গৌতম সরকার
বৃক্ষ যত বড় হয়, তত শাখাপ্রশাখা ছড়ায়। ফলে-ফুলে পল্লবিত হয়। এগিয়ে চলার পথে ফেলে আসা বছরে উত্তরবঙ্গ সংবাদও অনেক পালক যুক্ত করেছে। আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠতে শিকড়ে পৌঁছোনোর চেষ্টা বরাবরই ছিল। শিকড় খোঁজার সেই কাজটি পরিকল্পিতভাবে করার চেষ্টা হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। যে চেষ্টা অন্তহীন। কখনও শেষ হয় না। শিকড়ের খোঁজ চালিয়ে যাওয়া ৪৬তম বর্ষে উত্তরবঙ্গের প্রাণের সংবাদপত্রের দৃঢ় অঙ্গীকার।
সচেতন পাঠক উত্তরবঙ্গ সংবাদের সেই সংকল্প যাত্রা ইতিমধ্যে আঁচ করেছেন নিশ্চয়ই। গত কয়েক মাসে বেশ কিছু নতুন ভাবনা পল্লবিত হয়েছে। যেমন ‘উত্তরের শিকড়’ বিভাগ। উত্তরবঙ্গের পথে-প্রান্তরে, আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, স্মারক, সংস্কৃতি ইত্যাদির গোড়ায় পৌঁছোনো যে বিভাগের উদ্দেশ্য। নতুন প্রজন্মকে তার পূর্বপুরুষের ইতিহাস শুধু নয়, তার এলাকার ভৌগোলিক-সাংস্কৃতিক অতীত জানানো, পুরোনোদের সেই ঐতিহ্য মনে করিয়ে দেওয়ার দায়বদ্ধতা ছিল এই পরিকল্পনার পিছনে।
আরও একটি বিভাগ ‘আমাদের ছোট নদী’ সেই দায়বদ্ধতার আরেক স্বাক্ষর। নদী সেই এলাকার সভ্যতা বিকাশের নীরব সাক্ষী। নদীকে কেন্দ্র করে যেমন সভ্যতা বিকশিত হয়, তেমনই সংশ্লিষ্ট জনপদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ইত্যাদি তৈরি হয়। যেভাবে তিস্তাবুড়ি সম্পর্কে প্রচলিত বিশ্বাস, পুজো ও গান। ভাওয়াইয়া সুরে ‘তোর্ষা নদীর উথাল পাথাল রে…’ গান তো তোর্ষাপাড়ের অন্যতম পরিচিতি হয়ে আছে।
তিস্তা, তোর্ষা, মহানন্দা, ফুলহর, আত্রেয়ী, ডাহুক, নাগর, কালজানি, রায়ডাক, সংকোশ ইত্যাদি অবশ্য ছোট নদী নয়। তার বাইরে অনেকে পরিচিত-স্বল্প পরিচিত, অখ্যাত নদী-উপনদী-শাখানদীর অস্তিত্ব ছড়িয়ে আছে উত্তরবঙ্গের আট জেলায়। যেগুলির সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্থানীয় গ্রামীণ জীবন, সেখানকার সভ্যতা-সংস্কৃতি, ইতিহাসের বিস্মৃত অধ্যায়। সেই নদীগুলির বেশ কিছু এখন অস্তিত্ব সংকটে ধুঁকছে। উন্নয়ন, নগরায়ণ কিংবা নিছক দূষণের চাপে অনেক জায়গায় হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামীণ মানুষের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত অধ্যায়।
‘আমাদের ছোট নদী’ সেই অধ্যায়কে বিস্মৃতির হাত থেকে রক্ষা করে সকলের সামনে তুলে ধরার এক উল্লেখযোগ্য চেষ্টা। স্থানীয় ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের দায়িত্ব প্রশাসনকে মনে করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে তার কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করারও ছিল সেই পরিকল্পনার অন্যতম কারণ। জীবন তো শুধু ইতিহাস আর ঐতিহ্য নিয়ে চলে না। বাস্তবের মাটিতে উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ইত্যাদিও জরুরি।
জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনকে তাই প্রয়োজনে সবসময় কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে উত্তরবঙ্গ সংবাদ। সেই চেষ্টার আরেকটি রূপ পাঠক গত কয়েক মাসে দেখেছেন ‘জনতার আদালত’ বিভাগে। তেমনই বিরোধীদের দায়বদ্ধতা মনে করিয়ে দিতে নিয়মিত প্রকাশ করা হয়েছে ‘পেতাম যদি সিংহাসন’ বিভাগ। উত্তরবঙ্গে প্রায় সমস্ত শহরই ক্রমে আধুনিক হচ্ছে, প্রসারিত হচ্ছে। উন্নয়নের ঢাকঢোল ভালোই পেটানো হয় শহরগুলিতে। অথচ প্রতি শহরের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নাগরিক সমস্যার অন্ত নেই।
রাস্তা, পানীয় জল, বিদ্যুতের জোগান থেকে শুরু করে খেলার মাঠ, অবসর বিনোদনের পার্ক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচির মঞ্চের অভাব কিংবা রক্ষণাবেক্ষণের সমস্যা প্রায় প্রতি শহরে। পাশাপাশি আবর্জনা, দূষণ, অরাজকতা ইত্যাদিতে জেরবার অনেক এলাকা। এত অভাব-অভিযোগ, সমস্যার প্রতি পুর কর্তৃপক্ষের নজর আকর্ষণে উত্তরবঙ্গ সংবাদ চালু করেছে ‘পাড়ায় পাড়ায়’ বিভাগ। উত্তরবঙ্গের আত্মার আত্মীয়ের দায়বদ্ধতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পাঠকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন এইসব উদ্যোগের নেপথ্য কারণ।
পাঠকমাত্রই জানেন, তথ্য বিকৃতি, মিথ্যার জাল ক্রমে সংবাদজগৎকে কলুষিত করছে। সেখানে দাঁড়িয়ে সত্য যাচাইয়ের লাগাতার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে প্রকৃত তথ্য পাঠকের দুয়ারে পৌঁছে দিতে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গ সংবাদ। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সাম্প্রতিক আবহে উত্তরবঙ্গ সংবাদে সেই প্রক্রিয়ার প্রতিফলন নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন পাঠক। কষ্টসাধ্য এবং অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের ক্ষতির ঝুঁকি নিয়েও সাংবাদিকতায় সেই সত্যনিষ্ঠায় অবিচল থাকতে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
পক্ষপাত, আনুগত্য, নিছক ব্যবসায়িক স্বার্থ ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪৫ বছর ধরে উত্তরবঙ্গ সংবাদ শুধু মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার ঐতিহ্য নির্মাণ করেছে। সর্বশেষ সেই কথাটাই বলার যে, উত্তরবঙ্গের আত্মাকে নিষ্কলুষ, পবিত্র, নির্মল রাখতে একইরকম নির্ভীক, দল ও শক্তি নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে চলার শপথ আমরা নিলাম ৪৬তম বর্ষের শুরুতেই।