জাতীয়

রাম নাম সব নয় অযোধ্যার ভোটেও

রূপায়ণ ভট্টাচার্য, অযোধ্যা: জনস্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি রামপথে। রাম জন্মভূমিতে ঢোকার প্রধান গেটের ঠিক উলটোদিকে। মিনিটে মিনিটে ঘোষণা হচ্ছে, হারিয়ে যাওয়া মানুষের নাম। চেনা, অচেনা কতরকম জায়গার মানুষ হাজির। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, কুম্ভমেলার মতো কোনও মেলা।

সরযূ নদী থেকে ফৈজাবাদ পর্যন্ত এই রাজপথের নাম দেওয়া হয়েছে রামপথ। হনুমান গরহি পর্যন্ত শুধু মানুষের মাথা সেখানে। গেরুয়া রং, হলুদ রং। পাগড়ি হলুদ, চাদর গেরুয়া।

ফুটপাথে রামের নামে কত জিনিস যে বিক্রি হচ্ছে! বারো-তেরো রকম কৌটোয় রং নিয়ে ঘুরছে লোকে। বললে আপনার কপালে লিখে দেবে, জয় শ্রীরাম। রামলালার কত ছবি স্টলে স্টলে। সামান্য দূরে অযোধ্যাধাম স্টেশনে সব প্ল্যাটফর্মে সার দিয়ে বসে হাজার হাজার জনতা। বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরবে। এত ভিড়ে ট্রেন থেকে নামা কঠিন।

মন্দিরের পাশ দিয়ে যত বাড়ি, যত দোকান- সব বাড়ির মাথায় উড়ছে বিজেপির বড় বড় পতাকা।

সাত-আট কিলোমিটার দূরে ফৈজাবাদে সিভিল লাইন্সে বিজেপির প্রধান কার্যালয়ে বসে জেলা সম্পাদক বিশ্বেশ্বর পান্ডের গলায় হাসি, ‘এই যে সব রাম দর্শন করতে আসছেন, সবার ভোট কিন্তু কমল ফুলে যাবে। দিনে এক থেকে দেড় লাখ ভক্ত, বুঝতেই পারছেন।’ কোথা থেকে বেশি লোক আসছেন? প্রশ্ন থামিয়ে দেন মাঝপথে, ‘কোথাকার বলব, সব জায়গা থেকে আসছেন। তবে কেউ বিশ্বাস করবেন না যে, দক্ষিণ ভারত থেকে এখন বেশি লোক আসছেন। অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, তামিলনাডু।’

এই দপ্তর পুরোনো। উত্তরপ্রদেশে সব শহরে বিজেপি নতুন নতুন চোখধাঁধানো অফিস বানিয়েছে। ফৈজাবাদ লিখলাম ঠিকই, কিন্তু যোগী জমানায় মুছে দেওয়া হচ্ছে ফৈজাবাদের নাম। ৬ বছর আগে তিনি ফৈজাবাদ পালটে জেলার নাম করেছেন অযোধ্যা। শহরটাও এখন আস্তে আস্তে ভ্যানিশ হচ্ছে। তিন বছর আগে ফৈজাবাদ রেলস্টেশনের নাম হয়ে গিয়েছে অযোধ্যা ক্যান্ট। বাস স্টপও অযোধ্যা নামে। ফৈজাবাদ স্টেশন যাব বললে টোটোচালক অত্যন্ত বিরক্ত হন।

এমনিতে সেকেন্দ্রাবাদ-হায়দরাবাদ, হাওড়া-কলকাতা, কোচি-এর্নাকুলমের মতো যমজ শহর ছিল ফৈজাবাদ-অযোধ্যা। বড় বড় হোটেল, ব্যবসা সব ছিল ফৈজাবাদে। সেখানে বড় রাস্তা, অযোধ্যায় ছোট ছোট গলি। স্টেশন দৈত্যাকৃতি হতে পারে, এ সব তো পালটানো কঠিন। সেখানেই এখন বাড়িতেই তৈরি হয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট হোটেল, রেস্তোরাঁ। হোমস্টে’র অন্য রূপ। মালিক ফোনে কথা শুরু করছেন, ‘রাম রাম’ বলে।

অযোধ্যা থেকে ফৈজাবাদের প্রশস্ত রামপথের ধারে ধারে বাসস্ট্যান্ড। সেখানে দুজনের বিশাল ছবি- রাম এবং হনুমান। নানা রকমের গ্লোসাইন দুজনকে নিয়ে। রাস্তায় অধিকাংশ লোক দোকানের সাইনবোর্ডে ফৈজাবাদ মুছে অযোধ্যা লিখে ফেলেছেন। যাঁরা পালটাননি, তাঁরা বেশির ভাগ মুসলিম। ফৈজাবাদের পুরোনো এলাকায় মুসলিমদের বাস। সেখানে এখনও ফৈজাবাদ লেখা অধিকাংশ দোকানের গায়ে। ওখানেই আশ্চর্য সুন্দর স্মৃতিচিহ্ন হয়ে পড়ে আছে অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলার বিশাল সমাধি চত্বর। পরিচিত নাম গুলাববাড়ি। অসংখ্য গোলাপ বাগান বলে। কিছুক্ষণ আগে অযোধ্যায় দেখে এসেছি লক্ষ লোকের ভিড় আর এখানে জনা পাঁচেক প্রেমিক-প্রেমিকা এসেছেন তীব্র গরমে গাছের ছায়ায় আড্ডা দিতে। চরম বৈপরীত্য। সমাধিক্ষেত্র এএসআইয়ের অধীনে। তবে তেমন নিরাপত্তা নেই।

ফৈজাবাদের এই অঞ্চলটা চারদিকে নবাবি আমলের বহু প্রাচীন গেট দিয়ে ঘেরা। এখানে এলে মনে হয় অযোধ্যার বাইরে অন্য পৃথিবী যেন। রামের নামে দোকান কম। তিলক কাটা লোকও কম। মহম্মদ সোহেলের সঙ্গে সেখানে দেখা। পাশে সইফুদ্দিন। দুজনেরই কথা, ‘বিজেপি এখানে এগিয়ে। কিন্তু সপা প্রার্থী ভালো লড়াই দেবে। আমাদের এদিকে ‘ইন্ডি’ জোটের ভালো ইমেজ।’

যা দেখলাম, তাতে এবারই হয়তো শেষ নির্বাচন হচ্ছে, যেখানে কেন্দ্রের নাম ফৈজাবাদ। এবার সেটাও হয়তো অযোধ্যা হয়ে যাবে। মনে পড়ল, রামলালার পর সবচেয়ে আকর্ষণ হনুমান গরহির সামনে ব্যবসায়ী কেদার শর্মার মন্তব্য, ‘আগে অযোধ্যাকে টানত ফৈজাবাদ। এখন উলটোটা হয়েছে। পর্যটনের জন্য কত লোকের জীবন পালটে গিয়েছে বোঝাতে পারব না।’ সত্যিই তাই। ছোট ছোট বাড়িগুলোয় দিনে জনা সাত-আট পর্যটক হাজির হচ্ছেন। উদ্বোধনের চার মাস পরেও এমন উন্মাদনা অভাবনীয়। তবে আরেকটা তথ্য দেওয়া দরকার। অযোধ্যা যাতায়াতের বিমানসংখ্যা ইদানীং বেশ কমে গিয়েছে। সেই আগের ঢল নেই।

রাম জন্মভূমির লাইনে আরেকটা বিষয়ে চর্চা চলছে শুনলাম। এই মন্দিরে এখন শুধু রামলালার মূর্তি রয়েছে। এ বছরের মধ্যে নাকি দ্বিতীয়তলায় রাম-লক্ষ্মণ-ভরত-শক্রুঘ্নের সঙ্গে সীতা এবং হনুমানের মূর্তি বসবে। বালক রামের মূর্তির মতো রাম-লক্ষ্মণের মূর্তি হবে কর্ণাটকের কালো পাথরে। সীতা সহ বাকিদের মূর্তি হবে রাজস্থানের মকরানার শ্বেতপাথরে। ভক্তদের মধ্যেও মিশে যাচ্ছে উত্তর ও দক্ষিণ। তবে কথা বলে মনে হল, সব রামপ্রত্যাশী ভক্তরাই যে বিজেপিকে ভোট দেবেন, তা নয়। স্থানীয় ইস্যু একটা বড় ব্যাপার অনেকের কাছে।

রাম মন্দিরের পাশ দিয়ে নানা রকম দোকান। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়, ১৩ কিলোমিটার রামপথ গড়ার জন্য অযোধ্যায় একশোর বেশি দোকান ভাঙা পড়েছে। অনেকেরই ক্ষোভ, প্রত্যাশিত ক্ষতিপূরণ পাননি। সরকার ইচ্ছেমতো টাকা ধরিয়ে দিয়েছে। সেটা খুব কম। কারও দাবি ৭০ লক্ষ। পেয়েছেন হয়তো ১.১৪ লক্ষ।

ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন উঠল তো, অযোধ্যা বিধানসভার কথা ধরা যাক। দু’বছর আগে এখানে বিজেপির বেদপ্রকাশ গুপ্তের কাছে দ্বিতীয়বার হেরে গেলেও সমাজবাদী পার্টির তেজনারায়ণ পান্ডের ভোট বেড়েছিল ১৪.২ শতাংশ। বিজেপির ভোট কমেছিল ০.৫২ শতাংশ। ব্যবধান ৬০ হাজার থেকে দাঁড়ায় ১০ হাজার। লোকসভার হিসেবে যাই। ফৈজাবাদে বিজেপি ও এসপি’র মধ্যে ফারাক ছিল ৬.০৪ শতাংশ ভোটের। এসপি’র ভোট বেড়েছিল ২২.২১ শতাংশ, বিজেপির ০.৫৮ শতাংশ। পাঁচটি বিধানসভার মধ্যে একটিতে বিধায়ক ছিলেন সমাজবাদী পার্টির সম্পাদক অদেশ প্রসাদ। নয়বারের বিধায়ক, ছয়বারের মন্ত্রী অদেশই এবার বিজেপির হ্যাটট্রিককারী সাংসদ লাল্লু সিংয়ের প্রতিপক্ষ।

ফৈজাবাদে এসপি’র অফিসে সত্যেন্দ্র যাদব এই হিসেবগুলো শুনিয়ে বলছিলেন, ‘অযোধ্যাতেও শুধু রাম নামে ভোট হয় না।’ বিজেপি অফিসে আবার শুনলাম, সাফল্যের প্রধান অস্ত্রই হবে রাম জন্মভূমি। এই লাল্লু সিংই সংবিধান বদলের দাবি তুলে প্রথম বিতর্ক তৈরি করেছেন উত্তরপ্রদেশে।

অযোধ্যার অলিগলিগুলো দিয়ে যেতে যেতে রাম নাম শোনা যায় প্রায়। বাড়ি থেকে ভেসে আসে। ছোট ছোট দোকানগুলো থেকেও। রামপথ রাজপথের মতো প্রশস্ত। ভিতরের গলিগুলোতে কিন্তু এখনও গ্রামীণ ছাপ। রামপথে তীব্র রোদের মধ্যে শুয়েবসে কত লোক। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে এক এক দল চ্যাঁচাচ্ছে জয় শ্রীরাম। ফুটপাথে ক্লান্ত, অবসন্ন লোকেও তা শুনে পালটা বলছে ‘জয় শ্রীরাম।’ অনেকটা অভ্যাসের মতো। তাঁরা তো জানেন না, ফৈজাবাদ নাম মুছে দেওয়ার জন্য বহু লোকের ক্ষোভ, রামপথের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ না পেয়ে হিন্দু ব্যবসায়ীদেরও ক্ষোভ।

রাম নামই সব নয় অযোধ্যার ভোটে। হ্যাঁ মহাশয়, অযোধ্যার ভোটেও।

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Zika Virus | জিকার শিকার গর্ভবতী মহিলা! গত ১০ দিনে পুনেতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ৫

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: পুনেতে (Pune) আতঙ্ক বাড়াচ্ছে জিকা ভাইরাস (Zika virus)। এবার জিকা ভাইরাস…

20 mins ago

Bharatiya Nyaya Sanhita | ব্রিটিশ জমানার তিন আইন অতীত, নতুন ‘ন্যায় সংহিতা’য় দিল্লিতে দায়ের প্রথম FIR

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ১ জুলাই অর্থাৎ সোমবার থেকে সারা দেশে জারি হয়েছে ন্যায় সংহিতা-সহ…

29 mins ago

Hurricane Beryl | ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে হারিকেন বেরিল, চরম সতর্কতা বার্বাডোজ সহ ক্যারিবীয় অঞ্চলে

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ আটলান্টিক মহাসাগরে সৃষ্টি হয়েছে ঘূর্ণিঝড় ‘বেরিল’। বেরিল ক্রমশ ধেয়ে আসছে দক্ষিণ-পূর্ব…

38 mins ago

Jalpaiguri | পাননি স্বীকৃতি, পেটের টানে গান করেন বিশেষভাবে সক্ষম গণেশ

সুভাষচন্দ্র বসু, বেলাকোবা: আবেদন করে বৃদ্ধ ভাতা জোটেনি। তাই শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে পেটের টানে…

42 mins ago

সেলিম আর সুজনরা মনে করাচ্ছেন মায়াবতীকে

  রন্তিদেব সেনগুপ্ত লোকসভা ভোটের আগে একটা রব উঠেছিল, সিপিএম এবার ঘুরে দাঁড়াবে। সিপিএম নেতারা…

60 mins ago

Siliguri | কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিক্যাল বিষয়ক সমাবেশের প্রতিনিধি শিলিগুড়ির তরুণী

তমালিকা দে, শিলিগুড়ি: ছোট থেকেই স্বপ্ন ছিল গবেষক হওয়ার। সেই স্বপ্নপূরণ করতে তিনি পাড়ি দিয়েছেন…

1 hour ago

This website uses cookies.