কলাম

নেতাদের অসৌজন্য গ্রাস করছে জনতাকেও

  • রূপায়ণ ভট্টাচার্য

অটলবিহারী বাজপেয়ীর কিডনির অসুখ ধরা পড়েছে তখন। অনেকেরই ধারণা, ক্যানসার। ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন, জীবন বাঁচাতে চাইলে আমেরিকায় যেতেই হবে। একমাত্র সেখানকার ডাক্তাররা সারিয়ে তুলতে পারেন তাঁকে। এত টাকা তখন বাজপেয়ীর কোথায়?

ক’দিন পরে হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির ফোন বাজপেয়ীর কাছে। ইন্দিরা-পুত্র দেখা করতে চান তাঁর সঙ্গে। অটলবিহারী গেলে তাঁকে রাজীব বলেন, ‘আমেরিকায় আমায় যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধিদলে থাকতে হবে আপনাকেও। এটা আমার অনুরোধ।’ রাজীব কোথা থেকে শুনেছেন বাজপেয়ীর অসুস্থতার কথা। বাজপেয়ীকে রাজি করিয়ে তিনি অফিসারদের নির্দেশ দিলেন, ‘আমরা ফিরে এলেও অটলজি ওখানে থেকে যাবেন। যতদিন ডাক্তার বলবেন, থাকবেন। চিকিৎসা করিয়ে ফিরে আসবেন। সব খরচ সরকারের।’

রাজীব নিহত হওয়ার পরে হতচকিত অটলবিহারীকে অশ্রুসজল চোখে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘আমি যে বেঁচে রয়েছি, তা শুধু রাজীবের জন্য।’

দেশ থেকে রাজ্য, সর্বত্র শাসক এবং বিরোধীদের চূড়ান্ত অসৌজন্যের বাতাবরণ দেখে বাজপেয়ীর কথাগুলো মনে পড়ছে। এখনকার পরিস্থিতিতে এই ধরনের গল্প বিশ্বাস করাও শক্ত।

বাজপেয়ীর আর একটা পুরোনো ভাষণ শোনার পরেও মনে হয়, এসব সত্যিই শুনছি? সত্যি বলা হয়েছিল? নাকি এসব কোনও মঙ্গলগ্রহের সংসদে ভাষণ?

বিজেপির এক নম্বর সেদিন সাংসদদের সামনে নিজস্ব স্টাইলে থেমে থেমে বলেছিলেন, ‘সাট্টা কা খেল চলেগা। সরকার আসবে আর যাবে। পার্টি তৈরি হবে, ভেঙে ফেলা হবে। কিন্তু আমাদের দেশ থেকে যাবে। দেশকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। দেশের গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’ বাজপেয়ীর নানা মণিমুক্তো রয়েছে সংসদীয় ভাষণে।  সব ভাষণকে ছাপিয়ে যায় দেশের গণতন্ত্র বাঁচিয়ে রাখার অঙ্গীকার।

এই ধরনের কথাই বা কোনও নেতা কি বলেন আজকের দিনে?

অতীতের সংসদীয় রাজনীতিতে শাসকের সঙ্গে বিরোধী নেতাদের সৌজন্যের উদাহরণ প্রচুর। জওহরলাল-অটলবিহারী, ইন্দিরা-ভূপেশ গুপ্ত, রাজীব-বাজপেয়ী, বিধানচন্দ্র-জ্যোতি, সিদ্ধার্থ-জ্যোতি…। এঁদের প্রত্যেকেই প্রত্যেকের পাশে দাঁড়িয়েছেন দলের পতাকা ভুলে। দলের তুলনায় বড় হয়ে উঠল মনুষ্যত্ব। ১৯৫৭ সালেই বিদেশি প্রতিনিধিদের সামনে বাজপেয়ীকে দেখিয়ে নেহরু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘এই তরুণ একদিন দেখবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী হবে।’

সিপিআই নেতা, টানা ২৯ বছরের রাজ্যসভা সাংসদ ভূপেশ গুপ্তর ৫ নম্বর ফিরোজ শা রোডের বাড়িতে ইন্দিরা থেকে বিজু পট্টনায়েক সবাই আসতেন আড্ডা মারতে। জরুরি অবস্থার আগের রাতে ক্রিম রংয়ের ফিয়াটে ইন্দিরা এসেছিলেন ভূপেশের বাড়িতে। বন্ধ ঘরে ঘণ্টা দুয়েক আলোচনার পর বেরিয়ে যান। লোকে বলে, সেই সময় রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি জানানো হয়েছিল। লন্ডনে পড়ার দিন থেকে ইন্দিরা ও তাঁর স্বামী ফিরোজের সঙ্গে বন্ধুত্ব ভূপেশের। ফিরোজ যখন ওয়েলিংটন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, তখন জাঁদরেল কমিউনিস্ট নেতা ভূপেশই ইন্দিরাকে নিয়ে যান শেষ দেখা করাতে। বিয়ের আগে তিনি জানতেন, ফিরোজের নানা মেয়ের প্রতি আকর্ষণের কথা। ইন্দিরার সামনেই ফিরোজকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বিয়ে করছিস ভালো। ইন্দিরার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারবি তো?’ অথচ এই ভূপেশই ছিলেন সংসদে নেহরু-ইন্দিরা সরকারের ঘোর সমালোচক।

এসব অতীতের গল্প উঠছে মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে রাহুল গান্ধি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ অধিকাংশ বিরোধী নেতার অনুপস্থিতি দেখে। এখন এত তিক্ততা সব দলের নেতাদের, যা কহতব্য নয়। নবীন পট্টনায়েককে কৃতিত্ব দিতে হবে,  ২৪ বছর পর ক্ষমতা হারিয়েও তিনি অন্য পার্টির শপথ অনুষ্ঠানে হাজির থাকেন। পরাজয়েও তখন উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। মল্লিকার্জুন খাড়গেও মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ছিলেন। এটাই আগে স্বাভাবিক ছিল, এখন অস্বাভাবিক। দুই পার্টির দুই নেতা যে বন্ধু হতে পারেন, পাশাপাশি বসতে পারেন, এটা আর জনগণ বিশ্বাস করে না। কেউ স্রেফ হাই হ্যালো করলেও মিডিয়ায় চর্চা শুরু হবে, কীজন্য এত কথা। এই সৌজন্যবোধ, শালীনতা, ভদ্রতা হারিয়ে যাওয়ায় তার রেশ পড়ছে সমর্থকদের ওপরও। জনতা ভাবছে এটাই বুঝি নিয়ম। বিভিন্ন এলাকাজুড়ে ঝামেলার পিছনেও কাজ করে এসব। এখনও অনেক গ্রামের দিকে বিভিন্ন পার্টির লোকেরা চায়ের দোকানে নিজেরা আড্ডা মারেন। শহরে বা মফসসলে পাবেন না এই দৃশ্যমালা।

কোন সময় থেকে ছবিটা পালটে গেল এভাবে?

১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বরে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাগজের রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, জনসংঘের পীতাম্বর দাস, কংগ্রেস (ও)-এর মোরারজি দেশাই সহ সিপিআই, ডিএমকের নেতারা সবাই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির প্রশংসা করেন। সব পার্টি একসঙ্গে ছিল। শুধু সিপিএম ইন্দিরার ব্যক্তিগত প্রশংসা করেনি। ওই সময়ই বাজপেয়ী জনসংঘের নেতা হিসেবে বলেছিলেন, ‘সরকার যদি আরও ক্ষমতা চায় পরিস্থিতি সামলানোর জন্য, আমাদের পার্টি সম্পূর্ণ সহযোগিতা করতে কোনও দ্বিধা করবে না। প্রধানমন্ত্রীকে শুধু বলব, শত্রুকে বিধ্বস্ত করে দিতে হবে।’ এখন রাজনীতিকদের এমন পারস্পরিক সম্পর্ক, তাতে এমন বিবৃতি আশা করাই অন্যায়। ইন্দিরার রাজনৈতিক জীবনে দুটো শেড ছিল। তাঁর জমানার মাঝপথ থেকেই বিরোধীদের সম্পর্ক তিক্ত হতে শুরু করে সামগ্রিকভাবে। বাজপেয়ীর সঙ্গে রাজীব বা নরসীমা রাওয়ের সুসম্পর্ক একটা ব্যতিক্রমী অধ্যায় এবং এখনকার তিক্ততা তো আলোচনারই অতীত।

ভেবে দেখুন, সব সম্পর্কই সৌজন্য মাখা থাকবে কি না নির্ভর করে উঁচু পদে থাকা লোকটির ওপর। পাড়ায়, অফিসে, বাড়িতে। সম্পর্ক সুস্থ রাখার দায়িত্ব বেশি প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর। দেশে এবং বাংলায় সর্বোচ্চ পদে থাকা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বিরোধী নেতার সম্পর্ক এত তিক্ত, তার অংশীদার হচ্ছে জনগণও। তখন অভিনেতা দেবের মতো কেউ বিরোধীদের মৃদু প্রশংসা করলেও দলে ভিলেন হয়ে যায়।

একটা সময় বিধানচন্দ্র রায়ই বিধানসভায় লুকিয়ে থাকতে বলেছিলেন জ্যোতি বসুকে। সেখান থেকে অ্যারেস্ট করা অসম্ভব বলে। বিধান রায়ের পুলিশ বিবৃতি দিয়ে বলেছিল, জ্যোতিবাবুকে পাওয়া যাচ্ছে না। স‌িদ্ধার্থশংকর রায় ওরকমই অবিশ্বাস্য কাণ্ড করেছিলেন। নিজের গাড়িতে জ্যোতিকে তুলে অন্তরালে দেখা করতে গিয়েছিলেন ইন্দিরার সঙ্গে।

বঙ্গ রাজনীতিতে শাসক-বিরোধী শিবিরের সৌজন্যবোধের শেষ উদাহরণ জ্যোতি এবং সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মমতা এবং অশোক ঘোষ। একডালিয়ার বাড়ি থেকে সুব্রত কার্যত লুকিয়ে দু’পা দূরের হিন্দুস্থান পার্কে জ্যোতি-ভবনে যেতেন বিজয়া করতে। কোনওবার সঙ্গে থাকতেন স্ত্রী ছন্দবাণী। কোনওবার জ্যোতিঘরনির জন্য নিয়ে যেতেন শাড়ি। মমতা এভাবেই দেখা করতে যেতেন ফরওয়ার্ড ব্লকের জননেতার কাছে। কিছুই না, সৌজন্য-শ্রদ্ধাবোধ।

এখন ওই ধরনের সাক্ষাৎকার সংবাদমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়াও ভাবতে পারে না। অন্য অঙ্কের জল্পনা শুরু হয়ে যায়। রাজনীতিকরাও আর ঝুঁকি নিতে পারেন না সৌজন্যবোধ দেখানোর।

উত্তরবঙ্গের প্রতিটি বড় শহরের কথা ভেবে দেখুন। হয়তো মমতা-বুদ্ধ, মমতা-শুভেন্দু জাতীয় তিক্ততা নেই। উপর উপর মৌসুমি হাওয়া। তবু কোনও শহরে শাসক ও বিরোধী মিলেমিশে শহরের উন্নতিতে পদক্ষেপ করতে পারে? কোথাও পাবেন না। সবাই একেবারে ক্ষুদ্র রাজনীতির মধ্যেই আটকে। শুধু উপর উপর সৌজন্য দেখিয়ে তো লাভ নেই কোনও।

 এঁরা অধিকাংশই একান্তে তীব্র আক্ষেপ করবেন, কলকাতার নেতারা আমাদের গুরুত্ব দেন না। অথচ নিজেরাই পাড়ার বাইরে বেরোতে চাইবেন না। উত্তরবঙ্গের অন্য জেলাতেও সক্রিয় নন। সাম্প্রতিক বড় উদাহরণ নিশীথ প্রামাণিক, জন বারলা, গৌতম দেব, বিশ্বনাথ চৌধুরী, জীবেশ সরকার, মৌসম নুর, করিম চৌধুরী, কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী। এতদিন ধরে রাজনীতিতে, তবু শুধু স্থানীয় পর্যায়ের নেতাই রয়ে গেলেন। চেষ্টা করলেন না গোটা রাজ্যের মুখ হওয়ার। কতদিন এঁরা রাজ্যে পার্টির প্রধান দপ্তরে গিয়েছেন, সারা রাজ্যের কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বলুন তো?

হায়, নিজেদের শহরে সৌজন্য ফেরানোর রাজপথটি এঁরাও কেউ দেখাতে পারেননি! শুধু পারেননি বলাটা ভুল, চেষ্টাও কি করেছেন আদৌ?

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Firhad Hakim | ‘হাউ ডেয়ার ইউ’, সায়ন্তিকার শপথ ইস্যুতে রাজ্যপালকে বেনজির আক্রমণ ফিরহাদের

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের (CV Ananda Bose) সঙ্গে রাজ্যের সম্পর্ক…

5 mins ago

S Jaishankar | দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করতে আরব সফরে জয়শংকর, গেলেন বিখ্যাত হিন্দু মন্দিরেও

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ফের বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব পেতেই সংযুক্ত আরব আমিরশাহী (UAE) সফরে গেলেন…

10 mins ago

Mamata Banerjee writes to PM | বাংলাকে অন্ধকারে রেখে বাংলাদেশের সঙ্গে জলচুক্তি, কেন্দ্রকে কড়া চিঠি মমতার

কলকাতা: বাংলাকে অন্ধকারে রেখে বাংলাদেশের সঙ্গে জলচুক্তি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে বিঁধলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার…

19 mins ago

Lionel Messi | মেসির জন্মদিনে মদনমোহন মন্দিরে পুজো, দুঃস্থদের খাওয়াল অনুরাগীরা

কোচবিহার: ২৪ জুন, সোমবার ফুটবলের তারকা লিওনেল মেসির ৩৭তম জন্মদিন। খেলোয়ারের জন্মদিনকে বিশেষভাবে পালন করলেন…

29 mins ago

Anushka Shetty | বিরল রোগে আক্রান্ত দক্ষিণী অভিনেত্রী অনুষ্কা, ঘন ঘন বন্ধ করতে হচ্ছে শ্যুটিং

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: বিরল রোগে আক্রান্ত ‘বাহুবলী’ খ্যাত দক্ষিণী অভিনেত্রী অনুষ্কা শেট্টি (Anushka Shetty)।…

52 mins ago

গান গেয়ে জনপ্রিয় রিয়েলিটি শোয়ের বিচারকদের মন জিতলেন কৃষক পরিবারের মিঠুন

বারবিশা: ছোটবেলা থেকে গান নিয়ে সেরকম প্রথাগত শিক্ষা পাননি তিনি। তারপরেও নিজের গান দিয়ে একটি…

1 hour ago

This website uses cookies.