উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: আধুনিক জীবনযাত্রা প্রজনন ব্যবস্থার (Reproduction) ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলে। প্রজনন স্বাস্থ্য ভালো রাখতে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা নির্বাহ করা জরুরি। লিখেছেন বন্ধ্যাত্ব বিশেষজ্ঞ ডাঃ কবিতা মন্ত্রী
১৯৫০ সালে পুরুষরা গড়ে প্রতি মিলিলিটারে ১১.৩ কোটি শুক্রাণু উৎপাদন করতেন। ২০২৩ সালে সেই সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ৫.৫ কোটিতে। এই অবস্থাকে অনেক প্রজনন জীববিজ্ঞানী শান্ত মহামারি বলেছেন। মহিলাদের ক্ষেত্রেও প্রায় একই অবস্থা। আর এজন্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনই অনেকাংশে দায়ী। আমরা কীভাবে ঘুমোচ্ছি, খাচ্ছি, ঘুরছি, কাজ করছি – সবই প্রজনন ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলছে। সেইসঙ্গে আমাদের কিছু অভ্যাস, পরিবর্তিত কিছু জীবনশৈলীও দায়ী। যার মধ্যে অন্যতম –
স্ট্রেস – আপনার অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি ৫০ হাজার বছর আগে যেভাবে সাড়া দিত, এখনও সেভাবে দিচ্ছে, কর্টিসল ও অ্যাড্রিনালিন হরমোন নিঃসরণ করছে, আপনাকে কয়েক মিনিট লড়তে সাহায্য করছে, কিন্তু তারপর থিতিয়ে পড়ছে। এর কারণ স্ট্রেসের প্রভাব। ফলে কর্টিসল, হাইপোথ্যালামিক পালস জেনারেটরের ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। এই হাইপোথ্যালামিক পালস গোনাডোট্রপিন হরমোন নিঃসরণ করে। কিন্তু এই হরমোন যথাযথ নিঃসরণ না হওয়ায় পিটুইটারির যমজ বার্তাবাহক ছন্দ হারিয়ে ফেলছে। এতে মহিলাদের মাসিক চক্রের দ্বিতীয়ার্ধের সময় কমে যাচ্ছে, যা লুটেল পর্যায় নামে পরিচিত।
এই পর্যায়টি ডিম্বস্ফোটনের আগে ঘটে এবং পরবর্তী মাসিকের আগে শেষ হয়। এমনকি গর্ভধারণে ব্যর্থ হওয়ার ঘটনাও ঘটে। অন্যদিকে, পুরুষদের ক্ষেত্রে লেডিগ কোষগুলি টেস্টোস্টেরন উৎপাদন ব্যাহত করে এবং অণ্ডকোষ ধীরগতিতে কম সংখ্যায় শুক্রাণু নিঃসরণ করে। এক্ষেত্রে দিনে দু’বার দশ মিনিট করে শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম অনেকটাই সাহায্য করতে পারে।
কম ঘুম – বর্তমান সময়ে অনেকেই ছয় ঘণ্টার কম ঘুমোন, যার প্রভাব পড়ে প্রজনন ব্যবস্থায়। এতে মহিলাদের লুটেইনাইজিং হরমোন অকেজো হয়ে পড়ে, এসট্রাডিঅল নিঃসরণ কমে যায়। পুরুষদের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন কার্যকারিতা প্রায় ১৫ শতাংশ কমে যায়। সুতরাং, সাত থেকে নয় ঘণ্টা ঘুমোনো সবথেকে ভালো।
প্রক্রিয়জাত খাবার খাওয়ার অভ্যাস – আমরা এখন জাংক ফুড, প্যাকেটজাত খাবার খেতে বড় বেশি অভ্যস্ত। চিজবার্গার পেট তো ভরায়, কিন্তু ওমেগা-থ্রি ফ্যাট, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ম্যাগনেসিয়াম, ফোলেট, ভিটামিন-ডি জাতীয় পুষ্টি জোগায় না। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্রতিদিন আলু ভাজা (ফ্রায়েড পটেটোজ) খেলে জীবিত সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা ১২ শতাংশ কমে যায়, উপযু্ক্ত বয়স, বিএমআই এবং মদ্যপানের মাত্রা সীমিত করা সত্ত্বেও। একইভাবে পুরুষদের ক্ষেত্রে শুক্রাণুর সংখ্যা ২৫ শতাংশ কমে যেতে পারে। অতএব খাদ্যতালিকায় মাছ, বাদাম, শাকসবজি, জলপাই তেল এবং শিম্ব জাতীয় খাবার যেমন, মশুর ডাল, মটরশুঁটি, ছোলা, সয়াবিন রাখতে হবে।
মদ্যপান – এক সপ্তাহে পাঁচবারের কম মদ্যপান সামান্য ক্ষতি করে। কিন্তু সেটা যদি সাতবারের বেশি হয়ে যায় তাহলে সমস্যা। যেমন, আইভিএফ প্ল্যান্টেশন ১৪ শতাংশ কমে যায়। পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রতিদিন মদ্যপানের ফলে প্রতি মিলিলিটারে প্রায় ০.৫ কোটি শুক্রাণু কমে যায়। একইভাবে ক্যাফেইন, নিকোটিন সমান ক্ষতিকারক।
সুতরাং, দুই কাপের কম কফি খেতে হবে এবং সপ্তাহে পাঁচবারেরও কম মদ্যপান করা উচিত। আর নিকোটিন তো এড়িয়ে চলাই ভালো।
দেরিতে বিয়ে – অতি অল্প বয়সে সন্তান জন্মদানের বহু ঘটনা রয়েছে। কিন্তু ১৯৯০ সালে সেই ‘অল্প বয়স’ একলাফে পৌঁছেছিল ২২ বছরে। আর বর্তমানে সেটা ২৭ বছর হয়েছে। সমস্যা হল, ডিম্বাশয় বিজ্ঞান তার সময়সীমা বাড়ায়নি। প্রতি চক্রে মহিলাদের প্রজনন ক্ষমতা ২৫ বছর বয়সে ২৫ শতাংশ থেকে কমে ৩৫ বছর বয়সে ১০ শতাংশে নেমে আসে। পুরুষদের ক্ষেত্রে ২০-৪০ বছর বয়সের মধ্যে শুক্রাণুতে ডি-নোভো মিউটেশন দ্বিগুণ হয়। ফলে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার ও স্কেলেটাল ডিসপ্লাসিয়াসের ঝুঁকি বাড়ে।
যদি মহিলারা ৩২ বছর এবং পুরুষেরা ৪০ বছর বয়সের পর সন্তান নেওয়ার কথা ভাবেন, তাহলে জননকোষ উচ্চমানের থাকাকালীন ডিম্বাণু ও শুক্রাণু হিমায়িত করার ভাবনা বিবেচনা করা উচিত।
বারেবারে ঘুরতে যাওয়া – কানাডার একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যেসব মহিলা মাসে দু’বার পাঁচ বা ততোধিক অঞ্চলে ভ্রমণ করেন, তাঁদের গর্ভপাতের হার দ্বিগুণ বেড়েছে এবং গর্ভধারণের জন্য অতিরিক্ত তিন মাস প্রয়োজন হয়েছে। এর কারণ জেট ল্যাগের পাশাপাশি খাওয়া-বিশ্রামের সময়টাও বদলে যাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে প্রজনন ব্যবস্থায়।
স্ক্রিনে বেশি সময় কাটানো – যেসব মহিলা চার ঘণ্টারও বেশি সময় স্ক্রিনে কাটান, তাঁদের ডিম্বস্ফোটনের সম্ভাবনা ৩০ শতাংশ বেশি, সম্ভবত নীল আলোর সার্কাডিয়ান ডিলে এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই এর জন্য দায়ী। তাছাড়া সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যেসব মহিলা প্রতিদিন তিন ঘণ্টার বেশি ইনস্টাগ্রামে সময় কাটান, তাঁদের জেগে ওঠার সময় কর্টিসলের মাত্রা ১৮ শতাংশ বেশি ছিল এবং গর্ভধারণ করতে ১৫ শতাংশ বেশি সময় লেগেছিল। লেফলে
শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা – শারীরিক কার্যকলাপের অভাবে যেমন িডম্বাশয়ের কার্যকারিতা কমতে পারে, তেমনই কমতে পারে শুক্রাণুর সংখ্যা ও গুণমান। শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে বন্ধ্যাত্বের একটি প্রধান কারণ।
যা করবেন
সাত থেকে নয় ঘণ্টা ঘুমোনো প্রয়োজন
প্রতি সপ্তাহে ২০০ মিলিগ্রামেরও কম ক্যাফেইন, পাঁচবারেরও কম মদ্যপান করা উচিত এবং নিকোটিন এড়িয়ে চলাই ভালো
বেশিরভাগ দিন অন্তত ৩০ মিনিট নড়াচড়া করুন, ব্রিদিং এক্সারসাইজ এবং হঁাটাহঁাটি করতে পারেন
প্লাস্টিক নয়, গরম খাবারের জন্য কাচ বা স্টিলের পাত্র ব্যবহার করুন এবং নন-স্টিক প্যান বাদ দিন
প্যারাবেনমুক্ত প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করা উচিত
শুতে যাওয়ার এক ঘণ্টা আগে স্ক্রিন অফ করুন এবং সবসময় নাইট-শিফট মোড চালু রাখুন
প্রচুর শাকসবজি ও পুষ্টিকর খাবার খান
প্রজনন সংক্রান্ত সমস্যা হলে শুরুতেই পরীক্ষা করান, সম্ভব হলে ৩০ বছরের মধ্যে সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করুন
সন্তান দেরিতে নেওয়ার ভাবনা থাকলে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু হিমায়িত করার ভাবনা বিবেচনা করতে পারেন