রাজু সাহা, শামুকতলা: মাসখানেক আগে নিজেদের শিশুশ্রমিকমুক্ত (Child labour) বাগান হিসেবে ঘোষণা করেছে কোহিনুর। কোহিনুর চা বাগান এই মাইলস্টোন ছুঁয়েছে বলে দাবি করলেও ডুয়ার্সের বাকি বাগানগুলোয় কিন্তু এখনও নাবালকদের কাজ করতে দেখা যায়। যদিও বাগানগুলির কর্তৃপক্ষ নিজের মুখে সেকথা স্বীকার করতে চায় না।
মাঝেরডাবরি চা বাগানের ম্যানেজার চিন্ময় ধর যেমন সাফ বলেন, ‘আমাদের চা বাগানে শিশুশ্রমিক এবং কিশোর-কিশোরীদের দিয়ে কাজ করানো হয় না। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, কিশোর-কিশোরীদের এই সময় পড়াশোনা এবং মানসিক বিকাশ ঘটার সময়। তাই এদেরকে দিয়ে এই সময় কাজ করানো আমি সমর্থন করি না।’ প্রতিটি চা বাগান যাতে শিশুশ্রমিকমুক্ত চা বাগান হয়, সেই দাবি করেছেন তিনি।
শিশুদের দিয়ে কাজ করানোর সব থেকে বড় ‘সুবিধা’ হল মজুরি অত্যন্ত কম। আলিপুরদুয়ার-২ (Alipurduar) ব্লকের কোহিনুর লাগোয়া অন্যান্য বাগানের কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের বাগানে শিশুরা কাজ করে না। তবে ছোকরা হাজিরা বা ছোটা হাজিরা চালু রয়েছে। এই ছোকরা হাজিরা কী? কিশোর-কিশোরীরা, অর্থাৎ ১৪ থেকে ১৮ বয়সের ছেলেমেয়েরা বাগানের কাজ করলে সেটাকেই ছোটা হাজিরা বলা হয়। বড়দের অর্ধেক হাজিরা মেলে তাদের। তবে তাদের দিয়ে অনেকটা হালকা কাজ করানো হয় বলে বাগান কর্তাদের দাবি। তবে বাগান কর্তারা এমন দাবি করলেও ওই ছোটা হাজিরার শ্রমিকদের মধ্যে অনেকের বয়সই কিন্তু ১৪ বছরের কম। এমনটাই অভিযোগ।
শামুকতলা থানা এলাকায় ১১টি চা বাগান রয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, কোহিনুর চা বাগান যেভাবে নিজেদের শিশুশ্রমিকমুক্ত চা বাগান হিসেবে ঘোষণা করেছে, সেভাবে ধওলাঝোরা, তুরতুরি, ফাসখাওয়া, চুনিয়ার মতো চা বাগানগুলি কেন এমন ঘোষণা করছে না? এই দাবি করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং শ্রমিক সংগঠনগুলি। সিটুর আলিপুরদুয়ার জেলা সভাপতি বিদ্যুৎ গুণ বলেন, ‘অনেক চা বাগানেই শিশুশ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। ছোটা হাজিরার শ্রমিকদের আড়ালে শিশুশ্রমিকরাও কাজ করছে। শ্রম দপ্তরের এটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার।’
তুরতুরি চা বাগানের ম্যানেজার রণজিৎ মৈত্র দাবি করেন, তাদের বাগানে কোনও শিশুশ্রমিক কাজ করে না। তবে কয়েকজন কিশোরী কাজ করে, তাও সেটা শ্রম আইন মেনেই।
বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন অভিযোগ তুলেছে, বিশেষ করে রুগ্ন চা বাগানগুলিতেই এধরনের ‘অভ্যাস’ বেশি চালু রয়েছে। সেসব বাগানের শ্রমিকদের একটা বড় অংশই তো কাজের খোঁজে ভিনরাজ্যে চলে গিয়েছে। তাই সেখানে শ্রমিক মেলাটা সমস্যাজনক। সেক্ষেত্রে ভরসা অল্পবয়সিরা।
১৮ বছরের কমবয়সি কিশোর-কিশোরীদের দিয়ে বাগানের কাজ করানোর ক্ষেত্রে শ্রম আইনে পরিষ্কার বলা রয়েছে, কোনও বিপজ্জনক কাজ তাদের দিয়ে করানো যাবে না। কিন্তু চা বাগানে অনেক কাজই বিপজ্জনক। এক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হয় না বলেও অভিযোগ রয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সিনির কর্তাদেরও একই কথা। তাঁরা বলছেন, চা বাগানগুলিতে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় দেখা যায় কিশোর-কিশোরীদের মাঝে শিশুরাও কাজ করছে। এটা পুরোপুরি বন্ধ হওয়া দরকার।
শ্রমিক নেতাদের কথায়, চা বাগান শিশুশ্রমমুক্ত না হওয়ার পিছনে কেবল মালিকপক্ষ নয়, শ্রমিকদের দারিদ্র্যও দায়ী। বিদ্যুৎ যেমন বললেন, ‘ন্যূনতম মজুরি চালু না হওয়ায় চা শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। এর ফলে বড়দের সঙ্গে ছোটরাও সংসারের অভাব মেটাতে কাজ করছে।’ ন্যূনতম মজুরি চালু হলে এই সমস্যা অনেকটাই মিটবে বলে আশাবাদী শ্রমিক নেতারা।