- অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য
কী ছিল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়? কেন কৌতূহলী ও আকৃষ্ট হয়েছিল নতুন এই সাময়িকপত্রটির প্রতি তৎকালীন বিদ্বৎসমাজ? হঠাৎ এমন একটা পত্রিকার আবির্ভাবের কারণটাই বা কী ছিল সেদিন? শুধু যে ‘সাহিত্য দেশের অবস্থা এবং জাতীয় চরিত্রের প্রতিবিম্ব মাত্র’ তা-ই নয়, একটা দেশের একেকটা সাময়িকপত্রের আবির্ভাবের পিছনেও থাকে সেই দেশের অবস্থা ও তার জাতীয় চরিত্রের প্রতিফলন এবং প্রভাব।
১৮১৫ সালে রামমোহন রায় ‘আত্মীয় সভা’ নামে একটি আলোচনা সভা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সভায় শুধু যে শাস্ত্রীয় আলাপ-আলোচনা বেদপাঠ ব্রহ্মসংগীত প্রভৃতি হত তা-ই নয়। তাছাড়াও জাতিভেদ সমস্যা, বালবিধবাদের সমস্যা, বহুবিবাহ সমস্যা, পৌত্তলিকতার সমস্যা ইত্যাদি সামাজিক নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হত। বলা যেতে পারে, বাঙালির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সভাসমিতির মধ্যে ‘আত্মীয় সভা’ই সর্বপ্রথম। এই সভার সভ্যরা সকলেই ছিলেন রামমোহনের আদর্শের সঙ্গী ও সুহৃৎ। দ্বারকানাথ ঠাকুর ও নন্দকিশোর বসু ছিলেন এই সভার সদস্য। এই দুই রামমোহন-অনুগামীর দুই জ্যেষ্ঠ পুত্রকে যখন একত্রিত হতে দেখি, তখন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার আবির্ভাব ঘটে গিয়েছে। বলা হয়নি, নন্দকিশোর বসুর জ্যেষ্ঠ পুত্র হলেন ডিরোজিও-পরবর্তী হিন্দু কলেজের যশস্বী ছাত্র রাজনারায়ণ বসু।
‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠার দু’বছর পরেই রামমোহন, ডেভিড হেয়ার, দ্বারকানাথ প্রমুখের উদ্যোগে ১৮১৭ সালের ২০ জানুয়ারি কলকাতায় ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের প্রয়োজনে হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়। দ্বারকানাথ তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবেন্দ্রনাথকে রামমোহনের অনুরোধে এই হিন্দু কলেজে না দিয়ে রামমোহনের ‘অ্যাংলো হিন্দু স্কুলে’ ভর্তি করেন। স্বয়ং রামমোহন বালক দেবেন্দ্রনাথকে নিজের গাড়ি করে স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৮২৬ থেকে ১৮৩০, দেবেন্দ্রনাথ তাঁর নয় থেকে তেরো বছর বয়স পর্যন্ত রামমোহনের বিদ্যালয়ে পড়েন। এই সময়-পর্বে ১৮২৬ সালে হিন্দু কলেজে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন প্রতিভাবান তরুণ ডিরোজিও সাহেব। হিন্দু কলেজের ছাত্র তথা ইয়ংবেঙ্গলদের উপর এই অসাধারণ শিক্ষকের অসামান্য প্রভাব ইতিহাসবিদিত। পাশ্চাত্য বিদ্যাচর্চা থেকে আহৃত যে যুক্তিবাদ ছাত্রেরা পেয়েছিলেন, তার দ্বারা প্রচলিত সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ও কুসংস্কার কাটিয়ে, ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সমাজ ও ধর্মের বিচার করতে অত্যুৎসাহী হয়ে উঠলেন নব্যবঙ্গের যুবকবৃন্দ। ছাত্রদের মধ্যে যুক্তিবাদের আগ্রহ ও উৎসাহ লক্ষ করে বিভিন্ন বিষয়ে আরও মুক্তভাবে আলাপ-আলোচনা করার জন্য ১৮২৮ সালে ডিরোজিও তাঁর নিজের বাড়িতে ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ স্থাপন করলেন—কলেজ চত্বরের বাইরে এক উদার উন্মুক্ত বিতর্ক সভাকেন্দ্র। ডিরোজিওর উল্লেখযোগ্য প্রত্যক্ষ ছাত্ররা হলেন রামগোপাল ঘোষ, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধানাথ শিকদার, প্যারীচাঁদ মিত্র ও রামতনু লাহিড়ী। রামগোপাল ঘোষ, এই অ্যাসোসিয়েশনেই ভবিষ্যতে ইংরেজি ভাষায় অসামান্য বক্তা হয়ে ওঠার প্রথম তালিম পেয়েছিলেন। ‘সেখানে ইংরেজি ভাষার ফোয়ারা ছুটত, দেশীয় বাংলা ভাষা বিশেষ আমল পেত না।’ এই অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনই ছিল ইয়ংবেঙ্গলদের আসল ট্রেনিং স্কুল। এই সভা থেকেই বৈপ্লবিক চিন্তাধারা ডিরোজিওর ছাত্র তথা ডিরোজিয়ানদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়।
চিৎপুর রোডে একটি বাড়ির বৈঠকখানা ভাড়া নিয়ে উপনিষদ প্রভৃতি হিন্দু ধর্মশাস্ত্র মন্থন করে একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে রামমোহন রায় ১৮২৮-এর ২০ অগাস্ট স্থাপন করেন ব্রাহ্মসমাজ। শুধু ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন নয়, সামাজিক বিষয়ে তাঁর আচার-ব্যবহার হিন্দু সমাজের লোকদের কাছে অপ্রিয় হয়ে ওঠে। কলকাতার বুকে সেদিন একই সময়ে রামমোহনের ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা ও অপরদিকে ইয়ংবেঙ্গল দলের অভ্যুদয়। সব মিলিয়ে মহানগরীর আবহাওয়ায় তখন উৎসাহ ও উদ্বেগ, সংগ্রাম ও সংশয়, ঐতিহ্যানুরাগ ও সংস্কারমুক্তির অস্থিরতা।
বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা আইনবিরুদ্ধ বলে ঘোষণা করলেন ১৮২৯-এর ৪ ডিসেম্বর। ১৮৩০-এর ১৭ জানুয়ারি ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মিশনারি, রামমোহন ও ডিরোজিওর শিষ্য সম্প্রদায়ের হাত থেকে সনাতন হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করতে স্থাপন করলেন ‘ধর্মসভা’। ২৩ জানুয়ারি ব্রাহ্মসভাকে রামমোহন নবনির্মিত গৃহে স্থাপন করেন। জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের নিরাকার সত্যস্বরূপ পরমেশ্বরের উপাসনা মন্দির রূপে এর প্রতিষ্ঠা ঘটল। এদিকে খ্রিস্টধর্মের প্রচার ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে এবছর ২৭ মে তারিখে কলকাতায় সস্ত্রীক এসে পৌঁছোলেন মিশনারি পাদ্রি আলেকজান্ডার ডাফ।
বালককালে দেবেন্দ্রনাথ ১৮২৬-১৮৩০ রামমোহনের অ্যাংলো হিন্দু স্কুলে পড়াশোনা করেন। ১৮৩০-এর ১৯ নভেম্বর বিলেত যাত্রা করেন রামমোহন। এর অল্প পরেই নতুন বছরের জানুয়ারি মাসে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা সংবাদ প্রভাকর প্রকাশ পায়। কলেজ কর্তৃপক্ষের ইচ্ছাক্রমে ডিরোজিওকে কলেজ ছাড়তে বাধ্য হতে হয় এ-বছর। ২৫ এপ্রিল ১৮৩১ তিনি হিন্দু কলেজ থেকে পদত্যাগ করেন।
ওই বছরে এর অল্প পরেই দেবেন্দ্রনাথ ভর্তি হন হিন্দু কলেজে। বছর তিন-চার সেখানে পড়েন। ১৮৩২-এর ২৫ মে ৬৯ সংখ্যা প্রকাশের পর সাপ্তাহিক সংবাদ প্রভাকরের প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। ১৭ অক্টোবর খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন ডিরোজিওর শিষ্য কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন এমন জনরব উঠেছিল যে, হিন্দু কলেজের সব ভালো ভালো ছাত্রই বুঝি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করবেন।
ডিরোজিওর ছাত্র নন দেবেন্দ্রনাথ। ডিরোজিও প্রবর্তিত অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিপত্তি লক্ষ করেই যেন পালটা একটা পরিষদ গড়ে তোলার প্রয়োজন অনুভব করেন দেশি সংস্কৃতির অনুরাগী বাংলা ভাষানুরাগী হিন্দু কলেজের ছাত্র দেবেন্দ্রনাথ, তাঁর বয়স তখন সবেমাত্র পনেরো। ১৮৩২-এর ৩০ ডিসেম্বর অ্যাংলো হিন্দু স্কুলের দুই প্রাক্তন ছাত্র দেবেন্দ্রনাথ ও রামমোহন-পুত্র রমাপ্রসাদ হিন্দু কলেজে পাঠকালে ১৮৩২-এর ৩০ ডিসেম্বর অ্যাংলো হিন্দু স্কুলে ‘সর্বতত্ত্বদীপিকা সভা’ স্থাপন করেন। এই সভা ছিল সম্পূর্ণরূপে ছাত্রদের একটি বিদ্বৎসভা। সম্পাদক হন দেবেন্দ্রনাথ, সভাপতি রমাপ্রসাদ রায়। বঙ্গভাষা অনুশীলন ও তার সমৃদ্ধির প্রয়াসই হয় এই সভার মুখ্য উদ্দেশ্য। সভার প্রথম অধিবেশনেই সভ্যদের জানানো হয়, ‘বঙ্গভাষার আলোচনার্থ কোনও সমাজ সংস্থাপিত হয় নাই’ বলেই এই ধরনের একটি সভা স্থাপনের প্রয়োজন হয়েছে। দেবন্দ্রনাথ তাঁর ভাষণে বলেন, ‘ইহা চিরস্থায়ী হইলে উত্তমরূপে স্বদেশীয় বিদ্যার আলোচনা হইতে পারিবেক, এক্ষণে ইংলন্ডীয় ভাষা আলোচনার্থ অনেক সভা দৃষ্টিগোচর হইতেছে এবং তত্তৎ সভার দ্বারা উক্ত ভাষায় অনেকে বিচক্ষণ হইতেছেন, অতএব মহাশয়েরা বিবেচনা করুন গৌড়ীয় সাধুভাষা আলোচনার্থ এই সভা সংস্থাপিত হইতে সভ্যগণের ক্রমশঃ উত্তমরূপে উক্ত ভাষাজ্ঞ হইতে পারিবেন।’ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এই প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, ‘বঙ্গভাষী ভিন্ন এ সভাতে কোনও কথোপকথন হইবেক না।’
পনেরো বছরের যে কিশোর ছাত্রাবস্থায় বাংলা ভাষার প্রেমে মহানগরীর বুকে গৌড়ীয় বিদ্যাচর্চার জন্য এমন একটি বঙ্গীয় সমিতি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, একমাত্র তাঁর পক্ষেই বুঝি সম্ভব ছিল এমনটা। এর সাত বছর পরে ১৮৩৯ সালে তত্ত্ববোধিনী সভা ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার রূপ নিয়ে দেখা দিল, তার ইতিহাস খুঁজতে গেলে বাংলা বিদ্যানুরাগী ও ঐতিহ্যানুরাগী সেই কয়েকটি তরুণের গড়া ‘সর্বতত্ত্বদীপিকা সভা’র কথা বিস্মৃত হলে চলবে না।
এই সভা প্রতিষ্ঠার পরের ডিসেম্বরে, ১৮৩৩-এর ২৭ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডে রামমোহন রায়ের প্রয়াণ ঘটে।
দেবেন্দ্রনাথের চেয়ে অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন তিন বছরের ছোট। তরুণ ছাত্র যখন বাংলা ভাষার উন্নতির আকাঙ্ক্ষায় সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত, তখন অন্যদিকে কবিযশপ্রার্থী বালক অক্ষয়কুমার বিদ্যাচর্চার ফাঁকে আদিরসাত্মক কবিতা রচনায় আত্মমগ্ন। ১৮৩৪-এ মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তাঁর কবিতাপুস্তক ‘অনঙ্গমোহন’ প্রকাশ পায়। অধুনালুপ্ত এটিই তাঁর প্রথম ও শেষ কাব্যগ্রন্থ। ‘অনঙ্গমোহন’ প্রকাশের বছর পাঁচেক পরে দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে এই অক্ষয় দত্তের পরিচয় করিয়ে দেন দৈনিক সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্ত। ১৮৩৯-এর ৬ অক্টোবর দেবেন্দ্রনাথ কর্তৃক তত্ত্ববোধিনী সভা স্থাপিত হয়।
দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ঈশ্বর গুপ্তের পরিচয় তত্ত্ববোধিনী সভা স্থাপিত হওয়ার আগে থেকেই হয়েছিল। দ্বারকানাথের সঙ্গেও ঈশ্বর গুপ্তের বিশেষ পরিচয় ছিল। ‘অনঙ্গমোহন’ কাব্যের রচয়িতা অক্ষয়কুমার দত্তকে গদ্যশিল্পীরূপে আবিষ্কারের প্রথম কৃতিত্ব ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের। তিনি পরে দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে এই গদ্যশিল্পীর পরিচয় ঘটান। প্রভাকরের আর্টিকেল রচয়িতা একদিন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদকের আসন অলংকৃত করেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার কথাপ্রসঙ্গে প্রথমেই তত্ত্ববোধিনী সভার কথা আসে। কারণ, এই পত্রিকাটি ছিল মুখ্যত ওই সভার মুখপত্র।
তত্ত্ববোধিনী সভার প্রতিষ্ঠার পরেই ১৮৪০-এর জুনে দেবেন্দ্রনাথ তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ‘তাহাতে ছাত্রদিগকে রীতিমতো বেদান্ত শিক্ষা দেওয়া যাইত। তাঁহার প্রকৃতির বিশেষত্ব ও মহত্ত্ব এই যে, যখন দেশের শিক্ষিত দলের মধ্যে প্রতীচ্যানুরাগ প্রবল, সকলেই পশ্চিমদিকে চাহিয়া রহিয়াছে, তখন তিনি এ দেশের প্রাচীন জ্ঞান-সম্পত্তির প্রতি মুখ ফিরাইলেন, এবং বেদ-বেদান্তের আলোচনার জন্য তত্ত্ববোধিনী সভা ও তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা স্থাপন করিলেন। তিনি ধর্ম-সংস্কারে প্রবৃত্ত হইলেন, কিন্তু আপনার কার্যকে জাতীয়তারূপে ভিত্তির উপর স্থাপিত রাখিতে ব্যগ্র হইলেন। এই বিশেষত্ব তিনি চিরজীবন রক্ষা করিয়েছেন।’
তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার উদ্দেশ্য ছিল, ‘ইংরাজি ভাষাকে মাতৃভাষা এবং খ্রিস্টীয় ধর্মকে পৈতৃক ধর্মরূপে গ্রহণ—এই সকল সাংঘাতিক ঘটনা নিবারণ করা, বঙ্গভাষায় বিজ্ঞানশাস্ত্র ও ধর্মশাস্ত্রের উপদেশ করিয়া বিনা বেতনে ছাত্রগণকে পরমার্থ ও বৈষয়িক উভয় প্রকার শিক্ষা প্রদান করা।’