- আশিস ঘোষ
চোখের সামনে থেকে সরে গিয়েছে বত্রিশ বছর আগে। এবার মগজ থেকেও সরিয়ে নেওয়া শুরু হল। এবার কেন্দ্রীয় সরকারি স্কুলপাঠ্যে বাদ পড়তে চলেছে বাবরি মসজিদ। তার বদলে আসছে তিন গম্বুজওয়ালা মসজিদ। বাবরির ধ্বংসস্তূপের যাবতীয় চিহ্ন মুছে যাবে এবার। পড়ুয়ারা জানতেই পারবে না এখনকার রাম মন্দিরের তলায় রয়েছে একটা পাঁচশো বছর পুরানো মসজিদ, দেশ যাকে বাবরি মসজিদ বলে জানত। জানবে না ওই মন্দিরের দাবিতে বিজেপির নেতা আদবানির রথযাত্রার কথা। এবং তাকে ঘিরে দেশজোড়া সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে অন্তত হাজার দুয়েক মানুষের মৃত্যুর কথা।
কেন্দ্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক সংস্থা এনসিইআরটি তিরিশ হাজারের মতো সিবিএসই স্কুলের নিয়ন্ত্রক। এই স্কুলগুলি এনসিইআরটির সিলেবাসে পড়ায়। বেশ কিছুদিন ধরেই তাদের সিলেবাস সংস্কার চর্চায় রয়েছে। ইতিহাসের সিলেবাসে বাবরি বর্জন তাদের সর্বশেষ প্রচেষ্টা। সেইসঙ্গে রীতিমতো চর্চার খোরাক বাবরি বাদ দেওয়ার যুক্তি। সংস্থার ডিরেক্টর জানিয়েছেন, আমরা ছাত্রছাত্রীদের দাঙ্গার কথা পড়াতে যাব কেন? এসব পড়ে তারা হিংস্র হয়ে উঠবে। আমরা কি পড়ুয়াদের ঘৃণার শিক্ষা দেব? শিক্ষার উদ্দেশ্য তো ভালো নাগরিক তৈরি করা। পরে বড় হয়ে তারা ওসব পড়বে। এই যুক্তিতে চারপাতার বাবরি অধ্যায় ছেঁটে দুই পাতা করা হয়েছে। যুক্ত হয়েছে রাম মন্দির নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ।
অর্থাৎ কেন একটা ঐতিহাসিক ধাঁচা ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল, তার পিছনে কারা ছিল, তাদের কার কী সাজা হল সেসব না জানলেও চলবে। সত্য শুধু অযোধ্যায় তিন গম্বুজের মসজিদ। আর কিছু নয়। আর এসবের মধ্যে কোথাও গৈরিকীকরণের ছিটেফোঁটাও দেখতে পাচ্ছেন না এনসিইআরটির কর্তারা। তাঁদের মতে, এসব অপ্রয়োজনীয় বিষয়। বাদ দেওয়াই যায়।
অবশ্য এই প্রথম নয়, এই কেন্দ্রীয় সংস্থা আগেও তাদের মতলব পরিষ্কার করেছে। দশম, একাদশ আর দ্বাদশের ইতিহাসে সুলতানি ও মোগল আমল কেটে কমিয়ে দিয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধ আর নির্জোট আন্দোলন বাদ দেওয়া হয়েছে। একাদশের সিলেবাস থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে গুজরাটের দাঙ্গা। বাদ দেওয়া হয়েছে গান্ধি হত্যার কিছু অধ্যায়। আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করার প্রসঙ্গ।
এর আগে দশমের সিলেবাস থেকে ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্ব বাদ দিয়ে শোরগোল ফেলে দিয়েছিল তারা। বাদ পড়েছিল পিরিয়ডিক টেবিল। এছাড়া, ফৈজ আহমেদ ফৈজের কবিতা থেকে শুরু করে ইকবাল থেকে মহাশ্বেতা দেবী বাদ পড়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বা সিবিএসই বা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস থেকে।
এখানেই শুরু নয়, সিলেবাসের গৈরিকীকরণের চেষ্টার অভিযোগ বেশ পুরোনো। মোরারজি দেশাই যখন প্রধানমন্ত্রী তখন সংঘের নেতা নানাজি দেশমুখ তাঁকে একটা স্মারকলিপি দিয়েছিলেন। সেটি কাদের স্মারকলিপি তা লেখা ছিল না। সেটি বাইরে চলে আসে। তাতে বেশ কয়েকজন বামপন্থী বলে পরিচিত ঐতিহাসিকের বই বাদ দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিল। যুক্তি ছিল, সেই বইগুলোতে কয়েকজন মুসলিম মোগল শাসকের যথেষ্ট সমালোচনা করা হয়নি। তাই বইগুলি দেশবিরোধী। মোরারজি সেই স্মারকলিপি শিক্ষামন্ত্রকে পাঠিয়ে বইগুলি বাতিল করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারপরেও বারবার পাঠ্যসূচি বদলের অভিযোগ উঠেছে, উঠছেও। অভিযোগ, সংঘ পরিবার তাদের চাহিদামতো সিলেবাস পালটে দেওয়ার চেষ্টায় কোনও খামতি রাখবে না। দেশ দখলের সঙ্গে সঙ্গে পড়ুয়াদের মগজ দখল তাদের লক্ষ্য। সেখান থেকে যাবতীয় বামপন্থী ভাবনাচিন্তা দূর করতে হবে।