পঙ্কজ মহন্ত, বালুরঘাট: রিজওয়ান খানকে মনে আছে? কিংবা ঝিলমিল?
করন জোহর পরিচালিত ‘মাই নেম ইজ খান’ ছবিতে রিজওয়ানের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শাহরুখ খান। এই চরিত্রটিকে নিয়ে কম কাটাছেঁড়া হয়নি।
ঝিলমিলকে নিয়ে বরং কাটাছেঁড়া কম হয়েছে। অনুরাগ বসুর ‘বরফি’ ছবিতে প্রিয়াংকা চোপড়া অভিনীত এই চরিত্রটিকে ভালোবেসেছে কুড়ি থেকে তিনকুড়ি সবাই। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সিনেমা হলেও রিজওয়ান এবং ঝিলমিলের মধ্যে একটা ব্যাপারে খুব মিল। দুজনেই অটিজমের শিকার।
এরা কাল্পনিক চরিত্র হলেও বাস্তবে আমাদের চারপাশে রিজওয়ান, ঝিলমিলরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এক আকাশ নীরবতা ভেঙে হঠাৎ জেগে ওঠে তারা। এই যেমন বালুরঘাটের (Balurghat) শ্রিয়া সাহা। সে-ও ঝিলমিলের মতো অটিজমের শিকার। তার গল্পটাও নেহাত কম ড্রামাটিক নয়।
পাঁচ বছর আগে যে মেয়েটার কথা বলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সে-ই হঠাৎ একদিন তার মা প্রিয়াংকা সাহাকে বলল, ‘একটা কবিতা বলব?’ মা-ও অবাক! তাঁর চোখের কোণে জল। নোনতা নয়, মিষ্টি। রবিবার সন্ধ্যায় নাট্যতীর্থ মন্মথ মঞ্চে তখন ঠাসা দর্শক। মাইক হাতে নিয়ে নির্ভয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ছোট গল্প’ কবিতাটা শোনাল ছোট্ট শ্রিয়া।
স্রেফ আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ ছয় বছরের অটিস্টিক শিশু শ্রিয়া। বর্তমানে কবিতায় ভরে উঠেছে তার কণ্ঠ। আর শ্রিয়ার মতো শিশুদের ফিরে আসার নেপথ্যে জরিবুটির কাজ করেছে ‘স্পিচ থেরাপি।’
কীভাবে বদলে গেল শ্রিয়ার জীবন? করোনা পরবর্তী সময়ে আচমকা কথা বলা বন্ধ হয়ে যায় এই শিশুর। কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি পরিবার। এমনকি চোখে চোখ রাখাও বন্ধ করে দেয় সে। কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে বুঝতে পেরে কলকাতার এক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যান বাবা-মা। পরীক্ষানিরীক্ষার পর চিকিৎসক জানান, শ্রিয়া ‘মাইল্ড অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারে’ আক্রান্ত। চিকিৎসার পথ কী? স্পিচ থেরাপি।
কিন্তু বললেই তো আর হয় না। কলকাতা-বালুরঘাটের দূরত্ব শ্রিয়ার চিকিৎসায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। ছোট শহরে এমন পরিকাঠামো না থাকায় কার্যত দিশেহারা অবস্থা হয় বাবা সমীর সাহার। তারপরেই হঠাৎ খোঁজ পান আবৃত্তি শিল্পী বর্ণালি সরকার ঘোষের। তিনি আবৃত্তির পাশাপাশি নিজের মুনশিয়ানায় শিশুদের স্পিচ থেরাপিও দেন।
তিন মাস আগে শ্রিয়াকে ভর্তি করা হয় সেখানে। তারপরেই ইউরেকা! বর্ণালি বলছিলেন, ‘প্রথম যেদিন শ্রিয়া আসে, কোনও কথা বলত না। চোখে চোখ রাখত না। আমি ওর সঙ্গে খেলার মতো করে কাজ শুরু করি। ছন্দ, শব্দ আর কবিতার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সে মুখ খোলে।’
মেয়ের এই পরিবর্তনে যারপরনাই খুশি প্রিয়াংকা। তাঁর কথায়, ‘লকডাউনের সময় ওর আচরণ একেবারে পালটে যায়। অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারছিলাম না। আজ ও কবিতা বলছে। এই দৃশ্য দেখে চোখে জল চলে আসে।’
শ্রিয়া যখন মঞ্চে উঠে আবৃত্তি করে, দর্শকরাও স্তব্ধ হয়ে যান। হাততালিতে ফেটে পড়ে গোটা হল। বর্ণালি জানান, শুধু শ্রিয়া নয়, আরও অনেক শিশু রয়েছে তার মতো। স্পিচ থেরাপি এবং আবৃত্তির সমন্বয়ে ওদের মধ্যে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠছে।’ শ্রিয়ার গল্পটা আরও অনেক অটিস্টিক শিশুকে অনুপ্রেরণা জোগাবে, এ কথা এখন হলফ করেই বলা যায়।