- বাল্মীকি চট্টোপাধ্যায়
দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার শুরু হয়েছিল এক বাঙালিকে দিয়ে, ১৯৬৯-এ, দেবিকারানি। ১৫তম বাঙালি হিসেবে এই পুরস্কার পেলেন মিঠুন চক্রবর্তী।
তারপরেও বলা যায়, এই পুরস্কারের তালিকা বোধহয় অসম্পূর্ণই থেকে যেত, যদি মিঠুন চক্রবর্তীর নাম না থাকত। উইকিপিডিয়া খুলে বসার প্রয়োজন নেই। কিছুটা স্মৃতির পাতা খোলা যাক। মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এক সময় মিঠুন চক্রবর্তীকে গরিবের অমিতাভ বচ্চন বলা হত। যে প্রযোজক বিগ বি-কে নেওয়ার রেস্ত জোগাড় করতে পারতেন না, তাঁদের ভরসা ছিলেন মিঠুন বা মিথুনদা। আর মিঠুনও সুদে-আসলে ফিরিয়ে দিতেন তাঁদের।
মিঠুনের শুরু যে মৃণাল সেনের ‘মৃগয়া’ থেকে সে খবর অজানা নয়। এবং প্রথম ছবিতেই জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেটাই হয়েছিল কাল। তার পরের চার বছর পথে-পথে ঘুরেছেন তিনি। কেউ কাজ দেননি। ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাওয়া আর্টিস্ট বলে। চূড়ান্ত বঞ্চনা, অপমান, অসম্মান বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হত তাঁকে। পরে তিনি যখন সাফল্যের শীর্ষে, প্রতিশোধ নেননি। উলটে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অনেকটা আমাদের উত্তমকুমারের মতোই।
বাংলা চলচ্চিত্র মিঠুনকে ব্যবহার করতে পারেনি। উত্তম পরবর্তী সময় স্টুডিওতে ঘুঘু শালিকের বাসা হয়েছিল। গুটিকয়েক হিরো টিমটিম করে ভবিষ্যতের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন, মিঠুন তাঁদের অন্যতম। কর গুনে দেখা যাবে, তাঁর অভিনীত বেশিরভাগ ছবিই বাণিজ্য মোরগকে বনবন করে ঘুরিয়েছে।
এক সময় তো মিঠুন মানেই তুফান। হল থেকে ‘বই’ নামেই না! এতটা সুযোগ পেয়েও প্রযোজক ও পরিচালকরা শুধুই লক্ষ্মীর পিছনেই ছুটে মরলেন। সরস্বতীর আঁচল ধরার চেষ্টা করেননি।
কিন্তু সবাই তো তা নন! বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বলেছিলেন, লোকটি বড় অদ্ভুত! ইয়ার্কি করছে, ফাজলামি করছে, যেই মেকআপ শিল্পী দেবী হালদার মুখে দাড়িটি লাগালেন, ব্যাস, আমূল পালটে গেল। ‘তাহাদের কথা’। ছবির শুটিং হয়েছিল ওডিশায়। গরমকাল। সবাই গাছের ছায়ায় একটু আরাম খুঁজছিলেন। ব্যতিক্রম মিঠুন। ক্যামেরার পাশের চেয়ার ছেড়ে একটি বারের জন্যও পরিচালকের দৃষ্টির বাইরে যাননি। একবারই গিয়েছিলেন, জাতীয় পুরস্কার আনতে।
‘স্বামী বিবেকানন্দ’ ছবিতে মিঠুন সেজেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। শুটিং শিডিউলের মাঝে একদিনও আমিষ খাননি। বেনিয়ম করেননি। বলেছিলেন, তাঁর মধ্যে যেন ঠাকুর ভর করেছিল!
ঠাকুর তো ভর করেননি! তিনি আত্মস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। এক চূড়ান্ত পর্যায়ের ডেডিকেশন, পেশাদারিত্ব। অকাতরে সাহায্য করেছেন আর্তদের। মুম্বই এবং বাংলার কতশত শিল্পী যে তাঁর সাহায্যে বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন তা কহতব্য নয়। আবার এক সময়ের সর্বোচ্চ আয়করদাতা ছিলেন তিনি। গর্বের সঙ্গে বলতেনও সেকথা!
দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারপ্রাপ্ত মিঠুন চক্রবর্তী বড় কষ্ট পেয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ থেকে। বাংলা থেকে। ইদানীং বেশ কিছু ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। করছেন। বাজারও পেয়েছে ছবিগুলো। কিন্তু পুরোনো কষ্টগুলো কি মোছা গিয়েছে?
(লেখক সাংবাদিক)