ইউরোপের ক্লাব ফুটবল ছেড়ে সৌদি আরবে পাড়ি দিয়েছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, কাতার বিশ্বকাপের এক সপ্তাহ পর, ২০২২-এর ডিসেম্বর শেষে। তার মাস ছয়েক পর প্যারিস সাঁ জাঁ (পিএসজি) ছেড়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছিলেন লিওনেল মেসিও, ২০২৩-এর জুলাই মাসে।
দুজনেই দিব্য আছেন। ক্রিশ্চিয়ানো এবার সৌদি আরবের লিগে আল নাসেরের হয়ে সর্বোচ্চ ৩৫ গোল করেছেন, মেসির আপাতত ১২ ম্যাচে ১২ গোল এমএলএস-এ। সমস্যা বেড়েছে ইউরোপে। দুজনকে হারিয়ে ইউরোপের ক্লাব ফুটবল আকর্ষণ হারিয়েছে, জানাচ্ছে টেলিভিশনের টিআরপি।
মেসির সঙ্গে অবশ্য সরাসরি সম্পর্ক নেই ইউরোর। তবে এবারই প্রথম ক্রিশ্চিয়ানো খেলবেন ইউরোয়, অ-ইউরোপীয় ক্লাবের ফুটবলার হিসাবে।
কিন্তু ইউরোপের ক্লাব ফুটবল দুজনের অনুপস্থিতিতে বদলেছে বেশ খানিকটা। সরে আসতে বাধ্য হয়েছে তারকা নির্ভরতা থেকে। স্বাভাবিক, মেসি-রোনাল্ডোর জায়গা রাতারাতি কেন, ভরাট করা অসম্ভব বলেই। সেই যে ২০২১-এ বার্সেলোনা ছেড়েছিলেন মেসি, এখনও সেই ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি কাতালান ক্লাব। রিয়াল মাদ্রিদ অবশ্য রোনাল্ডোকে ছাড়াও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতছে, জিতেছে এবারও। নতুন তারকা হিসাবে স্পেনের রাজধানীতে উঠে এসেছেন ব্রাজিলীয় ভিনিসিয়াস জুনিয়ার। ক্রিশ্চিয়ানোর ইউরোপে শেষ ক্লাব ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড অবশ্য সেই তিমিরেই, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জায়গা পায়নি সদ্যসমাপ্ত ইপিএল-এ অষ্টম স্থান নিয়ে।
ইউরোপের ফুটবল বরাবরই শৃঙ্খলার পূজারি ছিল, ক্লাব হোক বা দেশ। ক্লাবে তবুও দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলাররা এসে বারবার ভরকেন্দ্র বদলে দিয়েছিলেন, দেশের খেলায় যা সম্ভব নয়। তবুও ফেরেঙ্ক পুসকাস (হাঙ্গেরি), ফ্রানজ বেকেনবাওয়ার (পশ্চিম জার্মানি), জোহান ক্রুয়েফ (নেদারল্যান্ডস), মিশেল প্লাতিনি ও জিনেদিন জিদান (ফ্রান্স), লোথার ম্যাথাউস (জার্মানি), পাওলো মালদিনি (ইতালি) এবং অবশ্যই রোনাল্ডো, ফিগো, ইউসেবিও (পর্তুগাল) এসেছেন যুগে যুগে, যাঁদের পায়ে শৃঙ্খলার বেড়ি পরেনি বলে ইউরোপীয় ফুটবলও দর্শককে দিয়েছিল দৃষ্টিসুখ।
সেই ধারা ধরে রাখতে ক্রিশ্চিয়ানোর পাশে, বলা ভালো, ক্রিশ্চিয়ানোর চেয়েও এই মুহূর্তে এগিয়ে অবশ্যই কিলিয়ান এমবাপে। সেরা ছন্দে আছেন। বিশ্বকাপ জিতে ফেলেছেন একবার, দ্বিতীয়বার পৌঁছেছিলেন ফাইনালে এবং হ্যাটট্রিক করেও দলের হার বাঁচাতে পারেননি। দেশের জার্সিতে প্রতিষ্ঠিত, এবারের ইউরোর সেরা সম্ভাবনার বয়স মাত্র পঁচিশ। তাঁর জন্যই ফ্রান্স এবারও তুমুল ফেভারিট। ক্রিশ্চিয়ানো-উত্তর ইউরোপ আবর্তিত তাঁকে ঘিরেই, আগামী মরশুমে রিয়াল মাদ্রিদে খেলবেন বলে আরও বেশি চর্চার কারণও হবেন।
কিন্তু, এমবাপে এখন আর নতুন তারকা নন! ছোটবেলার আদর্শ ক্রিশ্চিয়ানোর ক্লাবে গিয়ে ভিনিসিয়াস জুনিয়ার-রডরিগোদের পাশে নিয়ে নতুন কী করেন দেখতে অপেক্ষায় থাকবে ফুটবল বিশ্ব যেমন, ইউরোপ এবার দেখতে চাইছে, দেশের এক নম্বর তারকা হিসাবে তাঁর পারফরমেন্স, ইউরোয়। বিশ্বকাপের রেপ্লিকা ঘরে থাকলেও ইউরোর নেই। গতবার করিম বেঞ্জিমা সঙ্গে তাঁর জুটি ঘিরে স্বপ্ন দেখেছিলেন দিদিয়ের দেশঁ। এবার বেঞ্জিমা নেই, তিনকাঠির তলায় উগো লোরিসও অবসরে। আতোয়াঁ গ্রিজম্যানের অভিজ্ঞতা, এন’গোলো কান্তের শৃঙ্খলা আর এমবাপের দক্ষতায় ভরসা রেখে তৃতীয়বার ইউরোপ-সেরা হওয়ার লক্ষ্যে ফরাসিরা।
ইউরো ২০২৪ তাই আনকোরা নতুন তারকাদের। পুরোনোরা থাকছেন। ক্রিশ্চিয়ানোর মতোই জার্মানির টনি ক্রুজ, ম্যানুয়েল ন্যুয়ের, ক্রোয়েশিয়ার লুকা মডরিচরা খেলবেন শেষবার। হয়তো কেভিন ডি ব্রুয়েনও। এবারের ইউরো তাই জন্ম দেবে নতুনদের, ক্লাব ফুটবল থেকে জাতীয় ফুটবলে যাঁরা নিজেদের জাত চেনাবেন।
এই তালিকায় সবার আগে নাম অবশ্যই ইংল্যান্ডের ফিল ফডেনের। ম্যাঞ্চেস্টার সিটিতে ম্যানেজার পেপ গুয়ার্দিওলার প্রশিক্ষণে যিনি উঠে এসেছেন সেরাদের মধ্যে সেরা হিসাবে। গোল করেন, প্রয়োজনের মুহূর্তে গোলের পাসও বাড়ান, অংশ নেন রক্ষণে, বাঁ পা দারুণ। রিয়াল মাদ্রিদে খেলছেন বলে জুডে বেলিংহামকে নিয়েও ইংরেজ প্রচারমাধ্যম যারপরনাই উচ্ছ্বসিত। যদিও, দক্ষতার প্রশ্নে বেলিংহ্যামকে পেছনেই থাকতে হবে ফোডেনের।
অধুনা ইউরোপীয়, বলা উচিত উত্তর ইউরোপীয়, ক্লাব ফুটবলেও ঝোঁক পাসিং ফুটবলে। গুয়ার্দিওলার বার্সেলোনাও যা পারেনি, গুয়ার্দিওলার বায়ার্ন এবং ম্যাঞ্চেস্টার সিটির পথ ধরে এখন ইংল্যান্ডও বুঝতে শিখেছে হেলিকপ্টারমুখী ফুটবলের মাধ্যমে আর যাই হোক না কেন, ফুটবলের উন্নতিসাধন সম্ভব নয়। গ্যারেথ সাউথগেট কোচ হয়ে আসার পরই দেশের ফুটবলের সব স্তরে একভাবে পাসিং এবং পজেশনাল ফুটবল অনুসরণের নির্দেশ দেওয়ায় ইংল্যান্ডের ফুটবলও পালটেছে। শেষবার ইউরোর ফাইনালে পৌঁছেছিল, বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালেও, যেখানে অধিনায়ক হ্যারি কেন পেনাল্টি থেকে গোল করতে না পারায় ছিটকে যেতে হয়েছিল ফ্রান্সের কাছে হেরে। দেশের কাগজে সমালোচনা সত্ত্বেও জ্যাডন স্যাঞ্চোকে দলে রাখেননি সাউথগেট। ফোডেন-বেলিংহাম জুটিকে নিশ্চিন্তে খেলতে দেবেন বলে। শিকে কি ছিঁড়বে এবার ইংল্যান্ডের? ইউরো খেতাব কিন্তু একবারও যায়নি ‘ইংল্যান্ড-ঘর’!
জার্মানির তিন ফুটবলার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে রাখতে পারেন। জামাল মুসিয়ালা (বায়ার্ন মিউনিখ), ফ্লোরিয়ান রিৎজ (বেয়ার লেভারকুসেন) ও কাই হাভার্জ (আর্সেনাল)। শেষ তিনটি জাতীয় প্রতিযোগিতায় জার্মানির পারফরমেন্স একেবারেই জার্মানিসুলভ নয়। ২০১৮ এবং ২০২২-এর বিশ্বকাপের মাঝে ২০২১-এর ইউরো। ‘৯০ মিনিট মাঠে লড়াইয়ের পর জেতে জার্মানরাই’, গ্যারি লিনেকারের সেই অমোঘ উক্তির প্রতিফলন এই তিন টুর্নামেন্টে পাওয়া যায়নি। ন্যুয়েরও টমাস মুলার ছাড়া ২০১৪-র বিশ্বজয়ী দলের আর কেউই নেই। সরলরৈখিক ফুটবল থেকে সরে এসে পাসিং ফুটবলের রাস্তায় দৌড়োতে শুরু করা ২০১৪-র জার্মানির সেই দলের তুলনায় এখনকার ফুটবলাররা দক্ষতায় পিছিয়ে থাকলেও, রাস্তা বদলাননি। উক্ত তিন উঠতি প্রতিভার সঙ্গে জোশুয়া কিমিচ ও ইকায় গুন্দোগানের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে জুলিয়ান নাগেলসম্যানের দল আবারও চমক দেখালে অবাক হবেন না।
ক্রিশ্চিয়ানো আর পেপের বয়সের যোগফলে ‘লেটার’ পাচ্ছে পর্তুগাল! রবার্তো মার্টিনেজের দল কিন্তু খাতায়-কলমে বেশ ভালো, ট্রফি জেতারও দাবিদার। তিন বিভাগেই নেতা মজুত দলে। ডিফেন্সে পেপের পাশে রুবেন দিয়াজ, জোয়াও ক্যান্সেলো; মাঝমাঠে বার্নার্ডো সিলভা, ব্রুনো ফার্নান্ডেজের সঙ্গে ড্যানিলো এবং ভিটিনহা; জোয়াও ফেলিক্স, দিয়োগো জোটার মতো উত্তেজক প্রতিভাদের সঙ্গে ক্রিশ্চিয়ানোকে জুড়লে এই দলের পাশে ফ্রান্স ছাড়া সবাই বেমানান। কাতার বিশ্বকাপে যেভাবে মেসিকে খেতাব দিতে মরিয়া হয়েছিল আর্জেন্টিনা, এই পর্তুগালের ফুটবলাররাও যদি তেমন লক্ষ্য সামনে নিয়ে প্রতিটি ম্যাচে উজাড় করে দেন নিজেদের, ক্রিশ্চিয়ানোর হাতে আরও একবার উঠতেই পারে ইউরো। মার্টিনেজ অবশ্য মাঝমাঠ মজবুত রেখে আক্রমণে যাওয়ার রাস্তা খোঁজেন। তাই ৪-৩-৩ পছন্দ নয়, ৪-৩-২-১ বেছে খেলবেন। গঞ্জালো র্যামোস বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক পেলেও প্রথম এগারোয় জায়গা পাবেন না ইউরোয়, ফেলিক্স এবং জোটার কারণে। প্রথম এগারো বেছে নেওয়ার মাথাব্যথাও মার্টিনেজের মতো অন্য কোচদের নেই!
ছকের প্রশ্নেও ইউরোপে এবার ৪-৩-৩ এগিয়ে থাকবে, বিশেষ করে বড় দলগুলোর খেলায়। তুলনায় খানিকটা পিছিয়ে থাকা দলগুলো রক্ষণে বাড়তি জোর দেবে মাঝমাঠেও, তুলে আনবে ৪-৩-২-১ বা ৪-২-৩-১। রক্ষণাত্মক কৌশল হিসাবে যে ছকগুলির গ্রহণযোগ্যতা সর্বজনবিদিত। তিন স্টপারকে মাঠে রেখে দুই সাইডব্যাককে ওপরে তুলে দেওয়া, মাঝে আবার দুই মিডফিল্ডারের ওপরে আরও তিনজন আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারকে রেখে এক স্ট্রাইকারে খেলার নিয়মও জনপ্রিয়তা পেয়েছে, মূলত রক্ষণ জোরদার থাকায়।
স্পেন অবশ্য তাদের গত দু’দশকের ৪-৩-৩ ছকেই ভরসা রাখবে বেশ কয়েকজন উত্তেজক প্রতিভা পেয়ে। কিন্তু স্পেনের আসল সমস্যা গোল করায়। কোনও ম্যাচে বিরাট ব্যবধানে জিতে গেলেও সেই ধারাবাহিকতা বারবারই ব্যাহত হয়েছে সাম্প্রতিক অতীতে। তাই লুই দে লা ফুয়েন্তের দলে লামিনে ইয়ামালের মতো ছটফটে তরুণ এবং রড্রি-পেদ্রিরা থাকা সত্ত্বেও ফেরান তোরেস-আলবারো মোরাতার গোলমুখে ব্যর্থতার ধারা না বদলালে আবারও দারুণ পজেশনাল ফুটবল খেলে ফিরতে হতে পারে শূন্যহাতে।
ইউরোপীয় প্রতিযোগিতা এবং গতবারের চ্যাম্পিয়ন হওয়া সত্ত্বেও ইতালি আলোচনায় নেই, ভেবে নেওয়া কঠিন হলেও অসম্ভব নয় এখন। পরপর দুটি বিশ্বকাপে যারা যোগ্যতার্জন করতে পারেনি, চারবারের বিশ্বজয়ী হলেও তাদের ঘিরে আকর্ষণ কমতে বাধ্য। নতুন ইতালীয়রা নিজেদের চেনাতে পারবেন কি এবার জার্মানিতে?
আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে তাই এবারের ইউরোতেও সেই রোনাল্ডো এবং এমবাপে!
(লেখক সাংবাদিক, বীরপাড়ার ভূমিপুত্র)
আসানসোল: রাজ্য জুড়ে বেআইনি জবরদখল নিয়ে বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) নবান্নে আরও এক…
কোচবিহার: নিট (NEET) ও নেট (NET)-এ দুর্নীতির অভিযোগে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান (Dharmendra Pradhan) ও…
ঘোকসাডাঙ্গা: বিজেপির সংখ্যালঘু নেত্রীকে বিবস্ত্র করে মারধরের অভিযোগ উঠল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। মাথাভাঙ্গা ২ ব্লকের ঘটনা।…
রায়গঞ্জ: এক গৃহবধূকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল বলে প্রতিবেশী দু’জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ। ঘটনায় রায়গঞ্জ থানায়…
হরিশ্চন্দ্রপুর: এক তরুণীর অশ্লীল ছবি ভাইরাল করার অভিযোগ ঘিরে উত্তেজনা ছড়ালো। জানা গিয়েছে, হরিশ্চন্দ্রপুরের (Harishchandrapur)…
হরিশ্চন্দ্রপুর: দীর্ঘদিন ধরেই প্রধান শিক্ষক এবং সহকারি শিক্ষকদের মধ্যে মিড-ডে মিল (Mid Day Meal) নিয়ে…
This website uses cookies.