অভিষেক ঘোষ, মালবাজার : পতঙ্গ, ওরে পতঙ্গ/ এই নির্বোধ আঙুলে আমার/ চঞ্চল তোর নিদাঘ-রঙ্গ/ মুছে গেলে ফুটে উঠবে না আর।– উইলিয়াম ব্লেকের কালজয়ী কবিতা ‘দ্য ফ্লাই’ যেন ডুয়ার্সের চা বলয়ে নির্মম বাস্তব হয়ে উঠেছে। চা বাগান ও কৃষিজমিতে রাসায়নিক ও কীটনাশকের বেলাগাম ব্যবহারে ডুয়ার্স থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে প্রজাপতিরা। চা বাগান রাস্তায় বা গ্রামে খেতে ঘুরলেই এখন দেখা যাবে মৃত প্রজাপতিরা পড়ে রয়েছে।
জীববিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, ভারতে প্রায় ১৩৩০ প্রজাতির প্রজাপতির হদিস মেলে। তাদের অধিকাংশেরই ঠিকানা হিমালয়ের উত্তর-পূর্ব অংশে। এদের মধ্যে প্রায় সাড়ে চারশো প্রজাতির প্রজাপতি দেখা যায় ডুয়ার্সে। একসময় যে প্রজাপতির জন্য খ্যাতি ছিল ডুয়ার্স সহ উত্তরবঙ্গের, সেখানেই এখন প্রজাপতিরা আর ডানা মেলে না।
ডুয়ার্সে যে প্রজাপতি পাওয়া যায় সেই প্রজাতির নাম অ্যাট্রোফানুরা বরুনা। সেই প্রজাপতি মূলত চা বাগানের বাসিন্দা। তবে চা গাছের পাতা তাদের খাদ্য নয়। প্রজাপতি ডিম পাড়তে এবং শুঁয়োপোকাকে বড় করতে কারিপাতা গাছ, ওলেন্ডার এবং জুঁই গাছের মতো কিছু নির্দিষ্ট গাছে বাসা করে। এর বাইরে, প্রজাপতিরা ফুলের মধু খাওয়ার জন্য জিনিয়া, তুলসী এবং সূর্যমুখীর মতো ফুলে ঘুরে বেড়ায়। একসময় ডুয়ার্সে এইসব গাছ প্রচুর থাকলেও বর্তমানে তাদের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। সেইসঙ্গে বায়ু দূষণ, রাসায়নিক দূষণের মারাত্মক প্রভাব পড়ছে প্রজাপতির প্রজননে।
জীববিজ্ঞানীরা দেখেছেন, রাসায়নিক দূষণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রজাপতির ডানা। রাসায়নিক তেলের প্রভাবে ডানা ভারী হয়ে যাওয়ায় ক্রমশ ওড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে প্রজাপতিরা। আর সেটাই তাদের মরণ ডেকে আনছে।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র কলেজের অধ্যাপক তথা প্রজাপতি বিশেষজ্ঞ নীনা সিং বলেন, ‘চা বাগানে কীটনাশক ও রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে প্রজাপতিদের যে কতটা ক্ষতি হয়েছে তার মর্মান্তিক উদাহরণ পাওয়া যাবে লুপ পুলের রাস্তায় গেলেই। তিন বছর আগে ওই এলাকায় সমীক্ষা করে আমরা ২৭০ প্রজাতির হদিস পেয়েছিলাম। সেই সংখ্যাটা এবারের সমীক্ষায় এসে দঁাড়িয়েছে ২৮-এ।’
বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, ফুলের পরাগমিলন ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় প্রজাপতি। এমনকি বাস্তুতন্ত্রের খাদ্য-খাদক চক্রে প্রজাপতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পতঙ্গ। চা বাগানে বা জঙ্গলে এমন প্রচুর সরীসৃপ প্রাণী থাকে, যেমন ব্যাং, গিরগিটি ছাড়াও বিভিন্ন পাখির প্রিয় খাদ্য প্রজাপতি। সেক্ষেত্রে প্রজাপতির সংখ্যা কমে যেতেই বিঘ্নিত হচ্ছে বাস্তুতন্ত্র।
প্রজাপতি বিশেষজ্ঞ যুধাজিৎ দাশগুপ্ত বলছেন, ‘প্রজাপতি সহ কীটপতঙ্গ যে কাজটি করে তাকে বলা হয় ইকোলজিকাল সার্ভিস। শুধু প্রজাপতি নয়, তাদের পাশাপাশি সমস্ত কীটপতঙ্গ চরম বিপদের সম্মুখীন। বিশ্ব উষ্ণায়ন, আবহাওয়া পরিবর্তনের চরম প্রভাব পড়ছে ওদের ওপর। ওদের বাসস্থানের গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। ওদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু চিন্তাভাবনা করুক রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার। সেক্ষেত্রে তৈরি করা যেতে পারে প্রজাপতি উদ্যান ও প্রজননকেন্দ্র।’
মাল, মেটেলি ব্লকের বিভিন্ন চা বাগানের বাসিন্দারাই জানাচ্ছেন, বাগানে এখন রিঙন প্রজাপতির ঝাঁক আর দেখা যায় না। আগে ডুয়ার্সের রেললাইন বরাবর ট্রেনে যাওয়ার সময় প্রচুর প্রজাপতি উড়তে দেখা যেত। অধ্যাপক নীনা জানিয়েছেন, শুধু এখানে নয়, ডিএইচআর-ও রেললাইনের ধারবরাবর আগাছা মারতে রাসায়নিক ছড়াচ্ছে। আর তাতেই চলছে প্রজাপতি ও পতঙ্গ নিধনযজ্ঞ।
বাতাবাড়ির প্রবীণ পর্যটন ব্যবসায়ী সোনা সরকার জানান, এর আগেও টিয়াবনকে সংরক্ষণ করার জন্য সেখানে একটি প্রজাপতি উদ্যানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল রাজ্য সরকারকে। সেটা করা হলে বেঁচে যেত প্রজাপতির প্রচুর প্রজাতি।
টি রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য শ্যাম ভার্গিস অবশ্য দাবি করছেন, ‘প্রতিটি চা বাগানে জৈব কীটনাশক ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরাও চেষ্টা করছি উপকারী পতঙ্গদের বাঁচিয়ে কীভাবে চায়ের উৎপাদন করা যায়।’

