- রন্তিদেব সেনগুপ্ত
নরেন্দ্র মোদি সরকারের চালু করা নির্বাচনি বন্ডকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ, নির্বাচনি বন্ডের মাধ্যমে বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থাকে নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। গণতন্ত্রের পক্ষে এটি যে বিপজ্জনক সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে কার্যত সেটিই উঠে এসেছে। সুপ্রিম কোর্ট স্টেট ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে, কোন রাজনৈতিক দলকে কোন সংস্থা এ পর্যন্ত কত টাকা দিয়েছে তা ৬ মার্চের ভিতর নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হবে। নির্বাচন কমিশন ১৩ মার্চ তা প্রকাশ করবে।
ভোটের মুখে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় নিঃসন্দেহে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক। মোদির সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর পর্দার আড়ালে টাকা তোলার এই যে একটি পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত করে তাতে আইনি সিলমোহর লাগাতে চেয়েছিল, সেটি কতখানি বেআইনি এবং অসাংবিধানিক সুপ্রিম কোর্ট চোখে আঙুল দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছে।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি দীর্ঘদিন ধরে এই নির্বাচনি বন্ডের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। রাহুলের অভিযোগ ছিল, এই নির্বাচনি বন্ডের মাধ্যমে কর্পোরেট সংস্থাগুলির যথেচ্ছ কালো টাকা বিজেপির তহবিলে ঢুকছে। এবং বিভিন্ন সরকারি নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এইসব কর্পোরেটদের তুষ্ট করার চেষ্টা করছে মোদি সরকার। কিন্তু হীনবল কংগ্রেসের এই নেতার কথা বিজেপির ঢক্কানিনাদের আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছিল। রায় বেরোনোর পর রাহুল খুশি হতে পারেন। কারণ, সুপ্রিম কোর্ট তাঁর বক্তব্যকে কার্যত মান্যতা দিয়েছে। রাহুল এখন বলতেই পারেন, তিনি কোনও আলটপকা অভিযোগ তোলেননি।
২০১৭-’১৮ অর্থবর্ষে এই নির্বাচনি বন্ড চালু করেছিল বিজেপি সরকার। তার আগে টাকা তোলার এইরকম উদ্ভাবনী কৌশল পূর্ববর্তী কোনও সরকারের মাথায় আসেনি। বলা হয়েছিল, এই নির্বাচনি বন্ডের মাধ্যমে যে কোনও কর্পোরেট সংস্থা বা ব্যক্তি নিজের পরিচয় গোপন রেখে যত খুশি অর্থ যে কোনও রাজনৈতিক দলকে দিতে পারে। কার কাছ থেকে কত টাকা দলের ঝুলিতে ঢুকছে তা রাজনৈতিক দলগুলিকে জানাতে হত না। সংক্ষেপে দলীয় তহবিলে পর্দার আড়ালে টাকা তোলার এক সুবন্দোবস্ত।
এই নির্বাচনি বন্ড চালু হওয়ার পর ২০১৯-এ একটি লোকসভা নির্বাচন ছিল। সুপ্রিম কোর্ট সূত্রেই প্রকাশ, ২০১৯-’২০ অর্থবর্ষে বিজেপি সবথেকে বেশি টাকা তুলেছিল। সেই টাকার পরিমাণ ২৫৫৫ কোটি। অন্য রাজনৈতিক দলগুলি বিজেপির থেকে অনেক পিছনে ছিল। কংগ্রেস পেয়েছিল ৩১৭ কোটির কিছু বেশি। তৃণমূল কংগ্রেস তুলেছিল ১০০ কোটির কিছু বেশি। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচন সম্পর্কে যাঁরা অবহিত আছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন, সেই লোকসভা নির্বাচনটিতে বিজেপি কীরকম জলের মতো টাকা খরচ করেছিল।
নির্বাচনি বন্ডের মতো এরকম একটি অসাধু এবং অসাংবিধানিক ব্যবস্থাকে যদি পাকাপোক্তভাবে চালু করা যায়, তাহলে তাঁদের পার্টির তহবিল যে ফুলেফেঁপে উঠবে, অর্থশক্তিতে যে তাঁরা বলীয়ান হয়ে উঠবেন আর সকলের চেয়ে, বিজেপির অতি বুদ্ধিমান নেতৃত্ব বোধকরি তা বুঝতে পেরেছিলেন। নির্বাচনি বন্ডে এখন পর্যন্ত কার ঝুলিতে কত টাকা পড়েছে, সেই তথ্যটির দিকে একবার চোখ বোলালেই বোঝা যাবে, সব থেকে লাভবান দলটির নাম ভারতীয় জনতা পার্টি।
সুপ্রিম কোর্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছে। নির্বাচনি তহবিলে বিপুল টাকা দেওয়ার বিনিময়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলি ভোটে প্রভাব খাটানোর সুযোগ পায়। কর্পোরেট সংস্থাগুলি যে নিতান্ত গৌরী সেনের মতো দয়াপরবশ হয়ে রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলে টাকা দান করে- এরকম মনে করার কারণ নেই। তাদের পার্টি তহবিলে টাকা দান করার একটিই উদ্দেশ্য থাকে। তা হল, পরিবর্তে নিজেদের মর্জি মতো সরকারি নীতি নির্ধারণে প্রভাব খাটানো। ফলে সরকারে যে থাকে তার ঝুলি অর্থে ভরে দেয় এই কর্পোরেটরা। বদলে সরকারকে যে এই কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষা করে চলতে হয়- তা আর ব্যাখ্যা না করলেও চলে। এই কর্পোরেটরা যাকে তাদের বন্ধু বলে মনে করে, যে তাদের স্বার্থ সবথেকে বেশি রক্ষা করবে বলে মনে করে- তাকে ভোটে জেতানোর জন্যও এই নির্বাচনি বন্ডের মাধ্যমে দেদার টাকা ঢালে। জনগণের নির্বাচিত সরকারের বদলে কর্পোরেট মনোনীত সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার রাস্তাই আরও উন্মুক্ত হয়ে যায়। এই অনৈতিক কাজটিকেই বন্ধ করতে চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
আর এখানেই অশনিসংকেত দেখছে বিজেপি। সর্বদা সকলকে চোর সাব্যস্ত করে বেড়ানো বিজেপি নেতারা ভালোই জানেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মতো ১৩ মার্চ যদি নির্বাচন কমিশন কার তহবিলে কে কত টাকা ঢেলেছে এই তালিকাটি প্রকাশ করে দেয় – তাহলে বিজেপির ঝুলি থেকে কালো বিড়ালটি বেরিয়ে পড়বে। কে জানে, হয়তো তখন আদানি-আম্বানিদের কাছে দেশ বেচে দেওয়ার অভিযোগটি যে নিতান্ত মিথ্যা ছিল না- সেটি প্রচার করার আর একবার সুযোগ পেয়ে যাবেন রাহুল।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে বিজেপি নেতারা যে যথেষ্ট শঙ্কিত তা তাঁদের হাবেভাবে এবং কথাবার্তায় ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছে। বিরোধী দলগুলি এবং বিভিন্ন অরাজনৈতিক সংগঠন ও ব্যক্তি যখন সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন, তখন বিজেপি এই বিষয়ে চুপ। বরং তারা একটি অক্ষম যুক্তি দিচ্ছে যে, কেন্দ্রে বা রাজ্যে যারা শাসকদল থাকে, তারাই নির্বাচনি বন্ডের মাধ্যমে বেশি টাকা পায়।
এই যুক্তিতে যে এই অনৈতিক এবং অসাংবিধানিক কাজটি ছাড়পত্র পেয়ে যায় না, সেটি তারা বুঝছে না। বিজেপির অন্দরের খবর, ভোটের আগে নির্বাচনি বন্ড বাতিল হওয়া তারা সর্বশক্তি দিয়ে আটকাবে। প্রয়োজনে অধ্যাদেশ জারি করে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে খারিজ করবে মোদি সরকার। সংখ্যার জোরে সে কাজ তারা করতেই পারে। কিন্তু তাহলেও কি এই প্রশ্ন উঠবে না- ঝুলির কোন কালো বিড়ালকে আড়াল করতে বিজেপি এত তৎপর?