শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

মানচিত্র পালটেই চলিস রে কেন তিস্তা!

শেষ আপডেট:

রূপায়ণ ভট্টাচার্য

সেবকের করোনেশন ব্রিজ থেকে রংপোর অটল সেতু- ৫৪ কিলোমিটার তিস্তার হাত ধরে যাচ্ছেন হয়তো। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার মতো দৃশ্যপট তৈরি হয়ে যায়, যেখানে তাঁর যেতে যেতে নদীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

‘পায়ে তার ঘুঙুর বাঁধা/ পরনে উড়ু উডু ঢেউয়ের/ নীল ঘাগরা।’

তিস্তাও ওভাবে ঘুঙুরের শব্দ তোলে। শুধু নীল নয়, তার ঘাগরার রং মেটে। যুদ্ধ হাওয়ায় গুজবের যুদ্ধ ভুলতে ওই পরিক্রমা। মাঝে টুকরো টুকরো চিত্রপট মাথায় গেঁথে যায়। ২০২৩ সালের অক্টোবরের চিহ্ন এখনও পািরপার্শ্বিকতায় জেগে। গেলখোলার কাছে কিছু বাড়ির শুধু ছাদটুকু দেখা যাচ্ছে বালুর তলায়। ত্রিবেণিতে ভগ্নস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে জনশূন্য ভাঙা বহুতল- সেখানে রঙ্গিতের জল সবুজ, তিস্তার জলের রং মাটির।

মল্লির যে সেতুর ওপারে সিকিম, তার গা ঘেঁষে নদীর ধারে ছোট স্টেডিয়াম। এখানেই হয়তো বাইচুং, নির্মল ছেত্রী বা সঞ্জু প্রধানের মতো অনেক তারকা নিয়মিত খেলেছেন। স্টেডিয়াম আমাদের বাংলার ছোট শহরগুলোর মতো আধাখ্যাঁচড়া হয়ে পড়ে নেই। অনেক গোছানো। হলে কী হবে, ওই অক্টোবরের কালরাতের পরে পরিত্যক্ত। বালু আজও জমে নদীর ছোবলে। তিস্তা সেখানেও দুঃখী নারীর মতো দাঁড়িয়ে। দু’দিকেই অনেকটা বালুচর উঁকি দেয় বিহারের গঙ্গা, উত্তরপ্রদেশের যমুনা, দক্ষিণবঙ্গের অজয়ের মতো।

সামান্য আগে দেখে এসেছি, ত্রিবেণিতে শীর্ণ রঙ্গিতের সঙ্গে মিশছে তিস্তা। বর্ণহীন, শব্দহীন নদীসংগম। ওখানে একদা গিজগিজ করত মানুষ। এখন শূন্যতা, শূন্যতা এবং শূন্যতা। সবচেয়ে বড় বাড়িটা ভগ্নস্তূপ। কিছু নেই চারপাশে। তিস্তাবাজার থেকে ওখানে যাওয়ার পাথরের পথ একদা ঝিঁঝিপোকায় সরগরম ছিল। এতদিন পরেও উধাও। ওদিকে এখনও যেতে পারে না কেউ। লোককে যেতে হবে তিস্তা পেরিয়ে।

র‌্যাফটিং নিয়ে যাঁরা বাণিজ্য করতেন, তাঁরা করবেন কী? চুপ করে তো আর বসে থাকবেন না। এখন মল্লির আগে এবং পরে দুটো জায়গায় আবার জমজমাট র‌্যাফটিং ব্যবসা। প্রথম জায়গাটিতে কার্যত মেলা বসে গিয়েছে জাতীয় সড়কের ধারে, আবার রমরমা। তিস্তাবাজার ব্রিজের পর থেকেই এদের উপস্থিতি বোঝা যাবে। বড় গাড়ির মাথায় বোট লাগানো, সব দাঁড়িয়ে। সেখান থেকেই আগ্রহীদের তুলে নেওয়া হচ্ছে।

দুই অ্যাডভেঞ্চার স্পটে দাঁড়িয়ে যা বুঝলাম, এখনও অবৈজ্ঞানিকভাবে চলছে সব। সতর্কতা খুব কম। আবার বড় দুর্ঘটনা হলে রাজ্য সরকারের ঘুম ভাঙবে, নইলে চলেছে চলছে চলবেই। ত্রিবেণি মাহাত্ম্য এখানে পাওয়া কঠিন। নদীর সেই বৈচিত্র্যও নেই সেখানে। জাতীয় সড়ক এখন কেন্দ্রের হাতে। ভালো করে সাজানো হচ্ছে। তারপর এই দুটো জায়গা কী দাঁড়ায়, সেটাই প্রশ্ন।

কালিঝোরা, লোহাপুল, রম্বি, গেলখেেলা, ২৯ মাইল, তিস্তাবাজার, মল্লি, রংপো- ছোট ছোট সব জায়গায় রাস্তার দু’ধারে অনেক বড় বড় বাড়ি, হোটেল। এরা ছাড়পত্র পায় কীভাবে, এগুলোর ভবিষ্যৎ কী? ২৯ মাইলের পরিস্থিতি অবশ্য বদলেছে ভয়ংকরী তিস্তার হানার পর। অনেক জায়গাতেই হোটেলগুলো টিমটিমে, আগের ভিড় নেই।

এসব কথা নয় থাক। দেখতে এসেছি সেবক থেকে রংপো সীমান্ত পর্যন্ত তিস্তা পালটে গিয়েছে কীভাবে। রংপোর আগে টুমলাং ব্রিজ পেরিয়ে সুখিয়াখোলার দিকে যাচ্ছি। সেখানে দু’তিনটি হোটেল নদীর ধারে। তার ঠিক পিছনে শীর্ণ তিস্তার ওপারে উঁচু হয়ে রয়েছে বালির স্তূপ। অনেকটা বড়, টিলার মতো। তার ওপরে পতাকা দিয়ে সাজিয়ে বড় কিছু একটা হবে। স্থানীয় মানুষ বলতে পারেন না, কী হবে ওখানে। খেলা, না পিকনিক?

বাঁক তো তিস্তা নিয়েই থাকে, একেবারে সেবক থেকেই নিয়ে চলেছে নিজস্ব স্বর্গীয় নিয়মে। তবে সুখিয়াখোলার এখানে বাঁকটা অনেকটাই বড়। একটু এগোলে সিকিমের জনমানবশূন্য পাহাড় থেকে বিশাল ঝরনাধারার ইঙ্গিত। বৃষ্টি চলছে তখন। তবু সেই ঝরনাধারা শুকনো, খটখটে। তিস্তার জলধারা ছোট। পাথর এবং বালুর মধ্যে আটকে। সেই গর্জন নেই।

ওহ হ্যাঁ, বলাই হয়নি। একটি অত্যাশ্চর্য, স্বপ্নের দৃশ্য দেখে এসেছি তিস্তাবাজারে, পুরোনো ভাঙা পুল ঘেঁষে। কার্যত মাঝতিস্তায় ক্রিকেট খেলছে পাঁচ কিশোর। মাঝখানে জেগে ওঠা ছোট চরের ওপর। সম্ভবত অনেকের বাড়ির পুরোটাই ভেঙে এসেছিল নদীগর্ভে। এখন জেগে উঠেছে কিছুটা। ওপরের সামান্য অংশ ক্রিকেট পিচের মতো। সেখানেই খেলা চলছে। কিছুটা জলধারা হেঁটে পেরিয়ে ওখানে এসেছে তারা। একজন ফিল্ডিং করছে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে।

ওই পঞ্চপাণ্ডবের নাম অনায়াসে হতে পারত শচীন-রাহুল-সৌরভ-বীরেন্দ্র-লক্ষ্মণ। জানি, তা সম্ভব নয়। পাহাড়ের মাঠে প্রচুর ছেলেমেয়েকে ফুটবল খেলতে দেখেছি সকাল থেকে সন্ধে। তাদের বিজ্ঞানসম্মত ট্রেনিং দিয়ে তুলে আনার চেষ্টা তো হয়নি। তিস্তাবাজারের ওই কিশোর ক্রিকেটাররাও জলস্রোতের মতো হারিয়ে যাবে জনস্রোতে।

তিস্তা এই সময়ে আরও কত পালটাবে, আরও কত পালটাবে তিস্তা? বছরের এই সময়টা পাহাড় অনেকটা রুক্ষ। সবুজ গাছপালা কম। দূর থেকে অতি সহজে বোঝা যায়, কত দূরে, কত ঘুরে কত উপরে উঠতে হবে। একবার মারাত্মক খাদে, বহু নীচে। একবার হাতের কাছে, পাশাপাশি। অথচ এখন স্পষ্ট বোঝা যায়, কীভাবে মাঝে মাঝেই তিস্তার মাঝে চর জেগে উঠেছে। পাহাড়ে তিস্তাবাজার থেকে গেলখোলা পর্যন্ত তিস্তায় ভালো জল এখনও। সেই পুরোনো স্রোত, সেই পুরোনো ভয়ংকর চোরা টান। তবু সেখানেও তো এত চর, এত বালু, এত পাথর, এত ধ্বংসস্তূপ। পুরোনো মানচিত্র ভাবলে বোকা বনতে হবে।

স্থানীয় লোকজন সর্বত্র আগের আতঙ্ক থেকে বলছেন, বৃষ্টি এলে ছবি বদলাবে। পাশাপাশি এটাও বলছেন, তিন বছর আগেও এই মে মাসে অনেক বেশি জল, অনেক বেশি গভীরতা ছিল। তা হলে কি নিখিলেশকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা লেখার স্টাইলে তিস্তা বলে দিতে পারে মানুষকে—‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি, তুই এসে দেখে যা মানুষ/ এই কি নদীজন্ম… মানুষ, আমি এই- রকম ভাবে বেঁচে আছি, তোর সঙ্গে/ জীবন বদল করে কোনও লাভ হল না আমার- এ কি নদীর তরঙ্গে/ ছেলেবেলার মতো ডুবসাঁতার?’

সীমান্ত শহর রংপো পর্যন্ত হাত ধরাধরি করে যাওয়ার পর এবার তিস্তার হাতছাড়ার পালা। কালিম্পং জেলা পুলিশের শেষ ট্রাফিক গার্ডের ছবির মতো ছোট বাড়ির সামনে দেখা বাংলা ও সিকিমের কয়েকজন তরুণের সঙ্গে। সবার এক কথা, শৈশবের তিস্তার সঙ্গে আজকের তিস্তার মিল নেই কোনও। দু’বছর আগের সেই ভয়ংকর দিনের আগে থেকে তিস্তার মেজাজ ও মানচিত্র পালটে গিয়েছে।

সিকিমের তরুণদল ফিরে যাবেন নতুন অটল সেতু দিয়ে। নীচ দিয়ে যাচ্ছে রংপো নদী। তিস্তা-রঙ্গিতের পর সিকিমের তৃতীয় বৃহত্তম নদী। বাংলা-সিকিম সীমানা ভাগের আর এক কারিগর। সিকিমের দিকে বাড়িঘর বহুতল, সাজানো। বাংলার দিকে ততটাই অগোছালো। রংপো নদীটি শীর্ণ। দু’দিকে অনেকটাই চর পড়ে গিয়েছে, ঘাস উঠে গিয়েছে অনেক জায়গায়। বাংলার প্রান্তে গোরু পর্যন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সিকিিমজ তরুণ রাজু হাঁটতে হাঁটতে অটল ব্রিজের মাঝপথে দাঁড়িয়ে বলল, ‘রংপোর এই অবস্থা ছিল না আগে। জল নেই। তিস্তায় আর কত জল যাবে?’ এক জাতীয় কথা শুনিয়েছিল ড্রাইভার চেতন, জোরথাং শহর ঘেঁষে চলা রঙ্গিত নদী দেখিয়ে। ‘আগের রঙ্গিতের তুলনায় এই রঙ্গিত সম্পূর্ণ ছায়া। তিস্তাকে কতটা জল দেবে?’ বিশেষজ্ঞরা বলবেন, কত কিউসেক জল আগে থাকত তিস্তার। এখন কতটা কমেছে। সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা ওই কিউসেকের বাইরে গিয়ে চোখের জলই মাপে। রংপো থেকে তিস্তা যখন পুরোপুরি সিকিমের গভীরে ঢুকে পড়ল, তখনও কিন্তু সে বেশ রুগ্ন। আগের ঝংকার নেই।

পাহাড়ি তিস্তায় যে দুটো বাঁধ বাংলায়, তার মাঝে রিয়াং নদীটি মিশেছে তিস্তায়। সেই নদী কার্যত আরও মরা যেন। একটা বিস্তৃত অঞ্চল মাটি, পাথর, বালিতে ঢাকা। তিস্তা কীভাবে আরও গর্জনের শব্দ পাবে? আপনি শিলিগুড়ি থেকে সেবক আসার আগে একটু আগে ডানদিকে তাকান। গজলডোবার দিকে দৌড়ানো তিস্তার আসল বিস্তার েদখতে পাবেন। এখন গাছপালা কম একটা জায়গায়, সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। বাগ্রাকোটের নতুন লুপ পুলে মোক্ষম জায়গা বাছলেও ইঙ্গিত পাবেন তিস্তার ভয়ংকরী রূপের। সেখানেও বালি, মাটিই বেশি। ওখানে আবার এশিয়ান হাইওয়েতে ব্রিজের প্রস্তুতি চলছে। সেই মানচিত্র বদলে যাওয়ার চিন্তা বারবার ভাবাবে আপনাকে। ভাবাবেই।

গজলডোবা, জলপাইগুড়ির দোমোহনি, হলদিবাড়ির জয়ী সেতুতে তিস্তার ওপরে দাঁড়ালে মানচিত্রের রূপান্তর ওইভাবে ভাবায়। চারপাশের পরিচিত মানুষরা অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝাতে থাকেন সাম্প্রতিক অতীতের তিস্তা আর বর্তমান তিস্তার পরিবর্তন।

সমতলের তিস্তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, শিলিগুড়ির ছেলে রাজীব মিত্র। কথা হচ্ছিল রাজীবের সঙ্গে। তাঁদের পর্যবেক্ষণে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ উঁকি পাড়ে। এক, ক্রমে আরও পূর্বদিকে বইছে তিস্তা। ১৭৮৭ সাল নাগাদ যে তিস্তা গঙ্গার সঙ্গে মিশত, আজ সে সরে গিয়েছে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গিনী হতে। দুই, ১৯৯৩ থেকে ২০২৩, এই তিরিশ বছরে তিস্তার পথবদল অত্যন্ত চোখে পড়ার মতো।

রংপোর ঝকঝকে নতুন ব্রিজে বাংলা ঢোকার সময় জাতীয় সড়কের সবুজ হোর্ডিংয়ে লেখা– কালিম্পং ৩৬ কিমি। সেবক ৫৪ কিিম। শিলিগুড়ি ৭৬ কিমি। আরও সেখানে লেখা– ওয়েলকাম টু ওয়েস্ট বেঙ্গল দ্য সুইটেস্ট পার্ট অফ ইন্ডিয়া। ভারতের মধুরতম অংশ পশ্চিমবঙ্গে আপনাকে স্বাগত। পাশেই তিস্তা। কলকল ছলছল শব্দের তিস্তা।

সেখান থেকে আর একবার তরঙ্গ ওঠে মনের গভীরে। তিস্তা, তুই আরও পথ পালটাবি কী েভাবে, বলে দিয়ে যা!

আসুক গহন মেঘের ছায়া। আসুক বৃষ্টি। বসে আছি তার আশায়। দেখি তুই কত বদলাস!

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

পঁচিশে বৈশাখ কেন যে একদিনে শেষ হয়

আশুতোষ বিশ্বাস এক সপ্তাহ আগে পঁচিশে বৈশাখ পেরিয়ে গেল তো...

ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না

রূপায়ণ ভট্টাচার্য মাননীয় জাতীয় প্রেসিডেন্ট শ্রী জেপি নাড্ডাজি আমাকে ফোন...

গ্রামের ছাত্রীরা যখন শহরে পড়তে যায়

মৌবনী মোহন্ত কাঁটাতার রয়েছে মেখলিগঞ্জ থানার সেই প্রত্যন্ত গ্রামে। নাম...

আওয়ামী নিষিদ্ধে চাপে হাসিনা, ভারতও

অমল সরকার গত বছর ৫ অগাস্টের পর থেকেই বাংলাদেশে আওয়ামী...