রূপায়ণ ভট্টাচার্য
মালদা স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে নেমে একটু ঘুরলেই চোখে পড়ে, সেখানে অনেকটা জায়গাজুড়ে কালী মন্দির। রেল পুলিশের প্রধান দপ্তর লাগোয়া। এত বড় বেআইনি মন্দির বাংলার কোনও রেলস্টেশনেই দেখবেন না।
‘প্রণামি দেবেন’ লেখা বাক্সটিও দেখবেন যথারীতি। আর দেখবেন মন্দিরের গায়েই বন্দুকধারী প্রহরীর অবস্থান। সব বেআইনি ব্যাপার কোনও ছুমন্তরে আইনি হয়ে গিয়েছে।
মালদা শহরেও বহু বেআইনি নির্মাণ ছুমন্তরে আইনি হয়ে যায় ঠিক এভাবে। শুধু উপযুক্ত ‘প্রণামি’ চাই। এই মালদা তো বিধুশেখর শাস্ত্রী, শিবরাম চক্রবর্তীর মালদা নয়।
এই মালদায় শাসকদলের মাথারা সবাই অন্য পার্টি ঘুরে আসা মুখ, আদর্শকে মারো গুলি। কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক… তৃণমূলে এক দেহে হল লীন। জেলার দুই মন্ত্রীও দলবদলিয়া। সবাই মিলে চব্বিশ ঘণ্টা ল্যাং মারামারিতে ব্যস্ত। বিজেপি, কংগ্রেসেও দলবদলিয়ার ভিড়। বিজেপির সাংসদ খগেন মুর্মু তো মার্কসবাদী থেকে সরাসরি হিন্দুত্ববাদী!
পারস্পরিক আন্তরিক সম্পর্ক বলতে কিছু নেই। ন্যূনতম শৃঙ্খলাও নেই। নইলে পুরসভার কার্নিভাল চলার সময় বাবলা নিজের ওয়ার্ডে আলাদা কার্নিভাল চালাতেন কী করে? কালীঘাট-ক্যামাক স্ট্রিট সব দেখেও চোখ বন্ধ করে থাকত কেন?
লোকসভা ভোটে এজন্যই বাইরের প্রার্থী দিতে বাধ্য হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুই প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শাহনওয়াজ আলি রাইহান ‘বিশ্বাসঘাতক’দের দাপটে চোখের জলে নাকের জলে হয়ে জেলাছাড়া। বাবলার হত্যাকাণ্ডে বিশ্বাসঘাতকের তত্ত্ব আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠিত।
মালদার মনস্কামনা রোড যেখানে নেতাজি রোডে মিশল, সেখান থেকে একটু এগোলেই ডানদিকে এক মূর্তি। টুপি পরা সে মূর্তি বিশ্বনাথ গুহের। তিনিও ১৬ বছর আগে খুন হয়েছিলেন। তাঁর খুনেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা উঠেছিল। উঠেছিল জমি ও তোলাবাজির গল্প। এখনও ব্যাপারটা ধোঁয়াশা।
গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কি নতুন?
মমতা যতই আম-আমসত্ত্বের কথা বলে যান, মালদা লোকসভায় তাঁকে শূন্য হাতে ফেরায় একটা কারণে। তৃণমূলই এখানে বড় শত্রু তৃণমূলের। দলবদলিয়া নেতারা কেউ কাউকে পছন্দ করেন না। ভালো চান না। নইলে পার্টির জেলা সহ সভাপতির হত্যাকাণ্ডে ইংরেজবাজার শহর সভাপতি গ্রেপ্তার হন?
সুপারি কিলার দিয়ে নেতা খুনের অপসংস্কৃতি মালদার হাত ধরে আবার উঁকি দিল উত্তরবঙ্গে। এই জেলা দুষ্কৃতীদের পক্ষে আদর্শ। গঙ্গা পেরিয়ে ঝাড়খণ্ড বা বিহারে গা-ঢাকা দেওয়ার বহু পথ। ফুলহর পেরিয়েও বিহারে যাওয়া যায়। ফরাক্কা পেরোলে মুর্শিদাবাদ ও দক্ষিণবঙ্গ তো আছেই। সুপারি কিলারদের পায় কে? আসানসোলের কুখ্যাত কোল বেল্টেও পালানোর এত রাস্তা নেই।
লিখতে লিখতেই মনে পড়ে দুটো-তিনটে ঘটনা। বাম আমলে দমদমে সিপিএম নেতা রবীন্দ্রসংগীত গায়ক শৈলেন দাসের হত্যা। নিমতার তৃণমূল নেতা নির্মল কুণ্ডুর খুন। সব ক্ষেত্রেই ছিল সুপারি কিলার সংযোগ।
সুপারি কিলার শব্দটা এমনিতে এল কোথা থেকে? বেশি প্রচলিত তত্ত্ব, মুম্বইয়ের মাহিমে ভীম নামে ভয়ংকর দুষ্কৃতীর কীর্তিকলাপেই এই প্রথা চালু। কাউকে হত্যার পরিকল্পনা থাকলে ভীম আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভাইদের নেমন্তন্ন করত। প্রচুর খাওয়াদাওয়ার পর গোল হয়ে বসত গুন্ডারা। তাদের ঠিক মাঝখানে রাখা থাকত পান-সুপারি। যে প্রথমে পান-সুপারি তুলে নিত, তাঁর ওপরেই দায়িত্ব পড়ত টার্গেটকে শেষ করার। তাকে ভীমই দিত টার্গেটের ছবি এবং ডেইলি রুটিন। পান-সুপারি নেওয়া লোকটি প্রথমে বাছত মিডলম্যান। সেই মিডলম্যান আবার বাছত হিটম্যানকে। এভাবেই একদা হত্যা করা হয় ব্যাডমিন্টন তারকা সৈয়দ মোদিকে, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির শোম্যান গুলশন কুমারকে। বছর পাঁচেক আগে বেঙ্গালুরুর পুলিশ কমিশনার ভাস্কর রাওয়ের তথ্য ভাবানোর মতো, ‘মানুষের জীবনের দাম এত কমেছে, ১০-১৫ হাজার টাকাতেও খুন হচ্ছে। একটা মোবাইল বা টি শার্টের জন্যও খুন করা হয়।’
বেঙ্গালুরুতেই কিছুদিন আগে সম্পত্তির লোভে বাবাকে খুন করে ছেলে। সে সুপারি কিলার ভাড়া করেছিল ১ কোটি টাকায়। এই তো যোগীরাজ্যে খুনের গল্পেও মিশে রইল কমেডি। এক সুপারি কিলার এসে পুলিশে অভিযোগ করল, স্বামীর কথায় স্ত্রীকে খুন করেছিল তারা। প্রাপ্য কুড়ি লাখ টাকা মেলেনি।
বাবলা হত্যার শহরে ফিরে আসি। এমন পরিস্থিতিতে যে কোনও শহরে তীব্র উত্তেজনা, শোকমিছিলের পর শোকমিছিল, স্লোগান দেখে অভ্যস্ত বাংলা। অথচ মৃত্যুর সাতদিন পরেও মালদায় সব স্বাভাবিক। রথবাড়ি মোড়, চারশো বিশ মোড় সারা রাতই জেগে থাকে। বিশেষত রথবাড়ি মোড়। এমন ২৪ ঘণ্টা জেগে থাকা মোড় উত্তরবঙ্গে নেই। সবই ঠিকঠাক চলছে। এমনকি বাবলার পেশি দেখানোর জায়গা কানি মোড়ও স্বাভাবিক।
কাশ্মীর টু কুমারিকা লোকে রাজনীতিতে পরিবারবাদ নিয়ে লেখালেখি করলেই গান্ধি পরিবারের সঙ্গে বন্দ্যোপাধ্যায়, শা, পাওয়ার, করুণানিধি বা আবদুল্লা পরিবারকে টেনে আনে। মালদার পরিবারতন্ত্র নিয়ে কেউ বলে না। অথচ জেলায় অধিকাংশ তৃণমূল নেতার স্ত্রী, স্বামী, মা, ছেলে বা জামাই নানা পদে। কিছুক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী কাউন্সিলারও। গণ্ডগোলটা এখানেই। কেউ কারও ভালো দেখতে চান না। বরং গনি পরিবারে দুই সাংসদ থাকলেও তাঁরা আড়ালে। জেলার দুই মন্ত্রীর ওপর জনতা ক্ষিপ্ত একই কারণে। সাবিনা ইয়াসমিনের স্বামী এবং তজমুল হোসেনের ভাইয়ের দাদাগিরিতে মালদার দুই প্রান্তে তীব্র অসন্তোষের বন্যা। গঙ্গা ও ফুলহরের বন্যা দেখা যায়, এই অসন্তোষের বন্যা আবার শোনা যায়। কৃষ্ণেন্দু ও বাবলার স্ত্রী দুজনেই ক্রমাগত আরও বড় মাথার যোগের কথা বলে চলেছেন। এঁরা কারা? কালীঘাট ও ক্যামাক স্ট্রিট নিশ্চয়ই উত্তরটা জানে। দু’দিনেই পর্দা ফাঁস হোক না!