- অজিত ঘোষ
প্রাবন্ধিক নীরদচন্দ্র চৌধুরী ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ গ্রন্থ রচনায় রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘কোনও কিছু যদি সমাজের অধিকাংশ মানুষের পছন্দসই হয়, তা হলে তা নিয়ে যদি কেউ মৃদুতম আপত্তিও জ্ঞাপন করেন, সেই ব্যক্তির উপর তাঁরা হাড়ে হাড়ে চটে যান।’’
আমরা নির্বাক দর্শক৷ পাছে কেউ চটে যায় সেই ভয়ে দাপট দেখিয়ে বলতে পারছি না, সম্প্রতি ইংরেজি নতুন বছরের সেলিব্রেশনে দেদার শব্দবাজির সংস্কৃতি আমাদের নয়৷ দুর্গাপুজো বা দীপাবলির আলোর স্নিগ্ধতা এই শব্দবাজিতে নেই৷
কবির ভাষায়, আমি আর আপনি দুর্নীতি করলে যেমন দুর্নীতিটা দুর্নীতি বলে মনেই হবে না, তেমনই আমরা হয়ে উঠছি অন্য সংস্কৃতির মানুষ৷ স্পষ্ট হল নতুন বছর বরণে রঙিন পানীয় বিক্রির পরিমাণটা দেখে৷ ‘বড়দিন’ থেকে ‘বর্ষবরণ’- এই সাতদিনে মদের বিক্রি হয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার৷ পরিসংখ্যান বলছে, বছরে বিক্রি দু’হাজার কোটি টাকার অর্ধেক বিক্রি বর্ষবরণেই৷ পাল্লা দিয়ে বিকিয়েছে যৌনতার উপকরণও৷ নতুন বছরকে আমন্ত্রণ জানানোর সাজসজ্জায় অবাক হতে হয় বাঙালির সংস্কৃতিকে হত্যা করার উন্নাসিকতা দেখে৷ জন্মদিনে কাটা কেকের মাখামাখি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে চটুল নাচ তো রুটিন ব্যাপার৷
সংস্কৃতির মৃত্যু নেই৷ জন্ম আছে৷ এই জন্ম আদতে যুক্ত হওয়া৷ এক সংস্কৃতির মানুষজনের অন্য সংস্কৃতিকে আপন করে নেওয়া৷ এই আপন করে নিতে নিতে নিজের সংস্কৃতিই যেন মেঘে ঢাকা তারা৷ অনুজ্জ্বল৷ খুঁজে নিতে হয় পঁচিশে বৈশাখের মঞ্চ৷ অবহেলার ছবি প্রকাশিত হলে জানা যায় গতকাল কোন মনীষীর জন্মদিন বা প্রয়াণ দিবস ছিল৷ তালনবমীর নামই জানে না এই প্রজন্ম৷ বিজয়ার চিঠি, দশমীর প্রণাম এখন দূর অতীত৷
সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত সংস্কৃতি৷ সংস্কারের শিক্ষাটা আমরা পেয়ে থাকি পরিবার থেকে৷ সংস্কৃতি আসে সংস্কারের পথ ধরেই৷ সংস্কার আমাদের বিনীত করে৷ শ্রদ্ধা জাগায়৷ নিজেদের চিনতে শেখায়৷ সর্বজনগ্রাহ্যই আমাদের সংস্কৃতি৷
নববর্ষকেই নতুন বছর জেনেছি৷ এই যে আমরা নিউ ইয়ার পেরোলাম ডিস্কো ডান্সের উচ্ছৃঙ্খলতায়, এই সংস্কৃতির অস্তিত্ব গত দশকেও শুধুমাত্র বাংলা ক্যালেন্ডারের পাতায় বড় হরফের বাংলা অক্ষরের নীচে ছোট অক্ষরে লেখা থাকত৷ ছোট্ট অক্ষর মানে কিন্তু অশ্রদ্ধা নয়৷ প্রয়োজনের হেরফেরে এমনটা হত৷
কথায় আছে সংস্কৃতিগুণে মানুষ৷ আবার কথায় এও আছে, পরের বা অন্য জাতির সংস্কারকে আপন করে নাও৷ সেটা দোষের নয়৷ দোষের শুধু নিজের সংস্কৃতিকে তাচ্ছিল্য করা৷ বাংলা বা বাঙালির সংস্কৃতি কোণঠাসা৷ দক্ষিণী সিনেমা ‘পুষ্পা’ জ্বরে কাঁপতে থাকা রাজ্যে প্রেক্ষাগৃহের অভাবে ধুঁকছে সাম্প্রতিক বাংলা ছবি।
বিবেক জয়ন্তীতে তেমন হেলদোল দেখা গেল না৷ সামনেই নেতাজি জয়ন্তী৷ ক’জন খেয়াল রাখবে? রাখলেও হাতেগোনা৷ অথচ অণুকরণপ্রিয়তার ফলে ভুবন বাদ্যকরের, ‘কাঁচা বাদাম’, রাজুদার, ‘রুমাল পরোটা’ হয়ে উঠছে গণসংগীত৷ বুদবুদের মতো জলে মিলিয়েও যাচ্ছে৷ মাঝখানে থাকছে কলুষতা৷ এই কলুষতার কালি ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে৷ যা দূর করার ক্ষমতা আমরা হারিয়ে ফেলছি৷ কারণ বাঙালির সংস্কৃতি স্নেহ চায়, মায়া চায়, মমতা চায়, সমাজ ও সুরক্ষা চায়৷
পৃথিবীজুড়ে আত্মহননের খামতি নেই- সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের আক্ষেপের পথ ধরেই হেঁটে চলেছি আমরা আমাদের সংস্কৃতি হারানোর পথ ধরে৷ যে কোনও সময় ট্রামের মতো নিরীহ যানও আমাদের পিষে ফেলতে পারে৷
(লেখক গঙ্গারামপুরের বাসিন্দা। সাহিত্যিক)