সোমবার, ১৯ মে, ২০২৫

বাঙালির ধর্মসংকট

শেষ আপডেট:

বাঙালি পরিচয় ছাপিয়ে চারদিকে বড় হয়ে উঠছে ধর্মীয় বন্ধন। শুধু বাংলাদেশে নয়, পশ্চিমবঙ্গেও। পৃথিবীর যেখানেই বাঙালি থাকুক, এই ভেদ চেতনা আচ্ছন্ন করছে অধিকাংশকে। সেই ভেদে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের বাঙালি পরিচয় গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে। বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালি পরিচয়টাই যেন গৌণ হয়ে যাচ্ছে। আজকের বাঙালি ভুলে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাকে। যিনি ১৯০৫-এ রাখিবন্ধনকে হিন্দু-মুসলমান বাঙালির মিলনোৎসব করে তুলেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের চেষ্টায় সেই প্রথম বাঙালি জাতীয়তাবোধে মুসলিম অংশীদারিত্বের সূচনা হয়েছিল। সেই শিক্ষায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস সার সত্যটি বলেছিলেন- ‘বাঙালি হিন্দু হউক, মুসলমান হউক, খ্রিস্টান হউক, বাঙালি বাঙালি।’ সেই সত্য থেকে ক্রমেই দূরে সরছে বাঙালি। সাংস্কৃতিক মননে বাউল, এমনকি ফকিরদের মধ্যে চণ্ডীদাসের ভাবনা বইছে বলে বাংলাদেশে লালন উৎসবে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে সুফি সমাজ। নজরুল ইসলামকে মুসলিম না মনে করার ভাবনা ছড়ানো হচ্ছে।

বাঙালি শুধু কাঁটাতারের বেড়ায় দ্বিখণ্ডিত নয়, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে বিভাজিত হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ প্রতিবেশীকে অচেনা মনে হয়েছে মুর্শিদাবাদে, মালদার মোথাবাড়িতে। প্রতিটি ক্ষেত্রে বাইরের ইন্ধন, প্ররোচনা প্রমাণ হলেও সৌভ্রাতৃত্বের, সহাবস্থানের পরিবেশটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জেনে হোক, না জেনে হোক, বাঙালি বিভাজনের সেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলছে। যে কারণে সিপিএম সমর্থক পরিবারও হিন্দুত্বের রাজনৈতিক ভাবনায় আশ্রয় নিচ্ছে। মুর্শিদাবাদে যা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।

আবার বাংলাদেশে হিন্দু সন্ন্যাসীকে হেনস্তা কিংবা মন্দির ধ্বংসের পিছনে প্রতিবেশীর বাঙালি পরিচয়টিকে লঘু করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র নির্লজ্জভাবে প্রকট হয়ে উঠছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বদলে জন্ম নিয়েছে হিন্দু ও মুসলিম জাতীয়তাবোধ। যা পরস্পরের ‘অপর’, বৈরী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করছে। এতে বাঙালি যে বাস্তবে হীনবল হয়ে পড়ছে, বাঙালি ঐক্যে আঘাত লাগছে- সেই চেতনা যেন ফিকে হয়ে আসছে। ভাষা এক হলেও নিছক ধর্মীয় ফারাক আচ্ছন্ন করছে বাঙালি মননকে।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই পরিস্থিতি হঠাৎ তৈরি হয়নি। নতুন করে দুই ভিন্ন জাতীয়তাবোধ বাঙালিকে গ্রাসও করেনি। অনেক আগে থেকে ভাবনাগুলি ছিল। কখনও সুপ্তভাবে, কখনও ছিল সোচ্চার প্রকাশ। যে কারণে ভারতের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণে পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম সমাজের একাংশের অনীহা অনুভূত হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব তা বুঝতে পেরেছিলেন।

ঊনবিংশ শতকের গোড়া থেকে তাই স্বাধীনতা সংগ্রামীরা সার্বিক ভারতীয় ও বাংলায় সার্বিক বাঙালি পরিচয়ের সূত্রে গাঁথতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। বিপিনচন্দ্র পাল এমন কথাও বলেছিলেন যে, ‘বাঙালি যদি বাংলাকে ভুলিয়া যায়, তাহা হইলে তাহারও আর জীবনের ওপর কোনও দাবি থাকিবে না।’ এরপরেই বিপিনচন্দ্র যা বলেছিলেন, তা আজকের বিভাজনের পটভূমিকায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তিনি সতর্ক করেছিলেন, ‘এই কথাটাই আজ বাঙালিকে সকলের আগে বাঙালিকে ভালো করে বুঝতে হবে।’

দুর্ভাগ্য বাঙালির! কথাটা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাঙালি দ্রুত ভুলতে থাকে। ধর্মনিরপেক্ষতার ঝান্ডা ঊর্ধ্বে তুলে ধরার কথা বলে মুজিবুর রহমানই আটকাতে পারেননি। বাংলাদেশের জন্মের আগে মুসলিম জাতীয়তাবাদ পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু তকমা দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে ব্রাত্য করতে চেয়েছে, পয়লা বৈশাখ নববর্ষের উদযাপন আটকাতে চেয়েছে। তবে সনজীদা খাতুনদের মতো কিছু ব্যক্তিত্বের প্রচেষ্টায় বাঙালি সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ কিছুটা গড়ে ওঠে।

বাঙালি মননে সেই সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবোধ দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলতে পারেনি। যে কারণে ইসলামিক মৌলবাদীদের আক্রমণ থেকে দাউদ হায়দরকে নির্বাসনে পাঠানো ছাড়া অন্য উপায় ছিল না মুজিবুর রহমানেরও। একই কারণে নির্বাসিত করা হয়েছিল তসলিমা নাসরিনকে। ধর্মের এই ভাগাভাগি বাঙালি জাতিসত্তায় আত্মপরিচয়ের সংকটকে ক্রমশ ঘনীভূত করে তুলছে। ইসলামেও এই দ্বন্দ্ব বহমান। বাঙালি জাতীয়তাবাদের শাহবাদ সমাবেশের পালটা ইসলামিক জাতীয়তাবোধের শাপলা জমায়েতে তা স্পষ্ট।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

দলবদলের শিক্ষা

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোটের আর মাত্র এক বছর বাকি। তার...

ঢাকার সিদ্ধান্তে উদ্বেগ

পাকিস্তানকে নিয়ে ভারতের বিড়ম্বনা সেই ১৯৪৭ থেকেই। কিন্তু ২০২৪-এর...

বক্রদৃষ্টি

পাকিস্তানি মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের কঠোর প্রত্যাঘাতের সাফল্যে দেশবাসীর...

চৌদিকে ভীতির বাণ

বড় ভয় চারদিকে। বলতে ভয়, লিখতে ভয়। নিজের মতপ্রকাশেও...