গৌতম সরকার
মাঝে মাঝে শুভেন্দু অধিকারী রসিকতার ছলে হুংকার দেন- এ ডর মুঝে আচ্ছা লাগতা হ্যায়। ‘ডর’ তো আছেই। যে ভয়ে বীরভূমের সোনাঝুরিতে হোলি খেলায় নিষেধাজ্ঞা আচমকা উধাও হয়ে যায়। এমনকি, নিষেধাজ্ঞার অস্তিত্বটিই অস্বীকার করা হয়। সরকার জানিয়ে দেয়, রাজ্যের যেখানে খুশি দোল উদযাপন করতে কোনও বাধা নেই। বাধাটা কিন্তু ছিল। পরিবেশ, প্রকৃতি রক্ষার তাগিদে ফ্লেক্স, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ডে সোনাঝুরিতে সেই নিষেধাজ্ঞার প্রচার দৃশ্যমান ছিল।
বন প্রতিমন্ত্রী বীরবাহা হাঁসদার বিবৃতির পর সেসব রাতারাতি উধাও হয়ে যায়। বনকর্তারা নীরব হয়ে যান। যেমন মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন বনে বাইরের লোকের অবাধ আনাগোনায় নিয়ন্ত্রণ থাকায় মুখ্যমন্ত্রীর ধমক শুনে। শুধু বনাধিকারিকরা নয়, প্রশাসন, পুলিশের কর্তাদের কাছে তাই সর্বনাশ হয় হোক, শাসকের কথাই শেষ কথা। আইন, পরিবেশ চুলোয় গেলে যাক!
সোনাঝুরিতে হোলি খেলতে না দেওয়া মানে হিন্দুধর্মের বিরোধিতা- হুমকি দিয়েছিলেন শুভেন্দু। ভয়ে পিছিয়ে গিয়ে বন প্রতিমন্ত্রী সোনাঝুরিতে নিষেধাজ্ঞাটাই অস্বীকার করলেন। পাছে সোনাঝুরিতে দোলে ওই নিষেধাজ্ঞায় হিন্দু ভোট হুড়হুড় করে পদ্মের বাক্সে চলে যায়। হিন্দু বিরোধী শুনলে এত ভয় যে, খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে বিধানসভায় দাঁড়িেয় বারবার বলতে হয়, তিনি বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির ব্রাহ্মণ কন্যা। তিনি এমনভাবে শোন যাতে মাথা শিবের দিকে থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি।
হোলিতে বন্যপ্রাণ শিকার কোনও কোনও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রথা। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে বন দপ্তরের সচেতনতা সৃষ্টির ফলে আগের মতো শিকার উৎসব হয় না। চোরাশিকার থাকলেও িতরধনুক হাতে নিছক উৎসব পালনে জঙ্গলে আনাগোনা এখন অনেক নিয়ন্ত্রণে। ভয় হয়, কোনদিন না আবার ধর্মীয় জিগিরের ঠেলায় সোনাঝুরিতে দোলের মতো শিকার উৎসবও মান্যতা পেয়ে যায়।
বিরোধী দলনেতার ভারী মজা। তিনি হুংকার (বিশেষ করে ধর্মের নামে) দিলে খোদ মুখ্যমন্ত্রী প্রমাদ গোনেন। তিনি কত বড় হিন্দু প্রমাণে, কয়েক হাজার শব্দ বলে ফেলেন। যদিও খেয়াল রাখেন, তাতে মুসলিম ভোট, খ্রিস্টান, এমন জৈন সমর্থনে যেন ধাক্কা না লাগে। ঘটা করে তাই রমজানে রোজ ইফতারে অংশ নিতে যান। বড়দিনে উৎসবের সূচনা করেন সাড়ম্বরে। জৈন ধর্মের কর্মসূচিতে হাজির হন।
অথচ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখে যা বলেন, তার চেয়ে বড় সত্য আর হয় না। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার- যে কথায় ধর্মনিরপেক্ষতা স্পষ্ট। কিন্তু হিন্দুত্বের প্রতিযোগিতায় তিনি শুভেন্দুর সঙ্গে দড়ি টানাটানিতে নেমে পড়েন। দু’পক্ষই নিজেদের হিন্দু ধর্মের সেরা রক্ষক প্রমাণে মরিয়া। শুভেন্দু নিজেই বলেছেন, তাঁর পাতা ফাঁদে পা দিয়েছেন মমতা। সেজন্য তাঁর নাকি ভারী মজা। মজাটা সত্যিই মজা কি না, প্রমাণ হবে ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে। আস্তিনের শেষ তাসটা যে খেলে ফেলেছেন কাঁথির অধিকারী পরিবারের মেজো ছেলে। তাসটা হিন্দুত্বের। কানু বিনে আর গীত নেই-এর মতো হিন্দুত্ব বিনা এখন কথা নেই অমিত শা’র এই কট্টর ভক্তর মুখে। ভক্তপ্রাণ হিন্দু যেমন মাঝে মাঝে মন্দির দর্শন করেন, শুভেন্দুর তেমনই দিল্লি গেলে অমিতের সঙ্গে একান্তে কথা বলে আসাটা নিয়ম হয়ে গিয়েছে।
একসময় রোজ দুর্নীতির কথা শোনা যেত নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করে নির্বাচিত বিধায়কের মুখে। মাঝে মাঝে বলতেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্নীতির বিস্ফোরক তথ্য সব তাঁর কাছে মজুত আছে। দিন-তারিখ দিয়ে আগাম ঘোষণা করতেন, সব কেলেঙ্কারি সামনে আনবেন তিনি। কিন্তু হা হতোস্মি! সেই দিন-তারিখ আর এল না। কয়েকদিন আগে কালীঘাটের কাকুর এক অডিও ক্লিপে প্রবল হইচই হল। ওই ক্লিপে নাকি অভিষেকের কোটি কোটি টাকা চাওয়ার উল্লেখ আছে।
কিন্তু সেই ক্লিপ নিয়ে শুভেন্দুকে খুব রণংদেহি মনে হল না। প্রশ্নটা অপ্রাসঙ্গিক নয় যে, ক্লিপে অকাট্য প্রমাণ থাকলে সিবিআই-ই বা অভিষেককে ধরছে না কেন? তাছাড়া কোন অভিষেক, তৃণমূল নেতা অভিষেক কি না, তা নিয়ে সিবিআইয়ের রিপোর্ট যেন ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোত্রের। শুভেন্দু এত বড় অভিযোগেও তেমন রা কাড়লেন না। বোঝা যাচ্ছে দুর্নীতি বিরোধী জেহাদ থেকে রণে ভঙ্গ দিয়েছেন তিনি।
এখন হিন্দুত্বের চ্যাম্পিয়ন শুভেন্দু। ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের জন্য আস্তিনে লুকোনো শেষ তাস খেলা শুরু করে দিয়েছেন। এক বছর আগে থেকেই। বিধানসভার ভিতরে হোক বা বাইরে, রাজ্য সরকার ও তৃণমূলকে হিন্দু বিরোধী তকমা লাগিয়ে দিতে দিন-রাত এক করছেন। হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, দিল্লির মতো হিন্দুত্বেই পশ্চিমবঙ্গ কামাল বলে যিনি মনে করছেন। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত সদ্য বাংলায় সাতদিন কাটিয়ে যাওয়ায় সম্ভবত আরও বল পাচ্ছেন শুভেন্দু।
আরএসএস যে সর্বশক্তি দিয়ে বাংলায় ঝাঁপাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। সংঘ এর আগেও চেষ্টা কম করেনি। কিন্তু বিদ্বেষ, বিভাজন চাগিয়ে দিয়ে হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করার কৌশল অতীতে তেমন কাজে লাগেনি বাংলায়। বরং বিজেপির অনেক নেতাও মনে করেন, তৃণমূলের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ থাকলেও শুধু এই কৌশলটায় বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত ইভিএমে গিয়ে ঘাসফুলে ছাপ দিয়ে আসে হিন্দুদের একাংশ।
দুর্নীতি, অপশাসনকে সামনে রেখে ইভিএমে পদ্ম বিপ্লব ঘটাতে ব্যর্থ শুভেন্দুরা। ২০২৬-এ হিন্দুত্বই তাঁদের আস্তিনের শেষ তাস। শেষ তাস দিয়ে খেলাটা কিন্তু ভয়ংকর। তৃণমূল বিরোধী হাওয়া আর মেরুকরণের চেষ্টা এক বিন্দুতে না মেলাতে পারলে বড় ঝুঁকির খেলা। খেলায় তৃণমূলও হিন্দুত্ব নিয়ে নেমে পড়লে ঝুঁকিটা কমবে। বাংলায় তাই শেষ পরীক্ষা মেরুকরণেরও।