ডিজিটাল ডেস্ক : অ্যাডিনোমায়োসিস এমন এক রোগ, যাতে অনেক মহিলাই আক্রান্ত হন। কিন্তু এ নিয়ে অনেকেরই ধারণা পরিষ্কার নয়। রোগের কারণ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে জানালেন আইভিএফ এবং ফার্টিলিটি স্পেশালিস্ট ডাঃ প্রসেনজিৎকুমার রায়
অ্যাডিনোমায়োসিস সম্পর্কে জানতে গেলে প্রথমে আমাদের জরায়ুর গঠন জানতে হবে। জরায়ুতে তিনটি স্তর থাকে। বাইরের স্তরটিকে বলে পেরিমেট্রিয়াম, মাঝেরটি মায়োমেট্রিয়াম বা মাংসপেশি এবং একদম ভেতরের দিকে থাকে এন্ডোমেট্রিয়াম, যেখানে ভ্রূণ বা বাচ্চাটি প্রতিস্থাপন হয় এবং যেখান থেকে প্রত্যেক মাসে পিরিয়ডের সময় লেয়ারটি খসে মাসিকের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়। এই এন্ডোমেট্রিয়াম আর মায়োমেট্রিয়ামের মাঝের জায়গাকে বলা হয় জংশনাল জোন।
অ্যাডিনোমায়োসিস কেন হয় বা কীভাবে হয় সেটা ব্যাখ্যা করা খুবই কঠিন। কারণ, বিজ্ঞানীরাও এর সঠিক কারণ বলে উঠতে পারেননি। অ্যাডিনোমায়োসিসের ক্ষেত্রে এই যে জংশনাল জোনটি থাকে সেটার ঘনত্ব ১২ মিলিমিটারের বেশি হয়ে যায়। এন্ডোমেট্রিয়াম মানে ভেতরের লেয়ারটি মায়োমেট্রিয়ামের মধ্যে আস্তে আস্তে ঢুকতে থাকে। অ্যাডিনোমায়োসিস দুধরনের হয়, ফোকাল বা লোকাল অ্যাডিনোমায়োসিস এবং ডিফিউজ বা গ্লোবাল অ্যাডিনোমায়োসিস। ফোকাল/লোকাল অ্যাডিনোমায়োসিসে যে এন্ডোমেট্রিয়ামটি মায়োমেট্রিয়ামের লেয়ারের মাঝে ঢোকে, সেটি নির্দিষ্ট জায়গায় আবদ্ধ থাকে। আর ডিফিউজ বা গ্লোবাল অ্যাডিনোমায়োসিসের ক্ষেত্রে ইউটেরাসজুড়ে এন্ডোমেট্রিয়াম লেয়ারটি মায়োমেট্রিয়ামের মধ্যে আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ে।
উপসর্গ
সাধারণত ব্যথাপূর্ণ মাসিকচক্র শুরু হয়। সেই সময়ে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। প্রথমদিকে হয়তো যন্ত্রণা কম থাকবে, পরবর্তীতে যত সময় যাবে যন্ত্রণা বাড়তে থাকবে। এছাড়া অনিয়মিত ঋতুচক্র বা যন্ত্রণাদায়ক যৌনমিলন হতে পারে। পাশাপাশি বন্ধ্যাত্ব একটি অন্যতম কারণ। অ্যাডিনোমায়োসিস থাকলে প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে মানুষ বন্ধ্যাত্বের শিকার হন।
কোন পরীক্ষায় রোগনির্ণয়
এমন কোনও ব্লাড টেস্ট নেই, যেটা করে আমরা বুঝতে পারব অ্যাডিনোমায়োসিস আছে। আমরা আল্ট্রাসাউন্ড, টিভিএস, এমআরআই করে দেখতে পারি। টিভিএসে আমরা ইউটেরাসের কোনও জায়গা বড় হয়ে গিয়েছে কিনা, দেখতে পারি। ডিফিউজ বা গ্লোবালের ক্ষেত্রে পুরো ইউটেরাসটিই আকারে বড় হয়ে যায়। এমনকি আমরা দেখি ২৪ সপ্তাহের গর্ভবতী মহিলার মতো ইউটেরাসের আকৃতি হয়ে গিয়েছে। টিভিএসে লোকালি আমরা দেখতে পাই কিছু জায়গা বড় হয়ে গিয়েছে। ডিফিউজে দেখা যায়, পুরো ইউটেরাসটিই গোলাকার হয়ে গিয়েছে, স্বাভাবিক আকারের থেকে অনেকটা বড়। এছাড়া জরায়ুর রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়, কিছু স্ট্রাইট্রেড প্রোজেকশন দেখা যায়। এছাড়া দেখা যায় জংশনাল জোনের থিকনেস অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। এমআরআই করে ফাইব্রয়েডের সঙ্গে অ্যাডিনোমায়োসিসের পার্থক্য করতে পারি, জংশনাল জোনটা আরও ভালো করে দেখতে পারি।
অ্যাডিনোমায়োসিস এবং বন্ধ্যাত্ব
আমরা জানি যে, অ্যাডিনোমায়োসিসের সঙ্গে এন্ডোমেট্রিওসিস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সাধারণত এন্ডোমেট্রিওসিস থাকলে ৭০-৮০ শতাংশ মহিলার অ্যাডিনোমাযোসিস থাকে। দেখা গিযেে, সাধারণ যে জরাযু সংকোচন বা প্রসারণ হয, সেটি ভ্রূণকে যথাস্থানে প্রতিস্থাপনে সাহায্য করে। আপনার ডিম্বাণু ও শুক্রাণুকে জরাযুতে গমনে সাহায্য করে। কিন্তু অ্যাডিনোমাযোসিস থাকলে জরাযুর এই সংকোচন-প্রসারণ অস্বাভাবিক হতে শুরু করে। ফলে যথাস্থানে ভ্রূণ বসতে পারে না, বা পেঁছালেও বসতে পারে না বা বসে গেলেও তাড়াতাড়ি গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকে।
ইনফ্লামেটরি মার্কার যেমন আরওএস বা সাইটোকাইন মাত্রাগুলো বেড়ে গেলে প্রোজেস্টেরন রিসেপ্টর এবং অন্য রিসেপ্টরগুলি ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ফলে ভ্রূণ প্রতিস্থাপনে বাধা পায়। তাছাড়া কিছু মতবাদ অনুযায়ী কিছু রিসেপ্টর আছে যেমন এইচওএক্স, যেটা আপনার ভ্রূণটিকে ধরতে সাহায্য করে, অ্যাডিনোমায়োসিস থাকলে সেই সব রিসেপ্টরও শরীরে বা জরাযুর মধ্যে কমে যায়। ফলে ভ্রূণ প্রতিস্থাপন হতে অসুবিধা হয়।
চিকিৎসা
এক্ষেত্রে চিকিৎসা দুভাবে করা যায়- ওষুধের মাধ্যমে এবং অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। সাধারণত অ্যাডিনোমায়োসিসে সেরকম কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা হয় না। ওষুধের মধ্যে আমরা লেট্রজল ট্যাবলেট দিতে পারি, যেটা শরীরে হরমোন ইস্ট্রোজেনের মাত্রা খানিকটা কমায় এবং আপনার উপসর্গ উপশম করে। এছাড়া জিএনআরএইচ অ্যানালগ লিউপ্রোলাইড জাতীয় কিছু ইনজেকশন দেওয়া হয়, যা আপনার শরীরের ইস্ট্রোজেনের মাত্রা কমিয়ে দেয়। এতে কিছু উপসর্গের উপশম হয়। সেক্ষেত্রে ইউটেরাস রিসেপ্টিভিটির মাত্রাও বাড়িয়ে দেয। যাইহোক, ইনফার্টিলিটির ক্ষেত্রে আমরা লিউপ্রোলাইড অবশ্যই ব্যবহার করি। এছাড়া পেনটক্সিফাইলিন এবং ক্যাবারগলিনও ব্যবহার করা হয়।
অন্যদিকে, সার্জারি যদি ফোকাল বা লোকাল অ্যাডিনোমায়োসিস হয় সেক্ষেত্রে সফল হয। যদি ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা পদ্ধতি কাজ না করে, সেক্ষেত্রে আমরা সার্জিক্যাল অ্যাডিনোমায়োকটমি করে থাকি। কিন্তু এটি একটি মেজর সার্জারি এবং এতে জরায়ু কেটে বাদ দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই একে এড়িয়ে যাওয়া হয়।
সুতরাং, বন্ধ্যাত্বের ক্ষেত্রে আইভিএফই সেরা সম্ভাব্য উপায়। যদিও অন্য অনেক কারণেই আমরা আইভিএফ করে থাকি। কিন্তু অ্যাডিনোমায়োসিস বা এন্ডোমেট্রিয়োসিসে সাফল্যের হার কম থাকলেও অ্যাডিনোমায়োসিস থাকলে আইভিএফই সেরা সম্ভাব্য উপায়।