- কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য
হ্যাঁ! এবার আদিবাসী নববর্ষে ঝাড়খণ্ডের কোলহান অঞ্চলে একটি নতুন উলগুলানের সূচনা হল! আদিবাসীদের মধ্যে যাঁরা নিজেদের পরম্পরাগত ঐতিহ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে, নিজস্ব ধর্ম পরিত্যাগ করে খ্রিস্টান হচ্ছেন, এবং পাশাপাশি ‘তপশিলি জনজাতি’র জন্য সংরক্ষণের সমস্ত সুযোগসুবিধা নিচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে একাধারে ধর্মান্তরণ ও অন্যদিকে ধর্মান্তরিতদের এসটি বা তপশিলি জনজাতিত্বের স্ট্যাটাস বাতিলের জোরালো দাবি তুলেছেন, ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বিশিষ্ট আদিবাসী জননেতা, চম্পাই সোরেন। সম্প্রতি এই স্পর্শকাতর ইস্যু নিয়ে প্রতিবেশী ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী রাজনীতি জমে উঠেছে। ভেতরে ভেতরে সেই উত্তাপ পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে এমনকি উত্তরবঙ্গের মালদা, দুই দিনাজপুর ও জলপাইগুড়ি-ডুয়ার্সেও যে আছড়ে পড়তে পারে, এই আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়াও যাচ্ছে না। কারণ একটি ভিন্ন রাজনৈতিক পরিবেশে থাকলেও উত্তরবঙ্গের ‘ঝাড়খণ্ডি আদিবাসীরা’ (ওরাওঁ, মুন্ডা, সাঁওতাল, খাড়িয়া প্রভৃতি ছোটনাগপুর উপত্যকা থেকে আসা মানুষজন) তাঁদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভালোমন্দের ব্যাপারে তাঁদের মাতৃভূমি, ঝাড়খণ্ড-বিহারের দিকেই তাকিয়ে থাকেন। পশ্চিমবঙ্গে বা বলা ভালো, উত্তরবঙ্গে আজও করমপুজোর দিন ঠিক হয় ঝাড়খণ্ড নির্ধারিত আদিবাসী পঞ্জিকা অনুযায়ী। আজও আদিবাসী উৎসব-পরবে, সরহুল-সহরাইয়ের চাঁদ প্রথমে ওঠে লোহারদাগা, সিংভূম, রাঁচি বা ঝাড়খণ্ডর আকাশে। তারপর সেই চাঁদের আলো পড়ে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন, জঙ্গলমহল বা উত্তরবঙ্গের ঝাড়খণ্ডি আদিবাসী আকাশে। ফলে কি উত্তর কি দক্ষিণ, বাংলার আদিবাসীদের হৃদয়ে ঝাড়খণ্ড, চেতনায় ঝাড়খণ্ড! যদিও বাংলার পাহাড় ও সমতলের তিব্বতি-মঙ্গোলীয় জনজাতিদের ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য নয় কারণ তাদের জনজাতীয় আবেগ ভিন্ন দিশায় চলে।
সম্প্রতি, এবারের চৈত্র মাসের আদিবাসী নববর্ষ, সরহুল বা বাহা পরবের সন্ধিক্ষণে ধর্মান্তরিত আদিবাসীদের (বিশেষ করে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিতদের) ‘তপশিলি জনজাতিত্ব’ বাতিল করার দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন, খোদ ঝাড়খণ্ডের চার দশকের পোড়খাওয়া আদিবাসী জননেতা ও সে রাজ্যের বহুবারের মন্ত্রী তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, চম্পাই সোরেন। মজাটা হচ্ছে অন্তত ১৯৯০ থেকে গতবছরের জুলাই অবধি চম্পাই ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চায় ছিলেন। এর মধ্যেই ছ’মাসের জন্য ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছিলেন। তারপর হেমন্ত সোরেনের মুখ্যমন্ত্রী পদে পুনর্বহালের পর তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। বিজেপিতে এসেই তিনি আদিবাসীদের এই ধর্মান্তরণবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছেন। গত মার্চ-এপ্রিল জুড়ে এই ভাইরাল ঘটনায় মোটামুটি তোলপাড় ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওডিশার রাজনীতি। পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ায় খবরটি গুরুত্ব না পেলেও সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে প্রতিবেশী বাংলার আদিবাসী মহলেও এ নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এখন বিজেপি হোন আর যাই হোন, দীর্ঘদিনের ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার নেতা ও ঝাড়খণ্ডি রাজনীতিতে ‘কোলহান টাইগার’ হিসেবে পরিচিত চম্পাই এই জেহাদ ঘোষণা করেছেন। (ব্রিটিশরা তৎকালীন বিহারের ছোটনাগপুর এলাকার সাঁওতাল, মুন্ডা, হো, ভূমিজদের কোলহান ট্রাইব বলত। ঝাড়খণ্ডের পূর্ব ও পশ্চিম সিংভূম, সরাইকেল্লা-খারসোয়ান, এই তিনটি জেলা নিয়ে ঝাড়খণ্ডের পঞ্চম প্রশাসনিক বিভাগটি এখনও কোলহান বিভাগ নামে পরিচিত।) চম্পাই অকপটে বলছেন, ‘দীর্ঘ আন্দোলনের পর ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠিত হয়েছে, আজ ২৫ বছর। কিন্তু এখন সেই আদিবাসী আন্দোলনের গর্ভ থেকে সৃষ্ট ঝাড়খণ্ড সরকার আদিবাসীদের স্বার্থ দেখছে না। কাতারে কাতারে আদিবাসীরা খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত জীবনচর্যা থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। কিন্তু তারা সংরক্ষণের সমস্ত সুযোগসুবিধা নিচ্ছে। আদিবাসী ঐতিহ্য রক্ষণাবেক্ষণের লোক নেই! এটা একটা সাংঘাতিক সংকট! এটা চলতে পারে না!’ চম্পাইয়ের দাবি, ‘ঝাড়খণ্ডে ব্যাপকভাবে বাংলাদেশিরা আসছেন। তাঁরা আদিবাসী মেয়েদের বিয়ে করছেন। পঞ্চায়েত নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন, জনপ্রতিনিধিও বনে যাচ্ছেন। সাঁওতাল পরগনায় যেমন ধর্মান্তরণ হচ্ছে, সাহেবগঞ্জ, পাকুড়ে তেমনি ইন্টারকাস্ট বিয়ে হচ্ছে ব্যাপক। এছাড়া, শিল্পের নামে ব্যাপকভাবে জঙ্গলের লিজ দেওয়া হচ্ছে শিল্পপতিদের!’ চম্পাইয়ের মতে, ‘জঙ্গল থাকলে আদিবাসী থাকবে, আদিবাসী থাকলে জঙ্গল থাকবে।’ চম্পাই গ্রামে গ্রামে গিয়ে নতুন প্রজন্মকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, আাদিবাসীরা প্রকৃতির পূজারি। তারা গাছ-পাথর, পাহাড় ও জলের পূজারি। খ্রিস্টান হয়ে গির্জায় চলে গেলে আদিবাসীদের সারনাস্থল, দেশাওলি কারা দেখবে? তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি আদিবাসীদের জীবনে মাঝি, পরগনা, পাহান, মানকি-মুন্ডা, পাড়হা-রাজার মতো বিষয়গুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গির্জাকেন্দ্রিক জীবনের সঙ্গে এইসব আদিবাসী লোকজীবনের কোনও সম্পর্ক নেই।’ তাঁর দাবি, গোটা ঝাড়খণ্ড রাজ্যজুড়ে, এমনকি ওডিশা, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত আাদিবাসী এলাকায় তারা মানুষকে এসব বিষয় নিয়ে বোঝাচ্ছেন, সংগঠিত করছেন এবং ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছেন।
প্রসঙ্গত আদিবাসীদের ‘ধর্মান্তর ও ইশাই মিশনারি’-দের বিরুদ্ধে আদিবাসীদেরই একটি প্রাচীনপন্থী গোষ্ঠী এই জেহাদ আগেও তুলেছিল। ১৯৬৭ সালে লোকসভায় ধর্মান্তরিতদের তপশিলি স্ট্যাটাস বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন, জাতীয় স্তরের বরেণ্য আদিবাসী নেতা, তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বিহারের আদিবাসী সাংসদ কার্তিক ওরাওঁ। ইন্দিরা গান্ধির সরকার এর পরিপ্রেক্ষিতে একটি যুগ্ম সংসদীয় কমিটি গঠন করে। ৩২২ জন লোকসভা ও ২৬ জন রাজ্যসভার সাংসদ এই দাবিকে সমর্থন করলেও আদিবাসী রাজনীতির আবর্তে এই দাবি নাকচ হয়ে যায়। এবার দেখার নতুন করে চম্পাইয়ের এই আন্দোলনের ফলে জল কতটুকু গড়ায়!
চম্পাইয়ের নেতৃত্বে এই আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র, ঝাড়খণ্ডের কোলহান ডিভিশনের জনসংখ্যা ২০১১-র হিসেবে প্রায় ৫০ লক্ষ। এর মধ্যে ৫২ শতাংশ বাংলা, হিন্দি, উর্দু ও অন্যান্য অ-আদিবাসী ভাষাভাষী। সাঁওতালি, হো, মুন্ডারি মিলিয়ে আদিবাসী ভাষাভাষীর অনুপাত বড়জোর ৩৮ শতাংশ। বাকি ১০ শতাংশ ওডিয়া ভাষাভাষী। আদিবাসী ভাষাভাষী মানুষের অনুপাত স্বাভাবিকভাবেই আরও কমবে কারণ ২০১১-র জনগণনার পর ১৪ বছরে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই ওই এলাকাতেও বড় রকমের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটেছে। এহেন পরিস্থিতিতে বিষয়টিকে দেখলে চম্পাইয়ের কাজটিকে কঠিনই মনে হয়!
এবার প্রসঙ্গক্রমে ঝাড়খণ্ডের প্রতিবেশী রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গের জনজাতি সমাজের ধর্মীয় শ্রেণিবিভাজনটা কেমন? সেটা একটু দেখা যাক! এই প্রশ্নের উত্তর বা বাংলার জনজাতি সমাজের সাম্প্রতিক ধর্মীয় অবস্থান নানা কারণে আমাদের জেনে রাখা দরকার। কিন্তু সেটা জানলে একটু বিস্মিত হতে হয় বৈকি! সেন্সাসের হিসেব বলছে, পশ্চিমবঙ্গেও জনজাতিদের মধ্যে ১৯৭১-২০১১, এই ৪০ বছরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনুপাত (রাজ্যের জনজাতি জনসংখ্যায়) কমেছে, ২০ শতাংশ। পক্ষান্তরে, খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ও বৌদ্ধদের অনুপাত বেড়েছে যথাক্রমে প্রায় ৪ ও ২.৬৭ শতাংশ। উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রে জনজাতিদের মধ্যে এই সময়ে খ্রিস্টানদের অনুপাত যেমন বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ, তেমনি বুদ্ধিস্টদের অনুপাতও ৭ শতাংশ বেড়েছে! সেন্সাস বলছে ১৯৭১-২০১১, এই ৪ দশকে উত্তরবঙ্গে হিন্দু জনজাতির অনুপাত কমেছে ১৩ শতাংশ!
আর মনে রাখতে হবে ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী ‘তপশিলি জাতি’(এসসি)-দের ক্ষেত্রে ধর্ম একটি শর্ত হলেও, ‘তপশিলি জনজাতি’(এসটি)-দের ক্ষেত্রে ধর্ম কোনও বিবেচ্য বিষয় নয়। আদিবাসীদের ধর্মান্তরণ বিষয়টি সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে প্রশ্নাতীত না হলেও সংরক্ষণের অধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রশ্নটি কিন্তু ভীষণভাবে রাজনৈতিক বা বলা ভালো রাষ্ট্রনৈতিক। ফলে সমস্যাটি একটু জটিলই!
(লেখক লোকগবেষক ও সাহিত্যিক। শিলিগুড়ির বাসিন্দা)