সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
আমার সেই বয়সে একবার প্রেমে পড়ার ভীষণ ইচ্ছে হয়েছিল। সেই বয়েস? যে বয়েসে ঠোঁটের ওপর কাঁচ কাঁচ গোঁফের দুর্বো জন্মায়। দাড়িতে দু’একগাছা ছাগুলে চুল দেখা যায়। গলাটা একটু ভারী ভারী হয়। মানুষ পাকা পাকা কথা বলতে শেখে। সবজান্তা, হামবড়া ভাব। লঘুগুরু জ্ঞানশূন্য। সব কথাতেই এক কথা, যান যান, আপনি কী বোঝেন, আপনি কী জানেন?
সেই বয়েস।
প্রেমে পড়তে হলে একটি মেয়ে চাই। যে-সে মেয়ে হলে হবে না। সুন্দরী হওয়া চাই। ডানাকাটা না হোক, দেখলে যেন প্রেমের উদয় হয়। নায়িকাদের বর্ণনা কত উপন্যাসে পেয়েছি। ছায়াছবির পর্দায় দেখেছি। চাঁদের আলোর ঝিলিক ফুটছে। গাছের ডাল ধরে নায়িকা নাচছে, গাইছে। ঝোপে কোকিল ডাকছে কু-উ-উ।
আমার বন্ধু সুখেন সেই বয়সেই আমার চেয়ে অনেক বেশি পেকেছিল। হিন্দি সিনেমা দেখত আকছার। ইংরেজি ছবির হিরো-হিরোইনদের নাম কণ্ঠস্থ ছিল। বুকপকেটে মেরিলিন মনরোর ছবি পুষত। সে এক ছেলে ছিল বটে।
সুখেন বলল, সব মেয়েই তো আর প্রেমে পড়ে না। যেমন ধর, সকলের সর্দি হয় না। ন-মাসে ছ-মাসে হয়তো একবারই হল। কারও আবার বারোমাসই সর্দি। সকাল হল তো ফ্যাঁচোর ফ্যাঁচোর হাঁচি। একে বলে সর্দির ধাত। এই রকম কারও কাশির ধাত, কারও পেট খারাপের ধাত। সেই রকম কোনও কোনও মেয়ের প্রেমের ধাত থাকে। ধাত বুঝে এগোতে হয়।
সে আমি কী করে বুঝব ভাই?
খোঁজখবর নিতে হবে। অতই সোজা চাঁদু। ঘুরে ঘুরে বাজার দেখ। তারপর ঝোপ বুঝে কোপ মারতে হবে। রাস্তায়, ঘাটে, বাসে, ট্রামে যেখানেই দেখবি কোনও মেয়ে তোর দিকে পুটুস করে তাকিয়েছে, তুই ক্যাবলার মতো চোখ সরিয়ে নিবি না, তুইও তাকাবি কটমট করে। বড় বড় চোখে। মেয়েটা যদি আবার তাকায়, তোর চোখে চোখ পড়বেই। চোখে জাদু থাকে জানিস?
না ভাই।
কী জানো তুমি? চোখের ফাঁদে আটকে ফেলবি। চোখে হাসবি। চোখে চোখে বলবি, সুন্দরী, তুমি আমার, তুমি আমার। সম্মোহিত করে ফেলবি। নিজেকে ভাববি অজগর, সামনে তোর হরিণী।
তুই চোখ মারতে বলছিস? ও ভাই, অসভ্য ছেলের কাজ।
তুই একটা গর্দভ। চোখ মারা নয়। চোখে ভাবের খেলা। সুচিত্রা সেনের অভিনয় দেখেছিস? এই চোখে জল, এই চোখে হাসি, এই চোখে প্রেম, এই চোখে ঘৃণা। সব চোখে চোখে। চোখেই মনের প্রকাশ। তেমনভাবে তাকাতে পারলে রয়েল বেঙ্গল লেজ গুটিয়ে পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়বে।
ও ভাই আমি পারব না। আমার ক্ষমতায় কুলোবে না। আমি কি সুচিত্রা সেন?
দূর মড়া! সুচিত্রা সেনের মতো অভিনয় ক্ষমতা, চোখের ভাষার কথা বলছি। বাড়িতে বড় আয়না আছে?
তা আছে।
আয়নার সামনে দাঁড়াবি, দাঁড়িয়ে চোখের ট্রেনিং শুরু করবি। ঘরে কাউকে ঢুকতে দিবি না। হাসবি কাঁদবি রাগবি গলবি চমকাবি চমকে দিবি। মুখের কিন্তু কোনও পরিবর্তন হবে না। সব চোখে। চোখকে খেলাবি।
এই হল তোর প্রেমের প্রথম পাঠ। এইটে উতরে গেলে দ্বিতীয় পাঠ পাবি।
মনে মনে ব্যাপারটা চিন্তা করে সুখেন ইয়ার্কি করেছে বলে মনে হল না। সত্যিই তো, বশীকরণ বলে একটা ক্রিয়া অবশ্যই আছে। তা নাহলে পাঁজিতে এত বিজ্ঞাপন থাকে কেন? জাদুকর পিসি সরকার হলসুদ্ধ লোককে হিপনোটাইজ করে কত খেলাই তো দেখিয়ে গেছেন। সেই সময়ের খেলা। ন-টার সময় সাতটা বাজিয়ে ছেড়ে দিলেন!
আমাদের পাড়ার কার্তিককে মেসমেরাইজ করে গুণী ব্যক্তি নাম রেখে গেলেন কাকাতুয়া। বলেছিলেন, ফিরে এসে ঠিক করে দেব। তিনি আর ফিরলেন না। সেই থেকে কার্তিক কাকাতুয়া। কাকাতুয়া বললে সাড়া দেয়। কার্তিক বললে সাড়া দেয় না।
দুপুরবেলা বড় বৌদির ঘরে চোখের ট্রেনিং শুরু হল। কেউ যেন আবার দেখে না ফেলে। সব তাহলে কেঁচে যাবে। বাড়িতে প্রাণীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। দুপুরের দিকে খাওয়াদাওয়ার পর সবাই ধুঁকতে থাকে। বড় বৌদির নাক ডাকে। আমার ছোট বোন পিয়া কলেজে চলে যায়। এই হল সাধনার উপযুক্ত সময়।
নিজের চোখ আগে কখনও আমি এমন করে দেখিনি। কেউ দেখেছেন কি না সন্দেহ আছে। আমরা সাধারণত আয়নার সামনে দাঁড়াই। ঝট করে চুল আঁচড়াই সট করে সরে আসি। এ একেবারে নিজের মুখোমুখি ফেস টু ফেস। নিজেকে নিজে দেখা। কখনও প্রেমের দৃষ্টিতে, কখনও ঘৃণার দৃষ্টিতে, কখনও আমন্ত্রণের দৃষ্টিতে আও না পেয়ার করে, লাভ করে, আও না।
দুপুরটা কয়েক দিন এইভাবেই বেশ কাটল। দৃষ্টিতে দৃষ্টি ঠেকিয়ে। নিজের সঙ্গে নিজে চোখে চোখে কথা বলে। হঠাৎ একদিন পিয়ার কাছে ধরা পড়ে গেলুম। আমি জানতুম না ধরা পড়ে গেছি। পিয়া কোন সময় পিছন থেকে দেখে সরে পড়েছে। মনে হয় একটু ভয়ও পেয়েছিল। চুপিচুপি বড় বৌদিকে বলেছিল, দাদা দুপুরবেলা তোমার ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কী করে বলো তো! আমাদের পুষিটাকে আয়নার সামনে বসিয়ে দিলে ঠিক ওই রকম করে। ফ্যাঁস-ফোঁস, থাবা-মারা।
বড় বৌদি বড় চালাক মেয়ে। দুপুরে বিছানায় পড়ে রইলেন মটকা মেরে। সাধনপথে বেশ কিছু দূর এগিয়েছি। একেবারে তন্ময়। চোখে চোখে হাসি চলছে। বৌদি বললে, কী হচ্ছে?
চমকে উঠেছিলুম। ধরা পড়ে গেচি, কী লজ্জা!
বললুম, অভিনেতা হব তো, তাই একটু চোখ সাধছি।
সে আবার কী? লোকে তো গলা সাধে, চোখ সাধা জিনিসটা কী?
আছে আছে। সে তুমি বুঝবে না বৌদি!
কোনও রকমে পালাতে পারলে বাঁচি। ছাদের ঘরে পুরোনো বইয়ের গাদা থেকে ছেঁড়া ছেঁড়া একটা বই পেলুম, ত্র্যটক সাধনা। তিন-চার হাত দূরে দেওয়ালের গায়ে সবুজ একটা বিন্দু লাগিয়ে, পদ্মাসনে বসে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাক, যেন চোখের পলক না পড়ে! পাঁচ সেকেন্ড, দশ সেকেন্ড, মিনিট, এক দুই পাঁচ দশ, ঘণ্টায় চলে যাও। তারপর দিনে।
‘তোমার চক্ষুর্দ্বয়ে জ্যোতি খেলবে। অলৌকিক দৃশ্যসমূহ চক্ষুর সম্মুখে ভাসিয়া উঠিবে। চরাচরে তোমার দৃষ্টি প্রসারিত হইবে। উড্ডীয়মান পক্ষীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাইলে ভস্ম হইয়া পড়িয়া যাইবে। যাহার দিকে তাকাইবে, সে-ই তোমার বশীভূত হইয়া কুক্কুর কুক্কুরীর ন্যায় পদপ্রান্তে পতিত হইবে, কম্পমান শাখার ন্যায়। ভজন করনা চাহি রে মনুয়া, সাধন করনা চাহি রে মনুয়া।’
সেই সাধনায় অ্যায়সা ফল ফলল! একদিন রাস্তা দিয়ে দুটি মেয়ে চলেছে। একটিকে মনে বড় ধরে গেল। মনে হল প্রেমের ধাত। সুখেন যেন বলেছিল, সর্দির ধাত, পেটের অসুকের ধাত। মিষ্টি, নরম নরম চেহারা। অবাক জলপানের মতো মুখ। মা দুর্গার মতো চোখ। ডুরে শাড়ি পরেছে। রাস্তায় যেন কাঁপন ধরেছে।
টাটকা গীতগোবিন্দ ভলকে ভলকে বেরিয়ে আসতে লাগল। হে সুন্দরী, তোমার নজরোঁকা তির ভুরুর ধনুর ছিলে টেনে অমন করে আর মেরো না। আমার মন ফেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তোমাকে দোষ দিচ্ছি না সখী! এ তো তোমার পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। তোমার কালো কুটিলকেশ আমাকে প্রায় মেরে ফেলেছে, এও স্বাভাবিক। তোমার বিশ্বফলতুল্য বাগযুক্ত অধর আমার মোহ উৎপাদন করছে, তাতেও দোষের কিছু নেই। কিন্তু তোমার ওই স্তনমণ্ডল কেন আমার প্রাণ নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলবে! আমি সইতে পারি, না বলা কথা, মন নিয়ে ছিনিমিনি সইব না, সইব না।
গীতগোবিন্দ আবৃত্তি করে ভীষণ সাহস এসে গেল। বল বীর নয়, তাকাও বীর। কীভাবে তাকিয়েছিলুম জানি না! একটি মেয়ে আর একটিকে বললে, দ্যাখ ভাই, পাগলটা তোর দিকে কীভাবে তাকিয়ে আছে! তারপর রাস্তায় ষাঁড় দেখে মেয়েরা যেভাবে হুটোপাটি করে পালায়, সেইভাবে দুজনে, গলাগলি, টলাটলি করতে করতে পালাল। একজনের পা থেকে চটি ছিটকে নর্দমায় পড়ে গেল। অনেক দূর গিয়ে তারা আর একবার ফিরে তাকাল ভয়ে ভয়ে। যেন দেখছে, যাঁড়টা কত দূরে!
মনে বড় ব্যথা পেলুম। আরও অবাক হলুম, সবাই যখন বলতে লাগল, চোখ রাঙাচ্ছ কেন? তোমার চোখরাঙানির আমরা তোয়াক্কা করি না হে! যার দিকে তাকাই তিনি একই কথা বলেন, চোখ পাকাচ্ছ কেন? মাথা ঠান্ডা করো, মাথা ঠান্ডা করো। গুরুজনের সঙ্গে কথা বলার সময় একটু সমীহ করে বলতে হয়।
বড় বৌদির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই চমকে উঠলুম, এ আবার কে রে! চোখ দেখলে মনে হয়, এখুনি গেয়ে উঠবে, ‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান।’ চোখের পাতা পড়ছে না, মণিদুটো পাথরের মতো স্থির। নিজেকে দেখে নিজেই ভয় পেয়ে যাচ্ছি। কান ধরে বলতে ইচ্ছে করছে, আর করব না স্যর!
চোখের ডাক্তার বললেন, এ কী করে এনেছ হে? একে বলে চোখ ঠিকরে যাওয়া। কী করে এরকম করলে হে? ভূত দেখলে এরকম হতে পারে। আমরা পড়ে এসেছি। দেখলুম এই প্রথম। তুমি বোসো, বোসো।
কথায় কথায় ডাক্তারবাবু জানতে পারলেন, আমার ত্র্যটক সাধনার ফল এই চোখ।
চোখ বাঁচাতে শুরু হল চোখের ব্যায়াম। চোখ ঘোরানো, চোখ নাচানো, চোখ পিটপিট, পাতা ফেলার আগে খোলা। সুখেন ঠিকই বলেছিল, চোখ বড় সাংঘাতিক জিনিস।