উত্তর সম্পাদকীয়

হলং বাংলোয় যখন দিনের পর দিন একা

  • বিমল দেবনাথ

হলং বনবাংলো জ্বলছে! বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।

১৮ জুন রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে এক পুরোনো সহকর্মী একটা সোশ্যাল মিডিয়ার লিংক হোয়াটসঅ্যাপ করে। লিংকে আঙুল ছোঁয়াতেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। চোখের সামনে এ কী দেখছি!

মাঝেমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়া কত কী আজবগুজব ছড়ায়। কোথাকার বাঘের ছবি বক্সা, জলদাপাড়া, গরুমারা বলে চালিয়ে দেয়। হলফ করে বলতে পারি যাঁরা হলং বাংলোতে এসেছেন, তাঁরা কেউ খবরটা শুনে প্রথমে বিশ্বাস করেননি। সবে দু’দিন হল রাজ্যের সব অভয়ারণ্য, জাতীয় উদ্যানগুলো পর্যটকদের জন্য দরজা বন্ধ করেছে। দু’দিন আগে পর্যন্ত যে বাংলো নির্বিঘ্ন  পরিষেবা দিল, তার এমন কী হল যে আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হবে!

চোখ কচলে আবার দেখলাম ভিডিওটা। না, গুজব নয়। এ যে চরম সত্য। এই তো সেই কাঠের তিনতলা বাড়িটা।  সেই রাস্তাটা হাতির পিঠে ওঠার জায়গা থেকে সোজা চলে দিয়েছে বাংলোর দিকে। রাস্তাটা বাংলোর বজরি ছেটানো উঠোনে মিশে যাবার আগে ডান হাতের সবুজ ঘাসের লনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রোপণ করা জাম গাছটা ঠায় দাঁড়িয়ে। হয়তো আগুনের তাপে ঝলসে যাচ্ছে পাতা। ওই তো বজরি ছেটানো রাস্তাটা থুজা গাছের সারির মধ্যে দিয়ে সোজা চলে গিয়েছে হলং ঝোরাতে। এই ঝোরা একটু বয়ে মিশে গিয়েছে হলং নদীতে।

বাংলোটা এখনও প্লাস্টার করা পিলারের উপর দাঁড়িয়ে মাথায় আগুন নিয়ে। এই তো সেই বাংলোর সামনের বড় শিমুল গাছটা, যার দুই পাংখার মধ্যে দাঁড়িয়ে অনেকে ফোটো তোলে।  ওই তো রেলিং দেওয়া প্যাসেজটা, যেটা দিয়ে রান্নাঘর লাগোয়া ডাইনিং হলে যেতে হয় খেতে। যাবার সময় কত পর্যটক থ মেরে দাঁড়িয়ে পড়ত। ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা। নীচে হাতের নাগালে মস্ত গন্ডার ঘাস খাচ্ছে। শব্দ শুনে যদি উঠে আসে। ওই তো সিঁড়ির ডান দেওয়ালে সেঁটে আছে মস্ত এক তক্ষক।  যার বড় বড় চোখ জ্বলজ্বল করছে।

সিঁড়ির শুরুতে ওই তো রিসেপশন রুম, যেখানে পর্যটক বসে রেজিস্টারে নাম, ঠিকানা লেখে। ফেরার সময় হলং-এ থাকার অভিজ্ঞতা লেখে। একদিন এই রিসেপশনে দেখছিলাম এক পর্যটক কবি জীবনানন্দকে নকল করে লিখছেন- ‘আবার আসিব ফিরে হলং নদীটির তীরে – এই বাংলোয় হয়তো মানুষ নয় টিকটিকি তক্ষকের বেশে…’। আর এক দিন আর এক পর্যটক লিখছেন- ‘বাবা, সেবার দুটো রুম পাওনি বলে আমাকে আনতে পারোনি, আজ আমি এসেছি। তোমার কথা বলাতে বাংলোর কর্মীরা তোমাকে চিনতে পেরেছেন। ওঁরা কী ভালো! তোমার লেখা মন্তব্য পড়েছি। জলদাপাড়ার বন ও বন্যপ্রাণী নিয়ে কী সুন্দর লিখেছ। তোমার লেখার উপর হাত বুলিয়েছি।  তুমি যে ঘরটাতে ছিলে সেই ঘরটাতে আমাকে থাকতে দিয়েছিল। তুমি এখন না থাকলে কী হবে, সারাক্ষণ আমি তোমার গন্ধ পেয়েছি। তুমি যদি অন্য কোনও বেশে আসো কোনওদিন, আমার লেখাটি পড়ো।’

সব রেজিস্টার তো রিসেপশন রুমে রাখা। ওই তো  বাংলোর বাইরের দেওয়াল সেঁটে লাগানো টিনের বোর্ডটা। যেখানে লেখা আছে রুশ প্রাণী বিশেষজ্ঞ, ইউরি দিমিত্রিয়েভ-এর বার্তা- ’…আপনি কিছু দেখতে পেলেন না বটে…অনেকগুলি চোখ আপনাকে দেখছে…’।

আগুনের দাপটে ঘটনার কালানুক্রম ভুলে গিয়েছি। কী আগে দেখব কী পরে দেখব সব ভুলে গিয়েছি। আর আগুনের ছবি দেখতে ভালো লাগছে না। চোখ বন্ধ করলাম। বুঝতে পারি না, কেন অতীত আমার পিছন ছাড়ে না। অবসরগ্রহণ করেছি প্রায় দু’বছর হতে চলল। তবুও মনে হচ্ছে এখনও অনেক চোখ আমাকে দেখছে। হয়তো কিছু পশু, কিছু মানুষের।

আমি  প্রথম হলং বাংলো দেখি ১৯৯১ সালে। তখন থেকে এখনও পর্যন্ত বাংলোর বাইরের আদল একই ছিল। এই বাংলো গরুমারা, চাপড়ামারির মতো ব্রিটিশদের তৈরি নয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী ১৯৬৭ সালে বাংলোটা তৈরি হয়। তখনও রাজ্যে বা দেশে ১৯৭২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন চালু হয়নি। স্বাভাবিকভাবে বন্যপ্রাণীর ঘরের কাছে মানুষের ঘর বানাতে অসুবিধা হয়নি।

পরে ২০১৪ সালে যখন সরাসরি জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের দায়িত্ব পেলাম, এত দিনের অভিসার পর্ব শেষ হয়। বিদায়ি অফিসারের  যথার্থ কিছু কারণে সরকারি আবাস ছাড়তে দেরি হওয়াতে অনেকদিন থাকতে হয়েছিল এই বাংলোতে। সেসময়ও জাতীয় উদ্যান বন্ধ ছিল।  পুরো তিনতলা বাড়িটাতে একা। একা বলা ভুল। সঙ্গে ছিল অনেক তক্ষক আর রাতের পর্যটক ভাম। মাঝেমধ্যেই বাড়ি মটমট করত। ভয় না পেলেও হরমোনের তাড়নায় রোম খাড়া হয়ে যেত। এমনিতেই গন্ডার শিকারিদের উপদ্রবে উপদ্রুত ছিলাম। চোখে  ছিল না ঘুম, মনে ছিল না শান্তি। সে এক অসহ্য রোমাঞ্চ। যাঁরা ঘুরতে আসেন, তাঁদের রোমাঞ্চ আরামদায়ক। আর যারা দায়িত্ব নিয়ে জলদাপাড়া আসি, তাদের রোমাঞ্চ খাদের পাশে হাঁটার মতো।

বাংলোটা কি প্রথম থেকে একই রকম ছিল? খোঁজের স্রোতে ভর করে পেয়েছিলাম বাংলো তৈরির কাঠমিস্ত্রি দেবেন বিশ্বশর্মাকে। তাঁর কথা অনুযায়ী প্রথমে বাংলোটা ছিল উত্তরবঙ্গের কাঠের দোতলার ঘরের মতো। নীচটা ফাঁকা।  ইটের খুঁটির উপর কাঠের পাটাতন বা মেঝে। কাঠের দেওয়াল ও ঢেউ খেলানো টিনের ছাউনি। মোট চারটা রুম ও একটা ডাইনিং হল। রান্নার ঘর ছিল আলাদা, এখনকার রান্নাঘরের কাছে। ওর অনুমান ১৯৮০ সালে বাংলোটা বর্তমান রূপ পায়, যেটা পুড়ে গেল। দোতলা বাংলো তিনতলা হয়। নীচতলা ফাঁকা। দোতলায় চারটা রুম ও একটা হল। তিনতলাও তাই।

কলেবরে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে বাংলোর অস্মিতা। বাংলোর গরিমা বাড়তে থাকে সম্মাননীয় অতিথিদের আগমনে। এই বাংলোতে থেকে গিয়েছেন জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই বাংলো দেখে গিয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।  থেকে গিয়েছেন রাজ্যের ও ভিন্ন রাজ্যের রাজ্যপাল। এই বাংলোকে বারবার মহিমান্বিত করেছেন রাজা। বাংলোর অলিন্দ উষ্ণ করে গিয়েছেন সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ, সমরেশ মজুমদার, পরিচালক তরুণ মজুমদার, অভিনেতা তাপস পাল, দেবশ্রী রায়, অঞ্জন দত্ত, সব্যসাচী চক্রবর্তীরা।

সাধারণের অনেকে এই একটা রাত এই বাংলোর অলিন্দে থাকার জন্য অপেক্ষা করেছেন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। যাঁরা এই বাংলোয় থেকেছেন, তাঁদের স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছে এক নম্বর রুমের লাল চেয়ার দুটো, দুই নম্বর রুমের ছোট ছোট কাঠের ঠুকরোর মেঝে, চার আর ছয় নম্বর রুমের গোপনীয়তা, তিন, পাঁচ ও সাত রুমের জানলা আর উন্মুক্ত প্রান্তর। হলে বা রুমে বসে স্পষ্ট হাতি, গন্ডার গৌর, হরিণ দেখার উত্তেজনা। চাপরাশির ভয় মিশ্রিত সতর্কবাণী- না ওই দিকে যাবেন না…ইত্যাদির কত স্মৃতি।

শুধু কি বনের রোমাঞ্চ? এই  বাংলোয় একটা রাত কি মনের জেলখানা থেকে বের করে আনেনি কবেকার পচাগলা মান-অভিমান? দুটো মন এক হয়নি কি আবার?  সবকিছুর সাক্ষী এই বাংলোর বিছানা, আসবাবপত্র, কাঠের দেওয়াল।  আসলে লক্ষ লক্ষ মানুষের লক্ষ লক্ষ স্মৃতি জড়িয়ে এই বাংলোর প্রতিটা কাঠে। এটা নিশ্চিত, যাঁরা বাংলোর পুড়ে যাবার খবর পেয়েছেন, তাঁদের মনে জ্বলজ্বল করে উঠেছে বাংলোটা। কাঠের বাংলোটা পুড়ে গেলেও মনের বাংলোটা চির ভাস্বর হয়ে থাকবে সবার মনে এবং থাকবে অসংখ্য ফোটোগ্রাফিতে – দেশে এবং বিদেশে। নানা স্মৃতি জড়িয়ে থাকবে কর্মচারী ও আধিকারিকদের মনেও।

বনে একটা কথা প্রচলিত আছে- প্রথমে ফরেস্টার বাংলো বানায়, পরে বাংলো ফরেস্টার বানায়। তাই বনবাংলোর সঙ্গে বনের সব কর্মী, আধিকারিকদের আত্মার যোগ। লক্ষজনের স্মৃতির বাহক বনবাংলো বনের কর্মীদেরও স্মৃতির বাহক। তাই লক্ষজনের স্মৃতির ধারক এই বাংলোকে দীর্ঘদিন ধরে রক্ষা করে আসছেন বাংলোর কর্মীরা। কিন্তু কথায় আছে না, নিয়তির মার জগতে বার। তাই হয়তো হার মানতে হয়েছে আগুনের কাছে।  তবে স্মৃতি মরে না। হলং বনবাংলো লক্ষজনের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে জীবিত সত্তার মতো। আবার যখন হলং বনবাংলো নতুন করে একই ঢংয়ে গড়ে উঠবে তখন আবার হবে স্মৃতিচারণ। পুড়ে যাওয়া বাংলো আবার ফিনিক্স পাখির মতো বেঁচে উঠবে। তবে আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে অন্য বনবাংলোগুলো নিয়ে। সেগুলোও স্মৃতির আকর।

(লেখক প্রাক্তন বনকর্তা। জলদাপাড়ার দায়িত্বে ছিলেন দীর্ঘদিন)

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: সালিশি সভার নামে তালিবানি অত্যাচার! বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জেরে যুবক যুবতীকে বেধড়ক…

42 seconds ago

Elephant Attack | ঘুম ভাঙতেই চোখের সামনে শুঁড় দোলাচ্ছে দাঁতাল! পালিয়ে প্রাণে বাঁচলেন দুই কর্মী

ময়নাগুড়ি: গভীর রাতে রিসর্টে হানা দাঁতালের (Elephant Attack)। কোনওক্রমে পালিয়ে প্রাণে বাঁচলেন দুই কর্মী। রিসর্টের…

1 min ago

Coochbehar | রাত কাটতেই ভোলবদল! তৃণমূলে যোগ দিয়েই সকালে বিজেপিতে ফিরলেন পঞ্চায়েত সদস্য

অমিতকুমার রায়, হলদিবাড়ি: মাঝখানে ব্যবধান কয়েকঘণ্টার। বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়ে ফের ফিরলেন পুরোনো দলেই।…

10 mins ago

Rohit Sharma | ‘ফাইনালে নার্ভাস ছিল, আগের রাতেও ঘুমোতে-খেতে পারিনি’, বললেন রোহিত শর্মা

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ রোহিতের হাত ধরে টি২০ বিশ্বকাপের ট্রফি ঘরে তুলল ভারত। গত সাত…

13 mins ago

বাড়িতেই বানাতে পারেন ভেষজ সিঁদুর, জানুন প্রণালী

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: সিঁদুর ব্যবহার করার আগে তার গুণমাণ যাচাই করে নেওয়া ভাল। বাজারে…

50 mins ago

Mann Ki Baat | ‘গণতন্ত্রে বিশ্বাসের জন্য ধন্যবাদ’, তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে প্রথম ‘মন কি বাত’ মোদির

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ফের শুরু হল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির (PM…

51 mins ago

This website uses cookies.