত, তবুও আজ সেই প্রাচীন দিনগুলিকে স্মরণ করে বহু উপচারের মধ্যেও মাটির সরা করে চিনি ও বাতাসা প্রসাদ দেবীর উদ্দেশে নিবেদন করা হয়।
এতবছর ধরে একই গৃহে পূজিত হয়ে আসার গৌরব অর্জন করেছেন এই দেবী। এই পুজোর সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে পরিবারের একটি দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁদের মাথার উপর দেবী আছেন। তিনিই অভিভাবক। শোনা যায়, এই পরিবারের বিহারীলাল কোনও সময় অর্থকষ্টে পড়েন, কারণ পিতা রামচন্দ্র খুব বড় পদে চাকরি করলেও অল্প বয়সে হঠাৎ মারা যান। বিহারীলালকে সংগ্রাম করে বড় হতে হয়েছিল। তাই কোনও সময়ে সামনেই দেবীপুজো, কিন্তু হাতে তাঁর বেশি টাকা নেই।
কীভাবে তিনি পুজো সম্পন্ন করবেন সেই চিন্তা করতে করতে পাশেই একটি মুদির দোকানে উপস্থিত হলেন। পুজোর জিনিসপত্র কিনতে এসেছেন শুনে দোকানি অবাক! সেকি! এই কিছুক্ষণ আগেই তো একজন বাড়ির পুজোর সমস্ত জিনিস কিনে দাম মিটিয়ে চলে গেল। আপনি চলে যান বাবু! সে এতক্ষণ নিশ্চয়ই বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছে। দোকানির কথা শুনে অবাক হয়ে যান বিহারীলাল। সে কি! তাঁর গৃহদেবীর পুজো অথচ তিনি জানেন না! কে বাজার করে গেল? দ্রুত গৃহে ফিরলেন বিহারীলাল, সত্যিই বড় দালানের উপর সমস্ত দ্রব্য ঝুড়ি ভরে পড়ে আছে। আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এই সব কে দিয়ে গেল? উত্তর এল, একটি মেয়ে কালো মতো! সাদা শাড়ি পরিধানে। – কিন্তু আমি তো এসব ক্রয় করিনি! সকলে বুঝলেন এ মায়ের-ই লীলা।
রামচন্দ্র ছিলেন এজি বেঙ্গলের অডিটর জেনারেল, খুব অল্প বয়সে তাঁর মৃত্যর পর বিহারীলাল খুব কষ্টে পরিবারের সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনেন। ইংরেজি ভালো বলতে পারার সুবাদে ইংরেজদের সুনজরে পড়েন তিনি। কোলিয়ারিতে কাজ পান, শেষে ম্যানেজার পদ লাভ করেন, পরে এজেন্সি নেন, রেলের ইস্টার্ন জোন কোলিয়ারির। এই সময়ই মুখোপাধ্যায় পরিবারের সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়। উদার বিহারীলালের পোষ্য ছিল অনেক! পাঁচ ভায়ের সংসার। হাতে সোনার হাতল দেওয়া ছড়ি নিয়ে বাবুগিরি করে বেড়াতেন অনেকে। কিন্তু এই পরিবারে বিহারীলাল অনেক আত্মীয়কেই পালন করতেন।
পুজোর জন্য বাড়ির ভিতর দালানে গঙ্গার জলভর্তি পাঁচ-ছ’টি জালা রাখা থাকত। এখন থাকে দুটো। একবার পুজোর দিন সকলে ব্যস্ত! এমন সময় সদর দরজায় একটি মেয়ে এসে দাঁড়াল। বেশভূষা দেখেই বুঝতে পারা যায় সে ভিখারি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ভিক্ষা চাইতে শুরু করল। বাড়ির মেয়েদের ব্যস্ততার দরুন কেউ বিরক্তি ভরে ভিখারি মেয়েটিকে তিরস্কার করে উঠল। ভিক্ষা না নিয়ে চলে গেল মেয়েটি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটল এক অঘটন, সকলে দেখল অত বড় বড় পাঁচ-ছয়টি জালার বেশ কয়েকটিতে এতটুকু জল নেই। কোনটির গা আপনা থেকেই ফুটো হয়ে জল বেরিয়ে যাচ্ছে। সকলে বুঝল, ভিখারিণী সামান্য নন! কিংবা দেবীপুজোর দিনে ভিক্ষে না দাওয়ার নিষ্ঠুরতায় ক্রুদ্ধ হয়েছেন দেবী।
তৃতীয় ঘটনাটি হাল আমলের। একবার এক কালীভক্ত পূজারি কালীপুজোর দিন দেবীপুজো সম্পন্ন করে ফুলবেলপাতার সঙ্গে ছোট্ট যন্ত্ররূপ দেবীকে নিজের বাড়িতে নিয়ে চলে যান। ফুলবেলপাতায় ছোট্ট দেবীযন্ত্র আবৃত থাকে। তাই সিংহাসনে যে দেবী নেই এটা কারও নজরে আসেনি! ব্যাপারটি জানাজানি হল পরদিন সকালে। পুরোহিত ছুটতে ছুটতে এসে দেবীকে ফেরত দিয়ে গেলেন এবং নিজের ভুল স্বীকার করে বললেন, ‘দেবীকে তো নিয়ে গেলুম কিন্তু সারারাত তিনি আমাকে নানা বিভীষিকা দেখিয়েছেন। দেবীকে আমার দরকার নেই, তোমাদের দেবী, তোমাদের গৃহেই থাক।’ এই পুরোহিত যেমন বলেছেন, ঠিক তেমনই দেবীকে স্বচক্ষে দেখেছেন এমন অনেকেই এখনও আছেন, কারণ এটি সত্তর দশকের ঘটনা। তখন নকশাল আমল শুরু হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্নটি আরেকটি জায়গায়, দেবীর প্রাপ্তি সংক্রান্ত কাহিনী দুটি পরিবারের মধ্যে এত সাদৃশ্যযুক্ত হল কীভাবে? শিবপুর মন্দিরতলায় দুটি শিবমন্দির, একটি বড় শিবমন্দির, অন্যটি ছোট শিবমন্দির। এই ছোট শিবমন্দিরের কাছেই মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের গুরুর বাড়ি। প্রতি বছর কালীপুজোর পর এই গুরুর বাড়িতে সিধা পাঠানোর একটা রীতি ছিল, এখনও আছে। এই ‘গুরুবাড়ি’কে কেন গুরুর বাড়ি বলা হত তা পরিবারের এখনকার সদস্যদের অজানা। তবে সিধে দেওয়ার প্রথাটি দেখে মনে হয়, হয়তো এই ‘গুরুবাড়ি’ পূর্বে মুখোপাধ্যায় পরিবারের কুলগুরু ছিলেন এবং এই ‘গুরুবাড়ি’র সদস্যরাও মুখোপাধ্যায় পদবির অধিকারী। পাশের পরিবারটি এই গুরুবাড়িরই একটি শরিক। রামচন্দ্র একদিন বাগানে কাজ করতে করতে পায়ে আঘাত পান, সেই থেকে গ্যাংগ্রিন হয়ে মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যু হলে সেই বাগানটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। এখানে সেই ‘গুরুবাড়ির’রই এক শরিক দুলাল মুখোপাধ্যায় বাড়ি তৈরি করেন। সুতরাং রামকান্ত প্রতিষ্ঠিত সুন্দর ভবনের পরিবারের অনেক পরে এঁরা এসেছেন, তাই দেবীলাভের মূল কাহিনীটি নিশ্চয়ই তাঁদের নয়। তাঁদের যন্ত্রলাভের পৃথক কাহিনী থাকাই স্বাভাবিক। এই দেবীর যন্ত্রে পূজিত হওয়ার ধারাটির মধ্যে তান্ত্রিক ভাবনার ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকে। গঙ্গার পাড়, শিবমন্দির, ব্রাহ্মণদের পল্লি – এমন স্থানে কোনও মাতৃসাধকের আগমন হয়েছিল কি? যিনি হয়তো বা গুরুবাড়ি, বা ছোট শিবমন্দিরের পাশের মুখোপাধ্যায় পরিবারের সদস্য ছিলেন। তিনিই হাতে তুলে দিয়েছিলেন যন্ত্রে অঙ্কিত দেবীরূপ। যাঁকে গৃহদেবী রূপে প্রতিষ্ঠার আদেশ দিয়েছিলেন। ওই দেবীর মাহাত্ম্য সেই পরিবারে কম ছিল না, কারণ নাটমন্দির নিয়ে বেশ কিছু সম্পত্তি দেবোত্তর বলে দেবতার উদ্দেশে নিবেদিত ছিল।
প্রাচীন পরিবারগুলিতে এই ধারা আমরা তখনই দেখি, যখন গৃহদেবী গৃহের পরিধি ছাড়িয়ে, আত্মীয়পরিজনের গণ্ডির মধ্য থেকে চারিদিকের জনসমাজে প্রসিদ্ধা হয়ে ওঠেন। সুন্দর ভবনের গৃহদেবী ‘শ্রীশ্রীলক্ষ্মীহরি কালীমাতাঠাকুরাণী’ -কে পুজো করে এক পৃথক ব্রাহ্মণ পরিবার। বংশপরম্পরায় তাঁরাও পুজো করে আসছেন | সুতরাং একসময় খুবই সমৃদ্ধি নিয়ে এই দেবী গৃহে বিরাজিতা ছিলেন। আজও তাঁর বংশধরেরা দেবীকে তাঁদের গৃহের অভিভাবিকা ও নিজেদের শাক্ত বলে মনে করেন।
(পারিবারিক তথ্য বিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায় ও তাঁর পুত্র অনির্বাণের সূত্রে প্রাপ্ত)