মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫

লালনকে মুছলে আরও বিপন্ন বাংলাদেশ

শেষ আপডেট:

 

  • অংশুমান কর

অশান্ত বাংলাদেশে মৌলবাদ যে ক্রমশ মাথাচাড়া দিচ্ছে তা বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ক’দিন আগেই তসলিমা নাসরিনের বই স্টলে রাখার জন্য হামলা করা হল অমর একুশে গ্রন্থমেলায় সব্যসাচী প্রকাশনার স্টলে। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই বন্ধ হয়ে গেল লালন স্মরণ উৎসব, যে আয়োজনটি সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ টাঙ্গাইলের মধুপুরে। ২০১৭ সালে টাঙ্গাইলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল লালন সংঘ। এই সংঘই প্রতিবছর এই লালন উৎসবের আয়োজন করে থাকে। এবছর এই আয়োজনটি করা গেল না, তার কারণ মধুপুর হেফাজতে ইসলাম এই অনুষ্ঠানটি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। স্মরণ অনুষ্ঠানটি যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায় তাই হেফাজতে ইসলামের তরফে অনুষ্ঠান বন্ধ করার হুমকি দেওয়ার পরেই হেফাজতের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ১১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে একটি বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন লালন সংঘের কর্তাব্যক্তিরা। কিন্তু সেই বৈঠকেও বরফ গলেনি।

সাম্প্রতিক অতীতে এই প্রথম লালন উৎসব বা লালন-স্মরণ যে বন্ধ হয়ে গেল বাংলাদেশে, এমনটা নয়। গতবছরের নভেম্বর মাসেও এই ঘটনা ঘটেছিল। দশ বছর ধরে চলা ‘লালনমেলা’ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল নারায়ণগঞ্জে। সেবারও এই মেলা বন্ধে হুমকি এসেছিল হেফাজতে ইসলামের তরফেই। হুমকির বহর ছিল এমনই যে, বিভিন্ন জায়গা থেকে লালনভক্তরা এসে মেলা প্রাঙ্গণে জড়ো হওয়া সত্ত্বেও জেলা প্রশাসন শেষপর্যন্ত মেলার অনুমতি দেয়নি।

 সেই লালনমেলার আয়োজক ছিলেন ফকির শাহাজালাল। মেলাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে, মেলাটি আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য তাঁকে পড়তে হয়েছিল হুমকির মুখে। নারায়ণগঞ্জের মেলাটি বন্ধ করে দেওয়ার পেছনে হেফাজতে ইসলাম একটি অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছিল। এই সংগঠনটির নেতারা বলেছিলেন, ওই মেলাতে নাকি অপসংস্কৃতির চর্চা করা হয়! তাঁদের আপত্তির পরেও যদি মেলার আয়োজন করা হয় তাহলে যে কোনওভাবে মেলাটিকে ভন্ডুল করে দেওয়ার হুমকিও তাঁরা দিয়েছিলেন। এই হুমকির উলটো দিকে দাঁড়িয়ে নারায়ণগঞ্জের সংস্কৃতিকর্মীরা পালটা কর্মসূচি পালন করেছিলেন নারায়ণগঞ্জ শহরে। কিন্তু তাতে লাভ কিছু হয়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে এই অজুহাত দিয়ে মেলার অনুমতি দেয়নি জেলা প্রশাসন।

নারায়ণগঞ্জের মেলাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে বাংলাদেশের মুক্তমনা উদারপন্থী চিন্তকদের অনেকেই বলেছিলেন যে, লালনমেলায় অপসংস্কৃতির চর্চা হয়- হেফাজতের এই যুক্তি নেহাত অজুহাত মাত্র। হেফাজতে ইসলাম চায় না লালনের মতাদর্শের প্রচার।

টাঙ্গাইলের মধুপুরের লালন স্মরণ উৎসব বন্ধ করার জন্য যে-হুমকি হেফাজতে ইসলাম দিয়েছে, তা কিন্তু প্রমাণ করেছে উদারপন্থী চিন্তকরা যে আশঙ্কা করেছিলেন, তাই সত্য। মধুপুরের হেফাজতে ইসলাম শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল্লাহ পরিষ্কার জানিয়েছেন, লালন স্মরণ উৎসব বন্ধ করা হয়েছে, কারণ ইসলামের সঙ্গে অনুষ্ঠানটির মতবিরোধ আছে। অর্থাৎ, লালনের মতাদর্শের সঙ্গে ইসলামের সংঘাত রয়েছে।

সত্যিই ইসলামের আদর্শের সঙ্গে লালনের মতাদর্শের কোনও বিরোধ আছে কি না তা গূঢ় দার্শনিক প্রশ্ন। সে প্রশ্নের উত্তর এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে না খোঁজার চেষ্টা করাই ভালো। এইটুকু বরং বেশ জোরের সঙ্গেই বলা যায় যে, হেফাজতে ইসলাম মনে করছে লালনের উদার, মানবতাবাদী, ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে-ওঠা মতাদর্শটি তাদের জন্য বিপজ্জনক। এই ধারণাটি মান্যতা পায় লালন স্মরণ উৎসবের সংগঠকদের একটি কথা থেকেও। এই উৎসবের আয়োজক সবুজ মিয়াঁ একটি সংবাদপত্রকে জানিয়েছেন যে, হুমকি এসেছিল এই মর্মে যে লালনের মতাদর্শ মধুপুরে প্রচার করতে দেওয়া হবে না। যে লালন লিখেছিলেন, ‘সুন্নত দিলে হয় মুসলমান/নারীলোকের কী হয় বিধান’, কট্টরপন্থী মুসলিমরা যে তাঁকে এক কালাপাহাড় হিসেবেই দেখবেন তা বোধহয় প্রত্যাশিতই।

দুটি ঘটনার ক্ষেত্রেই চিন্তার হল প্রশাসনের অবস্থান। দুটি ক্ষেত্রেই ধর্মীয় নেতাদের হুমকির কাছে মাথা নত করেছে প্রশাসন। হুমকির কাছে মাথা নত না করে প্রশাসনের উচিত ছিল লালনমেলা এবং  লালন স্মরণ উৎসবকে সংগঠিত করতে সাহায্য করা। প্রশাসন তা করেনি। একই কথা প্রযোজ্য বইমেলায় সব্যসাচীর স্টলে হামলা প্রসঙ্গেও। সরকারি বিবৃতিতে ঘটনার নিন্দে করা হলেও একজন হামলাকারীকেও গ্রেপ্তার করা হয়নি। উলটে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সব্যসাচী প্রকাশনার শতাব্দী ভবকে।

একইভাবে সরকার নীরব দর্শক হয়ে দেখেছে ৩২ ধানমন্ডি রোডে শেখ মুজিবুর স্মৃতিধন্য বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নীরব থেকেছে সাতক্ষীরার বইমেলায় বামপন্থী মতাদর্শের সংগঠন উদীচীর স্টলে হামলা হওয়ার সময়ও।

এ নিয়ে কোনও দ্বিমত থাকতে পারে না যে, শেখ হাসিনার আমলে অন্যায় হয়েছে বহু। জাতিসংঘের রিপোর্টেও একথা স্পষ্ট করা হয়েছে, জুলাই গণ অভ্যুত্থানে বলপ্রয়োগ করে, পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছে ছাত্রছাত্রী সহ অসংখ্য নিরীহ মানুষকে। এই ক্ষত এখনও বাংলাদেশের স্মৃতিতে দ্গদগে।

একথাও মানতেই হয়, জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পরে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও একটি মূলগত পরিবর্তন হয়েছে। এত সহজে ওই দেশে শান্তি আসবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল, শান্তি স্থাপন করার ক্ষেত্রে নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী ইউনূস ও তাঁর সরকারের সদিচ্ছা কতটুকু? মুখে তাঁরা শান্তির কথা বলছেন বটে, কিন্তু কাজে সে কথার প্রতিফলন ঘটছে না। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের একটি নিউজ পোর্টালকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে ইউনূসের প্রেস উপদেষ্টা শফিকুল আলম বলেছেন, ‘আপনি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, নাস্তিক- যা খুশি হতে পারেন। যে কোনও লিঙ্গের হতে পারেন। মানবাধিকারই সবচেয়ে বড় কথা।’

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের প্রেস উপদেষ্টা মুখে একথা বলছেন বটে, কিন্তু মানবাধিকার রক্ষণে সরকার কতখানি উদ্যমী এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ঠিক যেমন লালনমেলা ও লালন স্মরণ উৎসব বন্ধ করে দেওয়ার পরে হাস্যকর ঠেকছে শফিকুল আলমের বলা এই কথাটিও যে, তাঁদের চিন্তায় ‘নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র আছেন। লালন ফকির আছেন’।

ইউনূস সরকারের বোঝা উচিত যে, কোনও ধরনের ধর্মীয় সংগঠনের চাপের কাছে মাথা নত করা আসলে বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়া।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কবি সোহেল হাসান গালিবের গ্রেপ্তার এই বার্তাই দিচ্ছে। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পক্ষ নিয়েছিলেন গালিব। কিন্তু একটি কবিতায় তিনি নবির অসম্মান করেছেন মৌলবাদীরা এই দাবি তোলায়, তাঁকে জেলে পুরতে বাধ্য হয়েছেন ইউনূস সরকার। ইউনূস সরকার কথায় ও কাজে ফারাক দেখাতে থাকলে, এই ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে আরও ঘটবে।

শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়া ইউনূসের মনে রাখা উচিত যে, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব বিশেষ করে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। দায়িত্ব মাজার-মন্দিরে হামলা রোখা। নতুন সংবিধান রচনা করার চেয়ে এই কাজ কোনও অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও ক্রমশ সংঘটিত হতে শুরু করেছে। হিন্দু এবং মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়েরই কট্টরপন্থী মানুষজনের মুখোমুখি সংঘর্ষ বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য ভালো কোনও বার্তা বয়ে আনবে না। মনে রাখা উচিত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে মূলগত তফাত রয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে বলিদান দিয়ে বাংলাদেশ শান্ত ও সুস্থির থাকবে না। লালনকে বাদ দিলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। আশা করি দেশটির বর্তমান কান্ডারি স্মরণে রেখেছেন যে, দেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই উপমহাদেশের ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে লিখেছিলেন, ‘‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কান্ডারি! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার!’

(লেখক সাহিত্যিক, অধ্যাপক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

পনেরোর নামতায় বুধরামদের দুঃস্বপ্ন

  সুকান্ত নাহা বুনোট ন্যাড়া হয়ে যাওয়া জমিটা এখন প্রায়...

মিল-অমিলের যুদ্ধে যাদবপুর-জেএনইউ

  জয়ন্ত ঘোষাল জেএনইউ এবং যাদবপুর যেন দু’ভাই। যদিও দুজনের...

পাহাড়ে হোমস্টে বিপ্লবে লাল সংকেত

প্রশান্ত মল্লিক কুড়ি-বাইশ বছর আগে, যখন হোমস্টে পর্যটনের ধারণা সবেমাত্র...

যোগেন মণ্ডল : এক ইতিহাসের নায়ক

অশোক ভট্টাচার্য ১৮৭২ সালের জনগণনা থেকে জানা যায়, অবিভক্ত বাংলার...