উত্তর সম্পাদকীয়

শাসক বা বিরোধী কেউ স্বস্তিতে নেই

  • গৌতম হোড়

লোকসভা ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার সময় মনে হচ্ছিল, নরেন্দ্র মোদির অশ্বমেধের ঘোড়া আগের দু’বারের মতোই দৌড়াচ্ছে। বিরোধীদের কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আর রাম মন্দির এবং মোদির ক্যারিশমায় ভর করে বিজেপি ছুটছে। তাদের সামনে একটাই বিষয়, এবার চারশো পার হবে কি না। মোদি সহ বিজেপি নেতারা উন্নয়নের দাবি নিয়েই ভোটে জেতার কথা বলতে শুরু করলেন।

কিন্তু যত দিন কাটছে, একটার পর অন্য পর্বের ভোট শেষ হচ্ছে, ততই যেন অনেক কিছু বদলে যাচ্ছে। ন্যারেটিভ বদলে যাচ্ছে, ভাষণের বিষয় বদলে যাচ্ছে, মানুষের আলোচনা বদলে যাচ্ছে। উন্নয়নের আলোচনা থমকে গিয়েছে। রাম মন্দির নিয়ে তেমন হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। বক্তৃতায় ক্রমশ বিভাজনের, মেরুকরণের চেষ্টা প্রবল হচ্ছে। এমনকি এটাও অনেকে বলতে শুরু করেছেন, চারশো পার ছেড়ে দিন, তিনশো পারই হবে না। শেষপর্যন্ত কী হবে, সেটা তো ৪ জুন জানা যাবে। তার আগে কেবল ভাবনা বদলের একটা আবহ দেখা যাচ্ছে।

এক্ষেত্রে প্রথম ধাক্কাটা লেগেছিল অযোধ্যায় এক গাড়িচালকের কথা থেকে। কিছুদিন আগে রাম মন্দির উদ্বোধনের সময় দেখে এসেছি, সেখানে উত্তেজনা ও উন্মাদনার বহর। সারা ভারত থেকে লাখো মানুষ ভিড় জমিয়েছেন। মন্দিরে রামলালাকে দেখার উন্মাদনায় ফুটছে অযোধ্যা। তার কয়েক মাসের মধ্যেই নির্বাচনের আগে অযোধ্যায় সেই ভক্তস্রোত নেই কেন? গাড়িচালক অন্য এক চালকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানাচ্ছিলেন, কীভাবে তাঁদের অনেক গাড়ি বসে আছে, ভাড়া হচ্ছে না। অথচ, অনেক টাকা দিয়ে নতুন গাড়ি কিনে ভাড়ার জন্য লাগানো হয়েছে। রাম মন্দির নিয়ে উন্মাদনা তো এত তাড়াতাড়ি শেষ হবে বলে বিজেপি ভাবেনি।

এরপরের ধাক্কাটা ১৯ এপ্রিল, লোকসভা ভোটের প্রথম পর্বের দিন। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগরে। গত দুটি লোকসভা নির্বাচনে মুজফফরনগর মানে ছিল চূড়ান্ত মেরুকরণ। ২০১৩ সালে ভয়াবহ দাঙ্গার পর পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ জাঠ ও আখবলয়ে বিজেপি হইহই করে জিতেছিল। কারণ, তখন জাতপাতকে দূরে সরিয়ে রেখে ভোট হয়েছে মেরুকরণের ভিত্তিতে। এবার সেই মুজফফরনগরের একটি ওবিসি-প্রধান গ্রামে গিয়ে কাকে ভোট দেবেন জানতে চাওয়ার পর জবাবটা এল, বিএসপি-র হাতিকে। গতবার কাকে দিয়েছিলেন? বিজেপি-কে। এবার হাতিতে কেন?  কারণ, বিএসপি যাকে প্রার্থী করেছে, তিনিও অনগ্রসর। বিজেপি-কে ভোট দেবেন না কেন? এবার জবাব এল, আমাদের মনে হয়েছে, বিএসপি-র প্রার্থীকেই দেওয়া ভালো, তাই।

এরপর একের পর এক গ্রামে ঘুরে একটাই কথা শুনেছি, আমরা এবার আমাদের স্বার্থ দেখেই ভোট দিচ্ছি। রাম মন্দির? শ্রীরাম পাঁচশো বছর পরে তাঁর ঘরে ফিরেছেন, সেটা খুবই আনন্দের কথা। কিন্তু ভোট দিচ্ছি নিজেদের কথা ভেবে। অর্থাৎ, আবেগের বিষয় না থাকলে উত্তরপ্রদেশের মানুষ যেদিকে যান আর কী!

বারাণসীতে দশাশ্বমেধ ঘাটের সেই বিখ্যাত ছাতার তলায় বসে এক পূজারি ব্রাহ্মণ বলেছিলেন, এখান থেকে তো মোদি জিতবেনই। তারপর একটু থেমে বলেছিলেন, কিন্তু মেহঙ্গাই খুব বেড়ে গিয়েছে। প্রথম কথা নিয়ে কারও মনে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু দ্বিতীয় কথাটা এমন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বারাণসীর ঘাটে বসে কেউ বলবেন, তা ভাবতে পারিনি। অর্থাৎ, জিনিসের দাম সমানে বেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণাটা ভালোভাবেই টের পাচ্ছেন তাঁরা। না হলে, এরকমভাবে আক্ষেপটা বেরিয়ে আসত না।

রাহুল গান্ধির প্রাক্তন কেন্দ্র আমেথিতে গিয়েও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমেথির আগে একটা গ্রামে চায়ের দোকানে জনাবারো মানুষ দুপুরের আড্ডায় ব্যস্ত ছিলেন। সেখানে রাহুলের কথা তুলতেই, হুড়মুড় করে তাঁদের ক্ষোভ বেরিয়ে এল। রাহুল কেন হেরে চলে গিয়েছেন, কেন তিনি সাংসদ থাকার সময় মানুষের কাছে যেতেন না, দূর থেকে হাত নেড়ে ভোট পাওয়ার দিন আর নেই ইত্যাদি। কিন্তু তার মধ্যেই একজন বললেন, ‘সবই তো বুঝলাম, ১৩ টাকা কেজিতে চিনির কী হল?’ এটা কী বিষয়? আরেকজন বুঝিয়ে দিলেন, গতবার ভোটের সময় বিজেপি বলেছিল, ১৩ টাকা কেজি দরে চিনি দেবে।

এবার সরাসরি নয়াদিল্লিতে চলে আসি। একটি বাজারে রাজনৈতিক দলের সভা হচ্ছে। প্রার্থী এসেছেন। ভাষণ হল। প্রার্থী চলে যাওয়ার পর বাজারের এক দোকানদারকে প্রশ্ন করি, ভাষণ শুনতে গিয়েছিলেন নাকি? জবাবে রীতিমতো ঝাঁঝিয়ে উঠে তিনি বললেন, ‘আরে দূর, ব্যবসাপাতি নেই, সংসার চালাবার জোগাড় করতে কূল পাচ্ছি না। চাকরিবাকরি নেই বলে দোকান দিয়েছি। ওসব ভাষণ শুনে কী করব? কিছু হলে তো নেতার হবে, আমার কী?’

এইসব কথা তখনই ওঠে, যখন কোনও আবেগের বিষয় থাকে না। যখন মানুষ তাঁর সমস্যার কথা ভাবেন। যখন ক্ষোভ-বিক্ষোভ সামনে আসে। তাই এখন প্রশ্ন উঠছে, রাজস্থানে কি এবার বিজেপি সবক’টি আসন পাবে? সেখানে তো বসুন্ধরারাজে পুরো বসে গিয়েছেন। কর্ণাটকে ক্ষমতায় আসার পর কংগ্রেসের আসন কি বাড়বে? ডিকে শিবকুমার কি দলকে আসন জেতানোর কাজটা করে দেখাতে পারবেন? বিহার ও মহারাষ্ট্রে কী হবে? বাংলায় কি বিজেপি আসন বাড়াতে পারবে, তামিলনাডু, কেরলে খাতা খুলবে?  তখন আলোচ্য বিষয়টা চারশো পার আর থাকে না। ঠিক সেটাই হয়েছে এইবার।

বিজেপি কত পাবে, তিনশো পার হবে নাকি চারশো পার, নাকি যোগেন্দ্র যাদব যেরকম বলছেন, ২৪০-৫০-এর মধ্যে থেমে যাবে, এসব কথা এখন ফল প্রকাশের সামান্য কয়েকদিন আগে বলা অর্থহীন। সেটা তো কয়েকদিন পরেই আমরা দেখতে পাব। এখানে শুধু এটুকুই বলার, শুরুর বিষয়গুলো আর নেই। তাই রাম মন্দির পিছনে চলে গিয়েছে, উন্নয়নের বিষয়টিও খুবই পিচ্ছিল। ফলে সেই চেনা পিচেই ফিরে যাওয়া।

আর বিরোধীরা? তাদের অবস্থাও তো তথৈবচ। কেরল, তামিলনাডু, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানায় যদি বিজেপি বেশ কয়েকটি আসনে ভালো লড়াই করতে থাকে, তাহলে আজ নয় কাল দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে তারা ভালো ফল করবেই। একটা রাজনৈতিক দলের নেতার সবচেয়ে জরুরি বিষয় হল বিশ্বাসযোগ্যতা। বিরোধীদের সবচেয়ে বেশি সমস্যা সেখানেই। তাই তাদের প্রতিশ্রুতিতে চিঁড়ে ভিজছে না। মানুষ যদি তাদের উপর ভরসা না রাখতে পারে, তাহলে ভোট দেবে কী করে! সেক্ষেত্রে তারা জিততে পারেন একমাত্র নেতিবাচক ভোটে, অথবা কিছু রাজ্যে রাজ্য নেতাদের দৌলতে।

অধীর চৌধুরী একটা মন্তব্য করার পরেই কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলে দিলেন, সিদ্ধান্ত হাইকমান্ড নেবে, সিদ্ধান্ত না মানলে দল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা খোলা আছে, এ কোন দেশি কথা? গণতান্ত্রিক দেশে, গণতান্ত্রিক দলে কোনও মতপ্রকাশ করা যাবে না? বিরোধী মত হলেই দল ছেড়ে দিতে হবে? এমন অসহিষ্ণু ও অগণতান্ত্রিক আচরণ ও কথাবার্তা বলার পর তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতার পারদ তো আরও কমবে। রাজনীতির খেলা বড় চিত্তাকর্ষক। বড় কঠিন। সেখানে সামান্য ভুলেই নিশ্চিত পতন অনিবার্য হয়ে যায়।

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Suvendu Adhikari | ‘আক্রান্ত’দের নিয়ে রাজভবনে গেলেন শুভেন্দু, ‘শেষ দেখে ছাড়ব’, মন্তব্য রাজ্যপালের

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ রবিবার সন্ধ্যায় আক্রান্ত বিজেপি কর্মীদের নিয়ে রাজভবনে গিয়ে দেখা করলেন রাজ্যের…

4 hours ago

Bjp | রাজ্যে পৌঁছে গেল বিজেপির কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল, রাতেই ঘরছাড়াদের সঙ্গে কথা

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ৪ জুন নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকেই রাজ্যের নানা প্রান্ত ভোট…

4 hours ago

Atreyi River | জলের রং কুচকুচে কালো! আত্রেয়ীকে ঘিরে দানা বাঁধছে আশংকার মেঘ

বালুরঘাট: বর্ষার শুরুতে কিছুটা হলেও বেড়েছে আত্রেয়ী নদীর জল। কিন্তু সেই জলের রং কুচকুচে কালো।…

5 hours ago

Burdwan | পশ্চিম বর্ধমানে সিপিএমে ভাঙন, তৃণমূলে যোগ দিলেন পার্টির হোলটাইমার পঙ্কজ রায় সরকার

দুর্গাপরঃ লোকসভা নির্বাচন মিটতে না মিটতেই এক সময়ের লালদুর্গ বলে পরিচিত ইস্পাত নগর দুর্গাপুরে সিপিএমে…

6 hours ago

Land grabbing | তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধান ও তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে জমিদখলের অভিযোগ, থানার দ্বারস্থ অশীতিপর বৃদ্ধা

রায়গঞ্জঃ বৈধ নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও এক প্রান্তিক কৃষকের জমি দখল করে কংক্রিটের দেওয়াল নির্মাণের অভিযোগ…

7 hours ago

Sunil Gavaskar | ফ্লোরিডায় বৃষ্টিতে বাতিল একের পর এক ম্যাচ, আইসিসিকে দুষলেন সুনীল

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: টি২০ বিশ্বকাপে বৃষ্টির জন্য ভেস্তে যাচ্ছে একের পর এক ম্যাচ। মঙ্গলবার…

7 hours ago

This website uses cookies.