সোমবার, ১৯ মে, ২০২৫

কপি পেস্ট গানে ক্লান্ত, তবে ভবিষ্যৎ ভালই

শেষ আপডেট:

  • সৌমিত্র রায়

বাঙালির দুই প্রেম নিঃসন্দেহে ভ্রমণ আর গান। সাহিত্য ইত্যাদি তারপর হয়তো। ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনটা বেশি পছন্দ ঠিক বলতে পারব না, তবে গান গেয়েই জীবনের সিংহভাগ সময়টা উপভোগ করেছি বিনা দ্বিধায় বলতে পারি। আর তার সুবাদে পৃথিবীর অনেক জায়গা দেখেছি, যেগুলো নিজে সীমিত ক্ষমতায় কিছুতেই দেখতে পেতাম না। হলেও অনেকগুলো জায়গা বাদ যেত নিশ্চয়ই।

আর যেখানেই যাই, গান কিন্তু চিরসঙ্গী। সে নতুন হোক বা পুরোনো। যেহেতু আমি নিজের কিছু গান গেয়েই জীবন কাটিয়েছি আর সংসার করেছি, বলতে পারি আমি বেশ সন্তুষ্ট। ভাবিনি আগে যে সেটা সম্ভব, কিন্তু তাই তো হল দেখছি।

তুলনা হবেই নবীন বনাম প্রবীণ যুগের গানের বিষয়ে। আমি কোনও বিশেষজ্ঞ নই, হতেও চাই না, তবে বলব যুগের সঙ্গে মানুষের সব কিছুতেই পরিবর্তন আসে। নিঃশব্দে। রুচির পরিবর্তন কী? না, তা ঠিক বলার অধিকার নেই আমার। তবে আজকের বাঙালি প্রজন্ম কেএল সায়গল, আব্দুল আলিম বা অমিয়া ঠাকুরের বাংলা গান শুনে গ্রহণ করবে কিনা বলা অসম্ভব। হ্যাঁ, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শচীনকর্তার গান আমার পুত্রও পছন্দ করে এবং শুনেছি গুনগুন করে গাইতে। এখানেই হয়তো রুচির ব্যাপারটা ফুটে ওঠে। ওদের কানে না পৌঁছোলে তারা শুনবেই বা কী করে?

যেমন আমি, দার্জিলিংয়ের স্কুলে পড়েও বরাবর বাংলা গান শুনে এসেছি বাড়িতে। জ্যাঠতুতো দিদিরা শান্তিনিকেতনের কলাভবনের ছাত্রী ছিলেন। তাদের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত এবং বাড়িতে শ্রীরামকানাইয়ের মন্দিরে কীর্তন খুব অল্প বয়স থেকেই কানে বেজেছে। বাড়ির উঠোনে রাধারানি দেবী, রথীন ঘোষ, সরস্বতী দাস, নিমাই ভারতী, হরিদাস কর এবং আরও অন্য বিশিষ্ট শিল্পীরা কীর্তন গেয়ে গেছেন। এই প্রজন্মের সুমন ভট্টাচার্য, সৃজন চক্রবর্তী, মানালি বসুরাও গেয়েছেন। পরিবেশের একটা প্রভাব তো পড়েই।

আর সত্যি বলতে এখনকার অধিকাংশ গান আমার পছন্দের নয়। সহজসরল ভাষা আর সুরে গান না হলে আমি চেষ্টা করি কানে না নেওয়ার। খুব ভালো গায়ক আর গায়িকারা তাঁদের গানের ডালি নিয়ে মঞ্চে ওঠেন, কিন্তু বেশিরভাগই সেই ৭০ বা ৮০ দশকের সিনেমার গান। নিজেদের মৌলিক গান ক’জন গান?

আমরা যাঁরা একই মঞ্চের সাইডে বসে অপেক্ষা করি গান গাইবার, সেই ‘কপি পেস্ট’ গান শুনে শুনে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। কোনও শিল্পীর নিজস্বতা যদি সেই গানের সুর না পালটিয়ে অন্যমাত্রা দিতে পারে খুব ভালো লাগে। শ্রোতারাও খুশি হন। আমাকেও বিভিন্ন শ্রদ্ধাঞ্জলির অনুষ্ঠানে গাইতে হয়। তখন আমি চেষ্টা করি আমার অন্তরের শ্রদ্ধা প্রকাশ করার। রবীন্দ্রসংগীতেও তাই। ভয় পাই গাইতে, কিন্তু আমার সৌভাগ্য যে বিভা সেনগুপ্ত, ইন্দ্রনীল সেন আর বিশেষ করে আমার ছোড়দি বাসবী দত্ত সাধুবাদ জানিয়েছেন গাইবার পর।

তবুও, বেশ কয়েকজন শিল্পী আছেন যাঁরা নিজস্ব রচিত গান গেয়েই মানুষের কাছে পৌঁছোতে পেরেছেন। গানের ধারায় বদল এসেছে অনেকের ক্ষেত্রে এবং এসরাজ-তবলার ব্যবহারকে আড়াল করে কীবোর্ড, হ্যান্ড সনিক ইত্যাদি স্টেজ দখল করেছে। আর সুর কোনও রাগের ওপর ভেসে থাকলেও, গায়কির ওপর নির্ভর করে গ্রহণযোগ্যতা।

তাহলে, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমার মতে বাংলা গানের ভবিষ্যৎ কী? যদি আমার মতামতকে গ্রাহ্য করেন তাহলেই বাকিটা পড়বেন। আমার মত প্রকাশের পর দয়া করে উত্তরবঙ্গ সংবাদকে প্রশ্ন করবেন না, আমার মতামত চেয়েছেন কেন!

এক কথায় ভালো। তার দুটো কারণ হল এখন গান গেয়ে জীবিকা অর্জন করে সুখে থাকা যায় আর দ্বিতীয়ত, অনেক নতুন গান সৃষ্টি হচ্ছে। কমবেশির প্রশ্ন নয়, রোজগার নির্ভর করে একান্ত শিল্পীর চাহিদার ওপর। বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ির প্রতি লোভ থাকলে মনে হয় নিজের রুচির সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করতে হয়। আলোর চমক আর ফ্যাশন প্রাধান্য পেয়ে অর্ধেক কাজ করে দেয়। না থাকলেই ভালো। নিয়মিত অল্প করে জমালেও একদিন দেখা যাবে ঘরগুলোকে আবার রং করার পয়সা জমেছে! বা ছোট করে নিজের পয়সায় সিকিম, পুরী ইত্যাদি ঘুরে আসা যাবে। তা মন্দ কী?

অনেকেই রবীন্দ্রসংগীতকেই বেছে নিয়েছেন। আমার ধারণা হাজার হাজার। কিন্তু নিজস্বতা না থাকলে জনগণ করতালি দিয়ে থেমে যাবে, মনে রাখবে না। তাই সবাই দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্তবাবু, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র হতে পারেননি। কিন্তু খেয়াল করবেন আজকের জয়তী, শ্রাবণী, লোপামুদ্রা, মনোজ মুরলীরা আপন গায়কির পরিচয় নিয়েই নিজেদের স্থাপিত করেছেন। কোনও সংগীত অনুষ্ঠানে তাঁদেরকে সসম্মানে আমন্ত্রণ জানানো হয়, সময় ভর্তি করার জন্য নয়।

কষ্ট হয় শুধু কণ্ঠি শিল্পীদের জন্য। একজন বিখ্যাত প্রবীণ কিশোর কুমার কণ্ঠি আমাকে দুঃখ করে বলেছিলেন একটি অনুষ্ঠানের আগে গ্রিনরুমে ‘‘তুই তো নিজের গান গাইবি সোমু, আমাকে আগে স্টেজটা নিতে দে। আমি তো কণ্ঠি হয়ে রয়ে গেলাম’’! দুর্দান্ত কয়েকজন তরুণ গায়কদের রেগুলার শুনি যারা মান্নাবাবুর ‘বাজে গো বীণা’ আর অনেক অন্য গান অসাধারণ গায়। তবলার কম্বিনেশন শুনে আসর জমজমাট। কিন্তু পরের গান গেয়ে বিখ্যাত হওয়া আর নিজের গানের মেজাজে মানুষের মন জয় করার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। স্যাটিসফেকশন লেভেলটা আলাদা। তবুও আমি ব্যক্তিগতভাবে সকল তরুণ-তরুণী শিল্পীদের হাতজোড় করে বলি ‘‘প্লিজ তোরা নিজেদের গান গা। লেখ, সুর কর! তোদের নিজেদের ভালো লাগবে।’’

Sabyasachi Bhattacharya
Sabyasachi Bhattacharyahttps://uttarbangasambad.com/
Sabbyasachi Bhattacharjee Reporter based in Darjeeling district of West bengal. He Worked in Various media houses for the last 23 years, presently working in Uttarbanga Sambad as Sr Sub Editor.

Share post:

Popular

More like this
Related

সরকারি চাকরি মানেই শান্তির জীবন নয়

মানসী কবিরাজ অ্যালবামের পাতা ওলটালেই দেখা যাবে  আমাদের প্রায় ...

কবিতা

১ অ-কৃতজ্ঞ সোমা দে সভ্যতার ভেতরে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বর্বরতা শরীর থেকে...

সোনার সংসার, যুদ্ধের সংসার

অরিন্দম ঘোষ বাংলায় ‘সোনার-সংসার’ বলে একটা শব্দবন্ধ আছে। এই...

গুজরাট যখন বাংলাকে মনে করায়

দেবদূত ঘোষঠাকুর  সম্প্রতি গুজরাটের পশ্চিম উপকূল ধরে ঘুরে একটা...