বারাণসীতে দশাশ্বমেধ ঘাটে চলছে বিশ্বখ্যাত সন্ধ্যারতি। মাঝগঙ্গা থেকে নৌকো, লঞ্চগুলো সব ঘাটের দিকে এগোচ্ছে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। মাঝনদী থেকে আরতি দেখবে। ওই সময় হঠাৎ উলটোদিকে সম্পূর্ণ নিঃশব্দে তিনটে বড় নৌকো পরপর এসে দাঁড়াত।
প্রথমটিতে আলোয় জ্বলছে মোদির মুখ। তৃতীয় নৌকোয় আলোয় ফুটে পদ্মফুল। মাঝেরটিতে হিন্দিতে আলোয় কায়দা করে লেখা একটি বাক্য- হর দিল মে মোদি।
দেশ-বিদেশের হাজার হাজার লোক প্রতি সন্ধেয় ঘোরেন গঙ্গার ওই অঞ্চলে। বসে থাকেন। প্রচার করার আদর্শতম জায়গা।
‘হর দিল মে’ মোদি যে ভারতবাসী মনে করেন না, সে তো নির্বাচনের ফলে স্পষ্টতর। তবে প্রশ্ন, শাসক বিজেপি কি সেটা মানতে চাইবে? মানবে আরএসএস? বিজেপি প্রেসিডেন্ট নাড্ডার সাম্প্রতিক এক মন্তব্যে আরএসএস কর্তারা ক্ষিপ্ত। নাড্ডা উবাচ, ‘আরএসএস একটা আদর্শগত ফ্রন্ট। বিজেপি নিজেই নিজেদের চালায়।’
শাসকের বড় সমস্যা, তাদের অন্তরে অন্দরে যে ময়লা জমছে, তা তারা টের পায় না। যখন পায়, তখন দেরি হয়ে গিয়েছে বড্ড। হর দিল মে-মোদি হতে পারে না। হর দিল মে দিদি থাকতে পারেন না, রাহুল থাকতে পারেন না। এবারের নির্বাচনেই নবীন পট্টনায়ক, জগন্মোহন রেড্ডি, বিজয়ন বড় উদাহরণ। টানা ক্ষমতায় থাকার বিপদ অনেক। ঔদ্ধত্য এতটাই গ্রাস করে, একবার যখন যাবে, তখন ফিরে আসতে রক্তঘাম একাকার। মাথা খুঁড়েও তখন মানুষের মন পাওয়া কঠিন। উদাহরণ কেন্দ্রের কংগ্রেস, বাংলার সিপিএম, সিকিমে চামলিংয়ের পার্টি, পঞ্জাবের অকালি, কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্স, উত্তরপ্রদেশের মায়াবতী, অসমের গণ পরিষদ, তামিলনাডুর এআইডিএমকে।
মোদি-দিদির আকুল ভক্ত-ভাইরাও এই সারসত্য মাথায় রাখলে ভালো। দুটো পার্টিতেই দুর্নীতি, কাটমানি রাজ আর ঔদ্ধত্য সীমাহীন বাসা বেঁধেছে। সৎ লোকদের বড় অভাব। মোদি-দিদির দরকার, কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া। সৎ লোক চাই গো, সৎ লোক চাই। শুধু সৎ লোক হলে তো হবে না, সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে কাজ চাই। স্থানীয় পর্যায়ে দাদাগিরি বন্ধ দরকার। নিয়মিত রাস্তায় নামা জরুরি। নইলে সিপিএম বা অন্য বাম দলগুলোর মতো দীর্ঘদিন ফেসবুকভিত্তিক পার্টি হয়ে থাকা অনিবার্য।
এই যে সৃজন বা দীপ্সিতাদের নিয়ে এত হইচই সোশ্যাল মিডিয়ায়, ফরওয়ার্ড ব্লকের নরেন চট্টোপাধ্যায়ের বামফ্রন্টে হুংকার, তাতে লাভটা কী? ২৩ বাম প্রার্থীর মধ্যে সুজন-সেলিম বাদে সবার জামানত জব্দ। বামেদের অস্তিত্ব আজ শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায়।
শুভেন্দু প্রতিদিন সিঁদুর কপালে মেখে, সন্দেশখালি নিয়ে মিথ্যে আবহ তৈরি করেও মেদিনীপুর, মতুয়াপ্রধান এলাকা ও উত্তরবঙ্গের বাইরে বেরোতে পারলেন না। সন্দেশখালির চিরন্তনী সমস্যাকে গণধর্ষণ বানিয়ে ফেলে পুরো দেশে বাংলার মেয়েদের মিথ্যা ভাবমূর্তি তুলে ধরা শুভেন্দুদের সবচেয়ে গর্হিত অপরাধ। শুভেন্দু-সুকান্তরা তৃণমূলের ক্ষতি করতে গিয়ে বাংলা ও বাংলার মহিলাদের ভাবমূর্তির মারাত্মক ক্ষতির কারিগর। তিলকে তাল করার উদাহরণ দিতে চাইলে আপাতত সবার আগে নাম আসবে সন্দেশখালির। অধিকারীমশাই ভেবেছিলেন, সন্দেশখালিকে নন্দীগ্রাম করবেন। সন্দেশখালির লোকসভা কেন্দ্র বসিরহাট সেই শাস্তি ব্যালটে তাঁকে দিয়েছে।
মমতাকে দেখুন। তিনি নিজে দৌড়ঝাঁপ করে, দীর্ঘদিন পড়ে থেকেও জলপাইগুড়ি-আলিপুরদুয়ার উদ্ধারে ব্যর্থ। গৌড়বঙ্গের আম বা দার্জিলিংয়ের কমলা খাওয়া হল না এবারও। স্রেফ ভুল লোকদের ওপর নির্ভর করে এই দুর্দশা। কাটমানি, দাদাগিরির স্রোত এত শক্তিশালী নেতা হয়েও মমতা আটকাতে পারেননি রাজ্যে।
একতা থাকা ও না থাকার মধ্যে কী ফারাক, তা তৃণমূল উত্তরবঙ্গেই টের পেয়েছে সমূলে। কোচবিহারে ঝগড়ার জন্য বিখ্যাত চার নেতা মমতা ও অভিষেকের হুমকিতে একজোট হয়ে কাজ করেছেন। নিশীথে আঁধার নামানো গিয়েছে। আবার শিলিগুড়ি, রায়গঞ্জ ও মালদায় সেটা হয়নি একেবারেই। গৌতম দেব-পাপিয়া ঘোষকে একসঙ্গে দেখা যায়নি। আরএসপি ফেরত রহিম বক্সী, ফরওয়ার্ড ব্লক ফেরত তাজমুল হোসেন একসঙ্গে কাজ করেননি কংগ্রেস ফেরত মৌসম-সাবিনার সঙ্গে। করিম বা কানাইয়ার ক্ষেত্রেও এক কথা। প্রার্থীর মুখ চুন হয়েছে। এঁদের অধিকাংশকে জেলার বাইরে কেউ চেনে না। অথচ এঁদের ইগো আকাশছোঁয়া। নিজের স্বার্থ ছাড়া দেখেন না কিছু। তার জন্য পার্টি ডুবছে ডুবুক।
বিজেপির নৌকোও ডুবেছে এমন অনৈক্যে। তৃণমূল ফেরত শুভেন্দুর গায়ে ঘাসফুলসুলভ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মেজাজ লেগে। তিনি নিজের লোক, পরের লোক তত্ত্বে বিশ্বাসী। যোগ্যদের বঞ্চিত করে নিজের লোককে প্রার্থী বানিয়েছেন। দল ডুবেছে। জানেন তো, এই বিজেপি প্রথম দিকের বিজেপি নয়। যাকে পায়, তাকেই নিয়ে নেয়। সর্বভারতীয় স্তরে ২৫ জন এমন বড় নেতা অন্য পার্টি থেকে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, যাঁদের নামে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। পদ্মে যোগ দিতেই এঁদের ২৩ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ।
দলবদলিয়া বাবুদের নিয়ে একটা চমৎকার পরিসংখ্যান তৈরি করেছে দ্য হিন্দুর ডাটা টিম। এই নির্বাচনে এমন ৭৬ জন দাঁড়িয়েছিলেন, যাঁরা গত নির্বাচনে ছিলেন অন্য পার্টিতে। জিতেছেন মাত্র ২০। বিজেপি-কংগ্রেস হাত ধরাধরি করে তোল্লাই দিয়েছে বদলিয়াবাবুদের। পদ্মের ৪৩ জনের মধ্যে ১৩ জন জিতেছেন, হাতের ৩৩ জনে মাত্র ৭ জন। বাংলায় কৃষ্ণ কল্যাণী, তাপস, অর্জুন, ভিক্টর, বিশ্বজিৎ, মুকুটমণিরা দল পালটে সাফল্য পাননি, জিতেছেন শুধু সৌমেন্দু অধিকারী। মানে ৭-এ জয় মাত্র ১ জনের। উত্তরপ্রদেশে ১০ দলবদলিয়ার ৩ জন জিতেছেন। দশজনের ৭ জনই পদ্মের।
এই নির্বাচনের একটা ভালো দিক, দেশজুড়ে জনতা কিছুটা হলেও বুঝতে শুরু করেছে। কিছু ক্ষেত্রে যোগ্য শাস্তি দিতে পারেনি যদিও। খগেন মুর্মুর মতো অনেকে জিতে চলেছেন আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে। অবশ্য জনগণ করবেই বা কী, ঠগ বাছতে তো গাঁ উজাড়। জনতার মধ্যেও আদর্শবোধ, নীতিবোধের অভাব। তারাও দুর্নীতির অংশ। বঙ্গ সহ বিভিন্ন রাজ্যে দুর্নীতির স্রোত তাই প্রভাব ফেলে না ভোটে।
বাংলাতেই ভাবুন, রাম-বামের ভোট বদল নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয় গত বছর দশেক ধরে। এই ভোটের পর আর ওসব তত্ত্ব নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা প্রয়োজনহীন। জ্বলন্ত সত্য, বামের ভোট রামে যাচ্ছে। যাচ্ছেই। সিপিএমের সমর্থকরা বাস্তবে এখনও মেনে নিতে পারেন না, তাঁদের চৌত্রিশ বছরের সাজানো বাগান মমতার জন্য শুকিয়ে গিয়েছে। কাস্তে হাতুড়ির অন্ধ ভক্তদের তাই মমতার ওপর সবচেয়ে রাগ। তাঁদের আদর্শহীন নীতি বলে, চরম দক্ষিণপন্থীই সই। আগে যেনতেনপ্রকারেণ ওই মহিলাকে সরাও। তাই দুর্বল সিপিএম ছেড়ে তাঁরা আপাত শক্তিশালী বিজেপিকে ধরেছেন। বাংলায় শুভেন্দুরা বেশি আসন পেলে সিপিএমের প্রাচীন সমর্থকদের আনন্দ রামভক্তদের থেকেও বেশি হত। আপ বা সমাজবাদীরা বাংলায় দুই নম্বরে এলে এঁরা এদেরকেই আঁকড়ে ধরতেন।
জাতীয় স্তরেও অনেকটা এক ছবি মোদিকে ঘিরে। রাহুল গান্ধি-সীতারাম ইয়েচুরিদের দেখে হাসি পায়। এত উল্লাসের কিছু নেই। দেশে ৬৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫৬ ভোট বেড়েছে পদ্মে। ২০১৯ সালে ছিল ২২.৯০ কোটি, এবার তা ২৩.৫৯ কোটি। শতাংশের বিচারে ধাক্কাতেই এই হাল। ৩৭.৩৬% দাঁড়িয়েছে ৩৬.৫৬%। ০ .৮০ শতাংশ কমায় আসন কমে গিয়েছে ৬৩টি। বাংলা ও কেরলকে নিয়ে রাহুল-ইয়েচুরিরা ছেলেখেলারও অধম কাজ করলেন। এখন ইন্ডিয়া জোটের ২৩২ আসনের কথা বলে বিশাল উল্লাস করে কী হবে, ঘটনা হল, ক্ষমতায় তিনবারের জন্য মোদি এবং মোদিই। ঘটনা হল, নির্বাচনের বহু আগে থেকে জোট নিয়ে কোনও জমাট সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি দোদুল্যমান রাহুল, মমতা, ইয়েচুরিরা। একে অন্যের পাশে দাঁড়াতেও যাননি। যা উত্তরপ্রদেশে রাহুল-অখিলেশ, তামিলনাডুতে রাহুল-স্ট্যালিন করেছেন, তা অন্য প্রান্তে হয়নি।
জনতা যত দুর্বল হোক, এঁদেরকেই বা পুরোপুরি বিশ্বাস করবে কেন?
জনতা সব জানে। দুর্নীতিগ্রস্ত, দুর্নীতিবিদ্ধ হলেও মিথ্যা ও সত্যির ফারাক জানে। অযোধ্যা এবং সন্দেশখালি সেই সন্দেশ সবচেয়ে ভালো করে জানিয়ে দিয়েছে দেশকে।
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ বার্বাডোজে আসছে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়। যে কারণে বাতিল করা হয়েছে অনেক ফ্লাইট।…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ সম্প্রতি বিহারে ভেঙে পড়েছে একের পর নব নির্মিত সেতু। এ বার…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ লোকসভা ভোট শেষ হতেই দাম বাড়তে শুরু করেছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের।…
নাগরাকাটা: রাতভর তাণ্ডব চালিয়ে নাগরাকাটায় ৫টি বাড়ি ভেঙ্গে দিল বুনো হাতি। এর মধ্যে রয়েছে নাগরাকাটা…
আসানসোলঃ ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বড়সড়ো ডাকাতির ঘটনা ঘটেছিল আসানসোলের রানিগঞ্জ…
দুর্গাপুরঃ রবিবার সবে সকাল হয়েছে। সূর্যের আলো ফুটতেই নজরে এল বেশ কিছু পোস্টার। যা সাঁটানো…
This website uses cookies.