রামসিংহাসন মাহাতো
আজ সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে, ওগো আমার প্রিয়….। কবিরা বড় ভালোমানুষ। তাই সহজে তাঁরা এসব কথা বলতে পারেন। কিন্তু আমরা যাঁরা ট্রাফিক সিগন্যালের আইকন মার্কা ছাপোষা সাধারণ মানুষ, তাঁদের কবির কথা ধরে চললে হয় না। আমাদের রঙের ব্যাকরণ আমাদের সুবিধামতো। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা পালটে পালটে যায়।
স্কুলবেলায় রায়গঞ্জে দেখেছি দোলের দিন আমাদের বাড়িতে দুপুরে ভাত হত না। হত মালপোয়া আর মাংস। বড় কাঠের বারকোশ আর বড় বড় গামলাগুলোতে থাকত মালপোয়া, আর কড়াইতে ধরবে না বলে ভাতের হাঁড়িতে রান্না হত মাংস। তখন ব্রয়লার মুরগির চল হয়নি। আর কচি পাঁঠা আমাদের বাড়িতে আসত না। হোলির দিন রান্না হত প্রচুর চর্বিওয়ালা বড় বড় পিস করা খাসির মাংস। হাঁড়িতে শিলপাটায় বাটা শুকনো লংকা আর চর্বি মিলেমিশে টগবগ করে ফুটত লাল রং। এই রং আমাদের জীবনে এমন মর্মে মিশেছিল যে বাবা-মা আমি এবং ভাইয়ের জন্য অত মালপোয়া আর মাংস কেন, এই প্রশ্ন কোনওদিনও মাথায় আসেনি। শুধু দেখেছি, বাড়িতে দু’তিনটে যোগীরার দল আসত। তারা গোল হয়ে ঢোলক আর করতাল বাজিয়ে, আবির উড়িয়ে, নাচ-গান জুড়ে দিত। এই দলে জাকিরও থাকত। হিন্দুদের উৎসবে ওকে কখনও কুণ্ঠিতভাবে রং মাখতে বা মাখাতে দেখিনি। আধ ঘণ্টা ধরে চলত ওদের হুল্লোড়।
যোগীরা সারা রারা রারা।
এই গান শুধু বিহারের নয়, গোটা হিন্দি বলয়ের ফাগুয়ার লোকগান। ভোজপুরি, বেনারসি, অওধি, রাজস্থানি সহ এতে প্রায় পঞ্চাশটি আঞ্চলিক ভাষার উপাদান মিশে আছে। আর মালদার গম্ভীরায় যেমন নানা অর্থাৎ শিবকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন সামাজিক অনাচার তুলে ধরা হয়, তেমনি ফাগুয়ার এই গানেও কৌতুক ও ব্যঙ্গের মাধ্যমে সুবিধাবাদী রাজনীতি ও নানা সামাজিক অনাচারের কথা উঠে আসে। বসন্ত পঞ্চমী থেকে প্রতি রাতে খাওয়াদাওয়ার পর মহড়া চলত। উদযাপন হত হোলির দিন। চর্যাপদের বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য কবিরা যেমন হঠযোগ সাধনার জন্য সান্ধ্য ভাষায় পদ রচনা করতেন (কাআ তরুবর পঞ্চবি ডাল…) তেমনি বৈরাগ্যের অবস্থান থেকে এই যোগীরাও হঠযোগ সাধনার জন্যই এই সান্ধ্য পদগুলি রচনা করেন। সান্ধ্য মানে এর প্রকাশ্যে একটা অর্থ রয়েছে আর অন্তর্নিহিত অন্য অর্থ আছে। এই গানের একটি অংশ খুব ভালো লাগত। সেখানে প্রশ্নোত্তর ছিল। যে
বৃত্ত ঘিরে গান চলত, তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দলের একজন প্রশ্ন করতেন–
কেকরা খাতির পান বনল বা (কার জন্য পান সাজানো হয়েছে),
কেকরা খাতির বাঁশ (কার জন্য রাখা হয়েছে বাঁশ),
কেকরা খাতির পুরি-পুয়া (কার জন্য লুচি মালপোয়ার আয়োজন),
কেকর হোই সত্যানাস (কার সর্বনাশ হবে)? যোগীরা সারা রারা রারা রারা।
প্রশ্নকর্তা মাঝখান থেকে সরে যেতেই আর একজন লাফিয়ে মাঝখানে এসে তার উত্তর দিতেন–
নেতবন খাতির পান বনল বা (নেতাদের জন্য পান সাজানো হয়েছে),
পাবলিক খাতির বাঁশ (জনগণের জন্য বাঁশ),
অফসর খায়ে পুরি-পুয়া (অফিসাররা খাচ্ছেন পুরি ও মালপোয়া),
সিস্টেম ভইল সত্যানাস (আর বিধি ব্যবস্থার সর্বনাশ হচ্ছে)।
ফাগুয়ার গান আর প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে হুল্লোড় করে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ত যোগীরার দল। তাঁদের মালপোয়া আর মাংস দেওয়া হত। তার সঙ্গে থাকত কয়েক লোটা ভর্তি ভাংয়ের শরবত।
আমাদের জীবনে সেই হোলি আর নেই। এখন দোলপূর্ণিমা মানেই নিরামিষ সাত্ত্বিক আহার।
আগে বাড়ির আশপাশে ফাঁকা জায়গা বা খোলা মাঠের অভাব ছিল না। সেখানে দোলের আগের দিন হত বুড়ির ঘর পোড়ানো বা নাড়া পোড়া। কাঠখড় জোগাড় করে ফাঁকা মাঠে দুপুর থেকেই সেই ঘর তৈরির আয়োজন চলত। হিন্দি বলয়ে যেটা হোলিকা দহন নামে পরিচিত, বাংলায় সেটাই চাঁচর উৎসব বা নাড়া পোড়া। হোলি উৎসবের সঙ্গে আগুনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আসলে হোলি হল পৃথিবীর প্রাচীনতম উৎসবগুলির একটি। বেদের আমল থেকে চলে আসছে। আর তখন অগ্নি ছিলেন প্রধান দেবতা। অথর্ব বেদে এর উল্লেখ রয়েছে। বুদ্ধদেবের বাণীর সংকলন ‘উদানবর্গ’-এও এর বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। আর এই বর্ণনা দিয়েছেন বুদ্ধদেব নিজে। তার মানে তখন হোলি খেলার ভালোই প্রচলন ছিল। ২৩০০ বছর আগের ছত্তিশগড়ের সীতাবেঙ্গ গুহায় কাটা দেওয়ালের উপরের দিকে ব্রাহ্মী লিপিতে দুই লাইনের একটি শিলালিপি বর্ণনা থেকে বোঝা যায় এটা তখন মূলত মহিলাদের উৎসব ছিল। ২০০০ বছর আগে সাতবাহন রাজা হলের লেখা ‘গাথাসপ্তশতী’ গ্রন্থে তো একে অপরের দিকে রং এবং জল ছুড়ে হোলি খেলার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সেখানেও দেখা যাচ্ছে পিচকারি মারছেন মহিলারা, পুরুষরা নন। মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দমিয়ে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবল হতেই রঙের পিচকারি মহিলাদের হাত থেকে চলে এসেছে পুরুষের হাতে।
ইতিহাস বলে, পশ্চিম ভারতের উৎসব ‘হোলি’ বঙ্গদেশে এসেছিল সেন রাজাদের আমলে। আদতে পশ্চিমী হোলি ছিল বিষ্ণুকেন্দ্রিক উৎসব। কিন্তু গীতগোবিন্দের কবি জয়দেবের হাত ধরে সেখানে কৃষ্ণের প্রবেশ ঘটে। তারপর থেকে ধীরে ধীরে হোলি রূপান্তরিত হয়েছে কৃষ্ণের দোলে। পরবর্তীতে চৈতন্যদেব দোলকে নতুনভাবে সাজালেন। নৃত্য, গীত, কীর্তন, পদযাত্রায় উৎসবের ছোঁয়া লাগল। আবির, কুমকুমে দোল হয়ে উঠল রঙের উৎসব।
এই রঙের উৎসবে কতটা ধর্ম থাকবে, আর কতটা ব্যবসা, তা নিয়েই বিভিন্ন সময়ে নানা পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে এতে। হোলিকে কেন্দ্র করেও অন্য উৎসবের মতো বাণিজ্য চলে পুরোদমে। রং, আবির থেকে শুরু করে মিষ্টি বা জামাকাপড়ের বিক্রি তুঙ্গে ওঠে। কনফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্স-এর হিসেব বলছে, হোলি উপলক্ষ্যে এবার দেশে ৬০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হতে পারে। গত বছর এই অঙ্ক ছিল ৫০ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের তুলনায় এবার ব্যবসা বাড়বে প্রায় ২০ শতাংশ। এর মধ্যে রাজধানী দিল্লিতেই ব্যবসা হতে পারে ৮ হাজার কোটি টাকার। রাজধানী অনেক দূরের ব্যাপার, আমাদের কোচবিহারের উদাহরণ ধরা যাক। এ শহরের মানুষের জীবনযাত্রার প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তই মদনমোহনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এখানকার মানুষের শয়নে স্বপনে মননে আছেন মদনমোহন। তাঁকে উৎসর্গ না করে এ শহরের মানুষ আবির খেলেন না। সবাই দোলের দিন আবির দিতে যান মদনমোহনকে। আর মদনমোহনবাড়িতে তো শুধু আবির নিয়ে যাওয়া যায় না। দেবতার জন্য দুটো সন্দেশ নিয়ে যেতেই হয়। সব মিলিয়ে দোলে রাসমেলার মতো টন টন সন্দেশ বিক্রি না হলেও, যতটুকু হয় তা উত্তরবঙ্গের আর কোনও শহরে সারা মাসেও বিক্রি হয় না। তার মানে মদনমোহনের প্রতি কোচবিহারের মানুষের ভক্তি বাড়ছে এমনও নয়। হাতের মুঠোয় কথা বলা ও ছবি তোলার যন্ত্র চলে আসায় সোশ্যাল মিডিয়ায় জোয়ার শুরু হয়েছে। তাতে আমাদের উপস্থিতি জাহির না করলে মান থাকে না। সেজন্য সেখানে আগে পৌঁছানোর তাগিদ থাকে। তাই প্রি-হোলি ফেস্ট। এখন কোচবিহার শহরে মদনমোহনকে বাদ দিয়েই আগাম বসন্ত উৎসবে আবির উড়ছে। বদলে যাচ্ছে কোচবিহারের দোলের পরম্পরাও। আর শুধু কোচবিহার কেন, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, ইসলামপুর, রায়গঞ্জ, মালদা, বালুরঘাট সব শহরেরই দোলচিত্র বদলে গিয়েছে।
প্রথমেই বলেছি, আমাদের রঙের ব্যাকরণ সুবিধেমতো পালটে পালটে যায়। আগে লাল রঙের আবির মেখে আমরা ভাবতাম, সাম্যবাদ চলে এসেছে। আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনও ভেদ নেই। এখন জানি ছন্দে ছন্দে সব রং বদলায়। তাই লাল নয়, গৃহলক্ষ্মীর হাত ধরে হাজার বারোশো যাই হোক, মাল আসুক ঘরে। সাধা লক্ষ্মী ঠেলে ফেলতে নেই।