- নব দত্ত
রবীন্দ্র সরোবরের ৫ বিঘা জমি মাত্র ৮,১১১ টাকা মাসিক ভাড়ায় দেওয়া হল। কলকাতা মেট্রোপলিটান ডেভেলপমেন্ট অথরিটি, সরোবরের রক্ষক যাকে বলে। কাদের দিল? কলকাতা এন্টারটেইনমেন্ট কোম্পানি। কিছুদিন আগেই যার জন্ম। হয়তো চিনবেন তিন তারকা মালিককে। নবান্নয় দেখাসাক্ষাৎ। সেলেব্রিটি ক্রিকেটে জয়ের গল্প চলল। ব্যাস, হয়ে গেল চুক্তি। সরোবরের জমি অনেকদিন ধরে চাইছিলেন। অবশেষে শিকে ছিঁড়ল। ভাড়া নির্ধারণ কে করল, কীভাবে করল, প্রশ্নটা এটা নয়। প্রশ্ন, কত কম ভাড়ায় দেওয়া হল। প্রশ্নটা এটাও নয়, এতে কি আইন ভাঙল? সেটা আদালত ঠিক করুক।
নাগরিকের নিরীহ প্রশ্ন, এটা কি পরিবেশ নৈতিকতা মেনে করা হল? রবীন্দ্র সরোবর গত চার দশক ধরে রাজ্যের শাসকের খামখেয়ালিপনার শিকার। এভাবেই নানা ক্লাবের আড়ালে-আবডালে বিনোদনের ব্যবসা চলতে সাহায্য করা হয়েছে। মহাকরণের শাসন থেকে নবান্নের শাসনে পালটাল না কিছুই।
মুখ্যমন্ত্রী যখন যুব নেত্রী, তখন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গী করে সরোবর বাঁচাও কমিটি গঠন করলেন। শাসকের সরোবরের সবুজ ধ্বংসের বিরুদ্ধে ধর্না, বিক্ষোভ, কত কত প্রতিবাদ। আমরাও চির দত্তের নেতৃত্বে শামিল। রেলগেট অবরোধ, গড়িয়াহাট, গোলপার্ক আটকে ধর্না। আজ পালটে গেল অনেক কিছুই, পালটাল না সরোবর ধ্বংসের কাজ।
কলকাতায় মাত্র মাথাপিছু সাত শতাংশ খালি জমি। গত তিন দশকে চার হাজার পুকুর ভরাট হয়েছে। ৩০ শতাংশ গাছ কাটা হয়েছে। না, আমরা সেভাবে কিছু বলিনি। সহ নাগরিক আমরা আসলে কিছুই দেখিনি! জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করি না। আমরা নাগরিক অধিকার হারিয়ে এখন স্রেফ উপভোক্তা। বেনিফিশিয়ারি। বেনিফিট অফ ডাউট দিয়ে যাচ্ছি।
কলকাতার রবীন্দ্র সরোবরে সরকারি উদ্যোগে যেভাবে সবুজ ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে, একইভাবে উত্তরবঙ্গে শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, রায়গঞ্জ, বালুরঘাট, মালদা সর্বত্র শহরের পরিবেশ নষ্ট করে গাছ কাটা চলছে। পুকুর ভরাট, নদী দখল, জঙ্গল ধ্বংস করা হচ্ছে। গরুমারা সংলগ্ন এলাকা লাটাগুড়িতে অসংখ্য ট্যুরিস্ট হোটেল এবং হোমস্টে জঙ্গলের পরিবেশ ধ্বংস করে চলেছে।
আলিপুরদুয়ার জেলার কালচিনি ব্লক সহ বিস্তীর্ণ ভুটান সংলগ্ন অঞ্চলে পাশাখা শিল্পাঞ্চলের থেকে আসা বায়ু দূষণ এবং জল দূষণের ফলে এলাকার চা বাগান, বন ও বসতি, নদী, ভূগর্ভস্থ জল, কুয়ো, টিউবওয়েলের জলে ভয়ংকর দূষণ। পানযোগ্য নয়। জঙ্গল, পশুপাখি সবের ওপরেই দূষণের মারাত্মক প্রভাব, চা বাগানের শ্রমিকদের ঘরে ঘরে চর্মরোগ, পেটের রোগ, শ্বাসকষ্ট।
যথাযথ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই বিভিন্ন ধরনের খনিজ আকরিক প্রক্রিয়াকরণ এবং বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে সংলগ্ন অঞ্চল বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। বাতাসের ধূলিকণা স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ৫ গুণ বেশি। সিংহীঝোরার জল আগে পানযোগ্য ছিল, এখন সম্পূর্ণ বিষাক্ত। ভালু ঝোরা, পানা বাসারা, কালজানি, তোর্ষা নদী পর্যন্ত দূষণের কবলে পড়েছে।
এই তো লম্বা সময় ধরে ভোটপর্বে অনেক কিছুর গ্যারান্টি শুনতে পেলাম। ভেবেছিলাম অন্তত এবার এই গ্যারান্টি শাসকের তরফে পাব যে, ভুটানের সঙ্গে কথা চালিয়ে দূষণমুক্ত করার একটা চেষ্টা হবে। জনগণের হিল্লে হবে।
সেটা হল কোথায়?
(লেখক পরিবেশবিদ)