- মৈনাক ভট্টাচার্য
কলেজবেলায়, কিছু বন্ধু আমাদের উদ্দেশ্যে ছড়া কাটত- ‘থাকি উত্তরবঙ্গে/ জলা-জঙ্গল সঙ্গে’। মন্দ লাগত না। আলিপুর থেকে মালদা- বাসরা, রায়ডাক, কালজানি দিয়ে যার যাত্রা শুরু। তোর্ষা, সুটুঙ্গা কুমলাই কিংবা জরদা হয়ে করলার সঙ্গে সাহু ফুলহার বেহুলারা মেতে আছে সেই সংগতে। তিস্তা, মহানন্দা তো আছেই।
চৌকাঠ পেরোলেই আবহ পালটে যাওয়ার এমন প্রাকৃতিক অবয়বের অহংকারে বেড়ে ওঠা নিয়ে আমরাও নদীর মতো কলকল করে বিতর্কে জড়িয়ে যেতাম। ছোট থেকেই জেনে এসেছি নেপালি ভাষার ‘বালা সুন’-এর আক্ষরিক অর্থই তো সোনার মতো বালি। কৈশোরে তাই লী ফকের অরণ্যদেবের সোনাবেলাকে খুব বাস্তব লাগত, মনে হত বালাসন নদীর ধার করা এক চিত্রপট।
সম্প্রতি শিলিগুড়িতে মহানন্দার জল দূষণ দেখিয়ে দিল আমাদের এই অহংকার বলয় এখন কত ঠুনকো। জলস্তর নেমে যাওয়ায় একদিকে নাব্যতা হারাচ্ছে নদীগুলি, অন্যদিকে বাড়ছে আমাদের নদী নির্ভরতার পরিধি। গ্রাউন্ড লেভেল ওয়াটার রিসোর্স অথরিটির পরিসংখ্যানে, শিলিগুড়ির জলস্তর বছরে গড়ে এক ফুট করে নীচে চলে যাচ্ছে।
এই শহরে প্রতিদিন কমবেশি সত্তর মেগাগ্যালন জলের প্রয়োজন, সংরক্ষণ হয় পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন মেগাগ্যালন মাত্র। ঘাটতির জল, ঘাটতিতেই থেকে যাচ্ছে। সঙ্গে সংযুক্ত জল অপচয়। অপচয়ের এই জল মাটির নীচে ফিরে গেলে তাও কথা ছিল, আমাদের অজ্ঞতায় নর্দমা হয়ে বয়ে চলে যাচ্ছে অন্য প্রান্তে। একটা বর্ষাকেও তাই আর অবহেলা নয়। এখনই আমাদের প্রয়োজন, জলস্তর বাঁচানোর মতো প্রাথমিক সচেতনতার প্রয়োগ কৌশল বাস্তবায়িত করা। গ্রিন ট্রাইবিউনাল বলে, এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন ভূগর্ভস্থ জলস্তর ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ। জলস্তর স্বাভাবিক রাখতে একমাত্র সুরাহা আর্টিফিশিয়াল গ্রাউন্ড লেভেল ওয়াটার রিচার্জ সিস্টেম। যার আক্ষরিক নাম ‘রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং’।
আমাদের প্রত্যেকের ঘর থেকেই শুরু হতে পারে এই বিপ্লব। বাড়ির ছাদে বৃষ্টির জল ধরে তার ব্যবহার পানীয়ের বাইরে অন্যভাবে প্রয়োগ কৌশলও প্রতিটি হাইরাইজারে বাধ্যতামূলক হওয়া খুবই জরুরি। প্রয়োজনাতিরিক্ত উন্মুক্ত জায়গা রেখে দিতে হবে কংক্রিটে বা এমন আস্তরণহীন ভাবে, যার সাহায্যে বৃষ্টির জল জমিতে ফিরে যেতে পারে। ব্যবহৃত জল নিষ্কাশনে কিছু পাইপ উন্মুক্ত জায়গায় জমি থেকে মাটিতে এমনভাবে পুঁতে দিতে হবে যার নীচে থাকবে বালি, কাঠকয়লা, পাথরের স্তরের মতো সহজ ফিল্টার পদ্ধতি। পেভার টাইলস বা কংক্রিটের ফুটপাথ হলেও মাঝে মাঝে পাইপ বসিয়ে বৃষ্টির জলকে ফিরিয়ে দিতে হবে জমিতেই। মোটের উপর অতিরিক্ত জলকে নর্দমা দিয়ে বর্জ্য হিসেবে না পাঠিয়ে যতটুকু পরিশোধন সম্ভব তার মাধ্যমে মাটির স্তরে আবার ফিরিয়ে দিতে পারলে অনেকটাই সেরে ফেলা যাবে দায়বদ্ধতা।
কী সরকারি কী ব্যক্তিগত সব ক্ষেত্রেই থেকে যাচ্ছে পরিকল্পনার উদাসীনতা। সঙ্গে মানবিক দায়বদ্ধতার অভাব।
আমাদের হাতের মুঠোয়, অ্যান্ড্রয়েডের জাদুতেই রয়েছে এমন নানা সমাধান। প্রয়োজন, ফেসবুক শর্টফিল্মের বাইরে গিয়ে এই জ্ঞানগর্ভে সময়মতো একটু শুধু ‘ঢুঁ মারা’।
(লেখক শিলিগুড়ির বাস্তুকার এবং ভাস্কর)