গৌতম সরকার
তরুণ মুখ চাই। লাও তো বটে, তারুণ্য কি আর কেনা হয়!
আরও সদস্য চাই। চাইলেই সদস্য পাওয়া যায় নাকি!
দেখে-শুনে রবীন্দ্রনাথের গানটা মনে পড়ে… তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই!
‘মনোহরণ চপলচরণ’ তারুণ্যে ভরা সোনার হরিণের বড় অভাব!
‘খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর।’ নেতৃত্বে তারুণ্য খুঁজছে সিপিএম। বিজেপি হন্যে এক কোটি সদস্যের খোঁজে।
জাঁকিয়ে শীত বাংলায়। ঠান্ডায় স্নান করছে গঙ্গাসাগর। দার্জিলিংয়ের তাপমাত্রা শূন্য। শীত মানে পিঠের গন্ধ। দুয়ারে পৌষ সংক্রান্তি। শীত মানে ইংরেজি নববর্ষ। শীত মানে বসন্তের পদধ্বনি। শীত মানে আগামীর শপথ। সেই শপথ নিতে সিপিএমে এখন সম্মেলন পরব। ব্রাঞ্চ থেকে শুরু। এরিয়া, জেলা, রাজ্য হয়ে পার্টি কংগ্রেসে শেষ হবে। দীর্ঘ সম্মেলন যাত্রা। নতুন কমিটি। নতুন নেতৃত্ব। আর বার্ধক্যের স্থবিরতা নয়। প্রাণচঞ্চলতা চাই। নতুন রক্ত চাই। তাজা প্রাণ।
সিপিএমে থাকতে রেজ্জাক মোল্লা দলে কালো চুল বাড়ানোর সওয়াল করেছিলেন। তিনি সিপিএমে নেই। সিপিএম এখন কালো চুলের জন্য মরিয়া। কমিটিতে ৩১ বছরের ঊর্ধ্বে কত সদস্য রাখতে হবে, তার আইন হয়েছে। শুধু আইন দিয়ে কি হয়! হয় না। সিপিএমের সদ্য কলকাতা জেলা সম্মেলনের রিপোর্ট তার অকাট্য প্রমাণ। ওই রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০১৫-তে দলে ৩১ বছরের নীচে সদস্য ছিল ৪.৬ শতাংশ। ২০২৪-এ হয়েছে ৪.৩ শতাংশ।
বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আবার চুল ছেঁড়ার অবস্থা। দলটা সবেতেই বিশ্বগুরু হতে চায়। দেশকে বিশ্বগুরু বানাতে চায়। প্রধানমন্ত্রী নিজে বিশ্বগুরু হতে চান। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দলের তকমাটা ধরে রাখতে চায়। তাহলে বাংলায় এমন ছন্নছাড়া দশা থাকলে কী চলে! সদস্য সংগ্রহের মেয়াদ বাড়িয়ে (সিপিএমে চাইলেও মেয়াদ বাড়ানো যায় না। আরও অনেক কিছুর মতো সিপিএমে সদস্য সংগ্রহ ও পুনর্নবীকরণের সময় নির্দিষ্ট) লক্ষ্যপূরণ করতে পদ্মের হিমসিম দশা বঙ্গে। লোকসভা ভোটের ফলাফল দেখে দিল্লির হিন্দুত্ববাদী নেতাদের দুশ্চিন্তা বেড়েছে। ওই নেতাদের গুঁতো খেয়েই হোক আর বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের ধাক্কাতেই (সেরকমই দাবি শুভেন্দু অধিকারীর) হোক, অবশেষে নাকি সদস্য সংগ্রহে কিছু গতি এসেছে বাংলায়। ১ কোটির ধারে-কাছে না পৌঁছালেও ৪০ লক্ষ নাকি পার হয়েছে। সিপিএমে তরুণ খোঁজার মেয়াদ বাড়ানোর উপায় নেই। সম্মেলনের দিনক্ষণ নির্ধারিত যে। কিন্তু তরুণ মুখ কই? অগত্যা কোনও কোনও সম্মেলনে তারুণ্যের কোটা ফাঁকা রেখে কমিটি তৈরি করে ফেলা হচ্ছে। সিপিএমে পরে ‘কো-অপ্ট’ (সংযোজন) করার সুযোগ বরাবরই আছে। তারুণ্যকে জায়গা দিতে পুরোনো নেতাদের কমিটি থেকে বিদায় দেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ফলে সিপিএমে অবসরপ্রাপ্ত নেতার সংখ্যা বাড়ছে। অথচ তাঁদের অনেকের কর্মক্ষমতা আছে, দক্ষতা আছে।
আমাদের দেশে সরকারি, বেসরকারি চাকরিতে অবসরের নির্ধারিত বয়সে আজকাল অনেকে শারীরিকভাবে ফিট, মানসিকভাবে পরিণত থাকেন। অবসর মানে তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে সরকারি, বেসরকারি সংস্থার বঞ্চিত হওয়া। উপযুক্ত মানবসম্পদ ঠেলে সরিয়ে দেওয়া। সিপিএমেও তাই। আলিমুদ্দিনে কাজ নেই বিমান বসুর। শিলিগুড়িতে অনিল বিশ্বাস ভবনে অশোক ভট্টাচার্যের শুধু যাওয়া-আসা। রবীন দেবের মতো কর্মক্ষম নেতার এখন কোনও দায়িত্ব নেই। ভাবা যায়! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী সাধে নবীন-প্রবীণ ভারসাম্যের কথা বলেন!
বিজেপির সদস্য সংগ্রহ অনেকটা ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্পের মতো। হাটে-বাজারে, রাস্তায় টেবিল পেতে হাঁকডাক, আসুন আসুন, পদ্মপাতায় আসনপিঁড়ি হয়ে বসুন। দলের মতাদর্শ বোঝানোর বালাই নেই। হিন্দুত্বের টানে সবাই চলে আসবে- দলের নেতৃত্বের ধারণা তেমনই। বিয়ের আসরে সদস্য করায় চমক হয়তো আছে। কিন্তু দলের প্রতি দায়বদ্ধতা, আনুগত্য? বিশ্বের বৃহত্তম দলের সেসব ভাবলে চলে না।
মিছিল-মিটিং হলে সিপিএমে বেশকিছু তরুণ-তরুণীকে দেখা যায়। কিন্তু নেতৃত্বে আনার নতুন মুখ খুঁজতে হিমসিম সিপিএম। মিছিলে হাঁটা এই তরুণরা মূলত শহুরে। তাও আবার শহরের বস্তি বা কলোনি এলাকার নয়, শ্রমিক মহল্লারও নয়। যা ছিল একসময় সিপিএমের অন্তর্নিহিত শক্তি। এই শহুরে তরুণদের গ্রামে দূরে থাক, বস্তিতে-কলোনিতে, শ্রমিক মহল্লায়, কারখানায় সংগঠনের কাজে দেখা যায় না।
তৃণমূলের প্রতি রাগ-ক্ষোভ, বিজেপির হিন্দুত্বকে অপছন্দ- এই তরুণদের সিপিএম করার একমাত্র কারণ। তাঁদের ‘সাংগঠনিক’ কাজ সীমাবদ্ধ ভাষণে আস্ফালন, বক্রোক্তি (যাকে বলে ট্রোল) আর ফেসবুক বিপ্লবে। দল গড়ে তোলার পরিশ্রমসাধ্য, ধৈর্যশীল, মতাদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ কাজ এঁদের আয়ত্তের বাইরে। ফলে দলে থাকলেও তাঁদের নেতৃত্বে তুলে আনা কঠিন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো কিছু জেলায় আবার গোষ্ঠীতন্ত্রে কমিটি থেকে বাদ পড়ছেন সম্ভাবনাময় তরুণরা।
বিজেপিতেও এসব চলে। ধরে ফেলেছেন পশ্চিমবঙ্গে দলের পর্যবেক্ষক সুনীল বনসাল। জেলা সভাপতিরা নাকি নিজেদের পদ সুরক্ষিত রাখতে বেছে বেছে নিজের অনুগামীদের সক্রিয় সদস্য করেছেন। বিজেপির নিয়মে সক্রিয় সদস্যরাই শুধু সাংগঠনিক ভোট দেওয়ার অধিকারী। কিন্তু এই যে এত এত সদস্য করা হচ্ছে, তাঁদের কাজ কী? নেতাদের তো কাজ বলতে পুজোপাঠ, হিন্দুত্বের প্রচার, মুখে মারিতং জগৎ।
সাংগঠনিক, মতাদর্শগত কাজ যেটুকু হয়, করে দেয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন, সমস্যা, সংকট ইত্যাদি নিয়ে তৃণমূল স্তর থেকে আন্দোলন গড়ে তোলার বালাই নেই বিজেপিতে। শুভেন্দুর কথা শুনে মনে হয়, হিন্দুত্বের বাতাসে ভরে যাবে ইভিএমে পদ্মের বোতাম। কংগ্রেসে সাংগঠনিক কাজ, আন্দোলন কোনও কালে ছিল না।
তৃণমূলেরও সাংগঠনিক কাজ নেই। ভরসা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কৃষকবন্ধু, কন্যাশ্রী, বাংলা আবাস। আর আছে জমি-বালি-পাথরের কারবার আর তোলাবাজির অবাধ ছাড়পত্র। এতে তরুণদের একাংশকে কবজায় রেখে দেওয়া যায়।