- রন্তিদেব সেনগুপ্ত
তিন দশক পরে আরও একজন কেউ নরেন্দ্র মোদিকে রাজধর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। তিন দশক আগে, মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী তখন দেশের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী মোদিকে রাজধর্ম পালনের সুপরামর্শটি দিয়েছিলেন। প্রেক্ষাপটটি ছিল, গুজরাট দাঙ্গা। এবার রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সরসংঘচালক মোহন ভাগবত মোদিকে রাজধর্ম পালনের পরামর্শ দিয়েছেন। এবারের প্রেক্ষাপট, লোকসভা নির্বাচনে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজেপির পৌঁছাতে না পারা।
গুজরাট দাঙ্গার পর বাজপেয়ী সরাসরিই মোদিকে রাজধর্ম পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেখানে কোনও রাখঢাক ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী মোদির ভূমিকায় তিনি যে বিরক্ত হয়েছিলেন, সেটি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বাজপেয়ী। মোহন ভাগবত অবশ্য একটু আড়াল রেখেছেন। তবে সংঘের স্বয়ংসেবকদের কর্মসূচিতে যে বক্তব্য তিনি রেখেছেন, সেটি শুনলে বুঝতে অসুবিধা হয় না কার উদ্দেশে তিনি এই কথাগুলি বলছেন এবং ভাগবতের বক্তব্যে এটাও পরিষ্কার হয়েছে, মোদি এবং শা’র নেতৃত্বে যে বিজেপি চলছে, সেই বিজেপিকে নিয়ে তিনি আদৌ খুশি নন।
শুধু ভাগবতেই অবশ্য শেষ হয়ে যাচ্ছে না। ভাগবতের ওই বক্তব্যের ক’দিন পরেই সংঘের আরেক বরিষ্ঠ কর্মকর্তা ইন্দ্রেশ কুমারও একই রকম কড়া তিরস্কার করেছেন বিজেপি নেতৃত্বকে। এক্ষেত্রেও মূল লক্ষ্য সেই মোদি-শা। শুধু মৌখিক তিরস্কারই নয়, সংঘের মুখপত্র অর্গানাইজারেও নির্বাচনি বিপর্যয়ের জন্য বিজেপিকে দায়ী করে লেখা প্রকাশ করা হয়েছে।
ভোটের ফল বেরোনোর পর সংঘ নেতৃত্বের এইসব বক্তব্য বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়ে গিয়েছে। ভোটের আগে এবার একটি বিষয় রাজনৈতিক মহলে বেশ চর্চিত হচ্ছিল। শোনা যাচ্ছিল, মোদি এবং শা যেভাবে দলকে পরিচালনা করছেন, বিশেষ করে সংগঠনকে ছাপিয়ে মোদি যেভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছেন, সেটি সংঘের একটি বড় অংশ মোটেই সমর্থন করছে না।
গত কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছিল সংঘকে অস্বীকার করার একটি প্রবণতা মোদি এবং শা’র ভিতর ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। মোদি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠদের ভিতর সংঘকে অস্বীকার করার প্রবণতা যে এসেছে সেটি আরও প্রকট হয়েছিল নির্বাচন চলাকালীনই বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডার একটি বক্তব্যে। নাড্ডা বলেছিলেন, সংঘের সহায়তা ছাড়াই বিজেপি এখন একক শক্তিতে নির্বাচনে লড়তে পারে। নাড্ডার এই বক্তব্য সংঘের কার্যকর্তাদের যে খুশি করেনি এটি নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে।
মোদি-শা’র বিজেপির সঙ্গে ভাগবতের সংঘের দূরত্ব বাড়ছে এমন কথাও শোনা যাচ্ছিল এবং সেকথা যে খুব একটা ভুল তা-ও বলা যাবে না। সংঘ সূত্রেই জানা যায়, এবার ভোটে বহু রাজ্যেই (এর ভিতর উত্তরপ্রদেশও পড়ে) সংঘের স্বয়ংসেবকরা ভোটের কাজে সেভাবে নামেননি। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা সম্পূর্ণই নিশ্চেষ্ট ছিলেন। তার খেসারত এবার ভোটে বিজেপিকে দিতে হয়েছে।
আর ভোটের ফল বেরোনোর পর ভাগবত নিজেই তাঁর বক্তব্যে পরিষ্কার করে দিয়েছেন, মোদি-শা’র বিজেপির সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। মোদি-শা’র চালচলন তাঁদের পছন্দ হয়নি। আরএসএসের এই ক্ষোভটি মোদি জানতেন না এমন নয়। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, মোদি হাওয়ায় এবারও তিনি বিজেপিকে তিনশো পার করিয়ে দিতে পারবেন এবং তখন আরএসএসকে নিতান্তই একটি ‘সাংস্কৃতিক সংগঠনে’ পরিণত করিয়ে দিতে তাঁর খুব একটা অসুবিধা হবে না। কিন্তু প্রথম দফা ভোটের পরই মোদি বুঝেছিলেন, হাওয়া এবার খুব সুবিধার নয়। তাই ছুটে গিয়েছিলেন নাগপুরে। সেখানে সংঘের শীর্ষকর্তাদের সঙ্গে তাঁর কী আলোচনা হয়েছিল জানা যায় না। তবে অনেকে বলেন, সংঘের শীর্ষকর্তারা ভোটের ফল যে আশানুরূপ হবে না সেই আশঙ্কার কথা তাঁকে শুনিয়ে দিয়েছিলেন। আর তারপরই মোদি মরিয়া হয়ে হিন্দু-মুসলমান ইস্যু তুলে ভোট বিভাজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
ভাগবত, ইন্দ্রেশ কুমারদের এইসব কথাবার্তা এবং অর্গানাইজারে ওরকম একটি লেখা প্রকাশ হওয়ার পর অনেকে বলছেন, সংঘ নেতৃত্ব যদি এতই উদ্বিগ্ন ছিল, তাহলে আগেই তারা মোদি এবং শা-কে সতর্ক করেনি কেন? যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন। সংঘের বিভিন্ন সূত্র থেকে বিভিন্ন সময়ে জেনেছি, সংঘ যে একেবারে সতর্ক করার চেষ্টা করেনি ব্যাপারটা এমন নয়। বরং সংঘ মাঝেমাঝেই সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে। বিজেপির সঙ্গে সংঘের সমন্বয়সাধনকারী যে বৈঠকগুলো হয়, সেখানেও সংঘ বিজেপি নেতাদের সতর্ক করেছে। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্ব তাতে কর্ণপাত করেনি।
সংগঠনের ভিতরে মোদি এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন, এতটাই প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছিলেন এবং দলের সাধারণ কর্মীদের সামনে নিজের লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ এমনভাবে তৈরি করেছিলেন যে, সংঘকে কার্যত অমান্য করে চলেছিলেন তিনি এবং সংগঠনে তাঁর অনুগামীরা। আরএসএস ক্ষুব্ধ হচ্ছিল এবং বুঝতে পারছিল, মোদি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছেন।
কিন্তু এখন, মোদি যখন বিজেপিকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌঁছে দিতে পারেননি, অব কি বার চারশো পার যখন অধরাই রয়ে গিয়েছে, তখন এই প্রশ্ন উঠেছে সংঘ কি সত্যিই পারবে মোদিকে এবার নিয়ন্ত্রণে আনতে? ভাগবত কি রাজধর্ম শেখাতে পারবেন মোদিকে? আবার এই প্রশ্নও উঠছে যে, মোদি যদি বিজেপিকে তিনশো পার করাতে পারতেন, তাহলে ভাগবত কি এত কথা বলতেন?
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটি সহজ। মোদি যদি তাঁর দলকে তিনশো পার করাতে পারতেন, তাহলে তিনি প্রমাণ করতে পারতেন, যত সমালোচনাই হোক না কেন তিনিই একমাত্র গ্রহণযোগ্য নেতা। সেক্ষেত্রে সংঘকে মান্যতা দেওয়ার কোনও বাধ্যবাধকতাই তাঁর সামনে থাকত না। বরং ব্যক্তি মোদি সংঘকে ছাপিয়ে আরও বড় হয়ে উঠতেন। সে অবস্থায় সংঘকে সত্যিই ‘সাংস্কৃতিক সংগঠন’ হয়েই থাকতে হত। ভাগবতকেও ঢোঁক গিলে নিজের কথা নিজেকেই হজম করতে হত।
এবার আগের প্রশ্নটি। মোদি-শা’কে সত্যিই লাগাম পরাতে পারবে সংঘ? বাজপেয়ী মোদিকে রাজধর্ম পালনের উপদেশ দিয়েছিলেন। সে উপদেশে মোদি খুব একটা কর্ণপাত করেছেন একথা কেউ বলবেন না। এবার ভোটের পর এটা সত্যি যে মোদি একটু বেকায়দায় রয়েছেন। এই মুহূর্তে সংঘের যাবতীয় সমালোচনা মোদি মুখ বুজে সহ্য করবেন। একটু নমনীয়ভাবও দেখাবেন। কিন্তু সেটা ক’দিন? সংঘ ঘনিষ্ঠরাই বলছেন, মোদি একজন কর্তৃত্বকামী নেতা। সরকারে এবং সংগঠনে নিজের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব স্থাপনে বিশ্বাসী তিনি। এহেন ব্যক্তির পক্ষে সংঘের হাতে নিজেকে সমর্পণ করা অসম্ভব। সে তিনি যতই একদা সংঘের স্বয়ংসেবক হোন না কেন?
তাহলে কী করবেন মোদি? সংঘ ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, প্রথমে সরকারে নিজের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কায়েম করার লক্ষ্যে এগোবেন তিনি এবং এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আবার দল ভাঙানোর খেলা শুরু হবে। এই দল ভাঙানোর খেলায় শরিক, বিরোধী কেউই বাদ পড়বে না। সেটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। আর সেটা যখনই মোদি করে উঠতে পারবেন, তখনই সংঘকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ফের কর্তৃত্বকামী হয়ে উঠবেন।
ভাগবত উলুবনে মুক্তো ছড়ালেন কি না সেটা সময়ই বলে দেবে।