বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই, ২০২৫

প্রসাদ প্রকল্প বনাম খুঁত খোঁজার প্যাঁচপয়জার

শেষ আপডেট:

গৌতম সরকার

প-এ প্রশাসন। প-এ প্রসাদ। বাংলায় রাজনীতির বর্ণমালায় প-এর দুই প্রকারভেদ। যদিও ভেদ ভেঙে শব্দ দুটি এখন মিলেমিশে একাকার। আপাতত প্রসাদ তৈরি আর প্রসাদ বিলিতে যুক্ত প্রশাসন। দুয়ারে র‌্যাশনে চাল-গমের সঙ্গে প্রসাদ। চাল-গমে দাম দিতে হয়। প্রসাদ এক্কেবারে ফ্রি। ভরতুকি দেওয়া সরকারি প্রকল্প যে। দলদাস প্রশাসন, দলদাস পুলিশ ইত্যাদি শব্দবন্ধ বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গিয়েছে। অভিধানে নতুন শব্দ যোগ করা যায়- ধর্মসেবক প্রশাসন, ধর্মসেবী সরকার।

বিডিও, পুরসভার চেয়ারম্যান না হয় প্রশাসনের অংশ। শুধু তৃণমূল নেতার পরিচয়ে যাঁরা বাড়ি বাড়ি প্রসাদ বিলোচ্ছেন, তাঁরা কোন প্রশাসন? এক অদ্ভুত মিলিজুলি বকচ্ছপ অবতার যেন। কোনটা প্রশাসন আর কোনটা শাসকদল- ফারাকটা গুলিয়ে গিয়েছে। থুড়ি, গুলিয়ে গিয়েছে নয়, গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। শাসকদলের সকলে শুধু সংগঠনের নেতা হয়ে থাকলে খুশি হন না। প্রশাসনে ছড়ি ঘোরাতে না পারলে যে মান-ইজ্জত থাকে না। অতএব যে যেমন পারো, প্রশাসন হয়ে যাও।

প্রসাদ প্রকল্প লিখেছি। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন- সরকারি প্রকল্প। যেন আরেকটা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। কিংবা স্বাস্থ্যসাথী বা কন্যাশ্রী, রূপশ্রী ইত্যাদি সাথী বা শ্রী যুক্ত সরকারি খয়রাতি। পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি- কথাটা চালু ছিল কংগ্রেস ও বাম শাসনেও। কংগ্রেস আমলে নেতাদের সিগারেটের খাপে লেখা সুপারিশে চাকরি হয়ে যেত। সেই পাইয়ে দেওয়াটা এখন ভাতা নাও টাকা দাও। অনুচ্চারিত স্লোগানটা সামান্য বদলে বলা যায়- প্রসাদ নাও, ভোট দাও।

প্রশ্ন করলে কি অন্যায় হবে যে, প্রসাদ বিলি কি সরকারের কাজ হতে পারে? প্রসাদ তো দেবতার উদ্দেশে নিবেদিত খাদ্য। দেবতা গ্রহণ করার পর যেটুকু থাকে, তা ঈশ্বরের দেওয়া আশীর্বাদ হিসেবে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট একটি ধর্মের প্রথা। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে প্রশাসন কেন প্রসাদ বিলোবে? ইদের অনুষ্ঠানে বা গির্জায় মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিরা গেলে তোষামোদের রাজনীতি বলে হইচই হয়। প্রশাসন প্রসাদ বিলোলে ভিন্ন তোষামোদের অভিযোগ কেন উঠবে না?

না, মশাই না। অভিযোগ একটা উঠছে। সেটা প্রশাসনের প্রসাদ বিলোনো নিয়ে নয়। প্রসাদের শুদ্ধতা নিয়ে। শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদাররা উচ্চগ্রামে প্রচার করছেন এই প্রসাদে ঈশ্বরের ছোঁয়া নেই। এই প্রসাদ জগন্নাথের নয়। জগন্নাথ তো শুধু পুরীর একচেটিয়া। দিঘা তো ধর্মস্থানই নয়। অথচ রাম মন্দির উদ্বোধনে যেভাবে নেমে পড়েছিল উত্তরপ্রদেশ সরকার, দিঘায় তারই পুনরাবৃত্তি করছে পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন।

তৃণমূল ও বিজেপি- দু’পক্ষই গাইতে পারে ‘মোরা যাত্রী একই তরণীর, সহযাত্রী একই তরণীর…।’ সেই সহযাত্রীদের রাজনীতি এখন শুধুই ধর্মকেন্দ্রিক। সেই ধর্ম-রাজনীতির নতুন অস্ত্র হয়ে উঠল প্রসাদ। শুধু মেরুকরণের প্রচারে ততটা লাভ হচ্ছে না বাংলার মাটিতে। মোথাবাড়ি, ধুলিয়ান, মহেশতলার সাম্প্রদায়িক বিরোধ কালীগঞ্জের ভোটে ডিভিডেন্ড দিল না। কিন্তু খেলা চলছে নিরন্তর। আজ হয়নি বলে কাল হবে না- তেমন নিশ্চয়তা নেই।

সহজ এই আশঙ্কাটা আঁচ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁর কথা, আচরণ, গান নিয়ে মিম-খিল্লি যতই হোক, অস্বীকার করা যাবে না যে, মানুষের মন পড়তে তিনি পারদর্শী। একা ৩৪ বছরের বাম শাসনের জগদ্দল পাথরটাকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন তো। হিন্দু ভোটের পদ্মাসন ঠেকাতে তাঁর এই দিঘা অভিযান ও প্রসাদ প্রকল্প। হিন্দু ভোট আটকানোর এই চক্রব্যূহে ভেদ করার মন্ত্র খুঁজতে তাই ব্যস্ত বিজেপি।

পুরীর মাহাত্ম্যের তুলনায় দিঘাকে খাটো দেখানোর সর্বাত্মক প্রয়াস সত্ত্বেও তেমন কাজ হচ্ছে না। তাই প্রসাদে খুঁত ধরা, তার শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার হাস্যকর প্রয়াসে মরিয়া এখন শুভেন্দু অধিকারীরা। তাঁদেরই (বিজেপি) ছেঁড়া জুতোয় পা গলিয়ে যে পদচারণা চলছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কোন পশুপাত অস্ত্রে তা ঠেকাবে পদ্ম শিবির? অথচ সামনে পড়ে অনেক হাতিয়ার। পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। এই যেমন আরজি কর মেডিকেলে চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুন, নিয়োগে দুর্নীতি, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের চাকরি বাতিল ইত্যাদি। এসব ব্যবহারে ব্যর্থ বিজেপির বঙ্গ নেতৃত্ব। জুনিয়ার ডাক্তাররাই বলুন কিংবা চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা বিজেপিকে এড়িয়ে গিয়েছেন দুটো কারণে। প্রথমত, রাজনীতির ছোঁয়ায় আন্দোলনের শুদ্ধতা নষ্ট ও নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে। দ্বিতীয়ত, বিজেপির ওপর ভরসা রাখতে না পারায়।

মমতা নিশ্চিত, সংখ্যালঘু ভোট তাঁকে ছেড়ে যাবে না। একসময় তিনি বলেছিলেন, যে গোরু দুধ দেয়, তার লাথি খেতে তাঁর আপত্তি নেই। অন্যদিকে, শুধু হিন্দু ভোটের ভরসায় বাংলা দখলের চেষ্টায় আছে বিজেপি। কেন্দ্রের ক্ষমতায় থাকলেও তারা বোঝে না, বাংলায় এমন একটি রাজনৈতিক সমাজ তৈরি হয়ে আছে, যেখানে সব হিন্দুরা মেরুকরণের পক্ষে নন। অথচ দলটার সমস্যা হল হাতে ‘হিন্দু হিন্দু ভাই ভাই’ ছাড়া আর কোনও অস্ত্র নেই।

শুভেন্দু মনে করছেন, আরও ৪-৫ শতাংশ হিন্দু ভোট পদ্মের ইভিএমে টেনে নিতে পারলেই কেল্লা ফতে হবে। দীর্ঘ প্রচেষ্টা থাকলে সেই কাজটা যে অসম্ভব, তা মনে করার কারণ নেই। সেই আশঙ্কা মমতার আছে। তাই ওই চেষ্টায় চোনা ফেলে দিতে দিঘার মতো রাজসূয় প্রকল্পে হাত দিয়েছেন তিনি। যে প্রকল্পের লক্ষ্য দিঘাকে হিন্দুর গন্তব্য করে তোলা।

সেই উদ্দেশ্য সাধনে তড়িঘড়ি সরকারি পরিবহণ নিগমগুলিকে দিয়ে বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাস চালানো শুরু করে দিয়েছেন। মমতা মাঝে মাঝে সভা-সমিতিতে বলে থাকেন, মানুষের জীবনে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় ৯৯ শতাংশ উন্নয়ন তিনি করে ফেলেছেন। তাঁর সেই ‘৯৯ শতাংশ উন্নয়নের দাবি’ ভোট নিশ্চিত করতে পারছে না বলেই তো মমতার এই প্রসাদের চাল।

Categories
Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

চেতনা, দিশার সংকট

বাম নেতারা প্রায়ই অভিযোগ তোলেন, বাংলায় তৃণমূল ও বিজেপির...

ভরসা মা কালী, বঙ্গ বিজেপি বাঙালি হবে

  আশিস ঘোষ জয় মা কালী। এবার বঙ্গ বিজেপি আঁকড়ে...

উত্তরের নাট্যচর্চায় আশাভঙ্গের হাহাকার

অতনু গঙ্গোপাধ্যায় গঙ্গার উত্তর পারবরাবর জনসমষ্টির শাখা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে...

Baishnab Nagar | দিন-রাত ছানা বানাচ্ছেন বৈষ্ণবনগরের মিষ্টির কারিগররা, বিয়ের মরশুমে কদর ভিনরাজ্যেও    

এম আনওয়ারউল হক, বৈষ্ণবনগর: বিয়ের মরশুম এখন। বিয়েতে তো...