নির্বাচন কমিশনেকে নিয়ে এতটা সন্দেহ বোধহয় অতীতে আর কখনও হয়নি। স্বাধীন, স্বশাসিত নির্বাচন কমিশনের সব কাজ সবসময় রাজনৈতিক দলগুলিকে খুশি করে না ঠিকই। বরং উলটোটা ঘটে বারবার। প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টিএন শেষণের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসু বা আরজেডি সুপ্রিমো লালুপ্রসাদ যাদবের মতবিরোধ অতীতে খবরের শিরোনামও হয়েছিল।
কখনও সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র নিয়ে, কখনও ভোটার তালিকা তৈরি নিয়ে, আবার কখনও একাধিক দফায় লোকসভা বা বিধানসভা ভোটের নির্ঘণ্ট তৈরি করা নিয়ে। ভোটের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আধাসেনা মোতায়েন নিয়েও বহুবার বিরোধের কেন্দ্রে এসেছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু এত কাণ্ডের পরও কখনও মনে হয়নি যে, নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তে শাসক শিবিরের বিশেষ সুবিধা হচ্ছে কিংবা শাসক যেমন চাইছে, কমিশন ঠিক সেইভাবে এগোচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতদুষ্ট বলে কল্পনা করাটাই এতদিন ছিল কষ্টসাধ্য। দুর্ভাগ্যবশত সেই ধারণাটা ক্রমশ ফিকে হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের একাধিক সিদ্ধান্তে বিরোধী দল এবং সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্নচিহ্ন উঁকি মারছে। এতে কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা টাল খাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টের মতো নির্বাচন কমিশনের প্রতিও মানুষের আস্থা থাকা উচিত স্বাধীন সংস্থা হিসেবে।
নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষভাবে ভোটের আয়োজন করা। প্রত্যেক নাগরিককে নির্দ্বিধায় ও নির্ভয়ে নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগের বন্দোবস্ত করা। কিন্তু কমিশনের বিরুদ্ধে ইদানীং যে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ উঠছে, তাতে তাদের ওপর ন্যস্ত সেই দায়িত্বটাই প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। রাহুল গান্ধি মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোটে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের গুরুতর অভিযোগ তোলার পর কমিশন একাধিক সাফাই দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু তাদের ভাবমূর্তিতে কালির দাগ লেগে গিয়েছে।
বিধানসভা ভোট আসন্ন বিহারে। সেখানে ভোটার তালিকার স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন নিয়ে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল আরজেডির একগুচ্ছ প্রশ্নবাণের মুখোমুখি হয়েছে নির্বাচন কমিশন। পশ্চিমবঙ্গে সামনের বছর বিধানসভা ভোট। এ রাজ্যেও তৃণমূলের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে কমিশন। তৃণমূল এবং আরজেডির প্রবল আপত্তিতে কমিশন খানিকটা পিছু হটলেও মূল প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন, পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি করার লক্ষ্যেই স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন করানো হচ্ছে ভোটার তালিকায়। অভিযোগটি কমিশন মানেনি ঠিকই। তবুও এটা ঘটনা যে, হাজারো যুক্তি সাজিয়ে নিজেদের দায়মুক্ত করতে পারছে না নির্বাচন কমিশন। এর আগে সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্রের বিরোধিতাও হয়েছিল। কিন্তু কমিশন নিজের যুক্তিতে অনড় থাকায় তখন রণে ভঙ্গ দিয়েছিল অভিযোগকারীরা।
অথচ মহারাষ্ট্রে ভোটার তালিকায় গরমিল, ভোটদানের হারে বিপুল অসামঞ্জস্য নিয়ে বিরোধীদের তোলা প্রশ্নে কমিশন অনড় মনোভাব দেখালেও খামতি কিছু কিছু খালি চোখে দেখা যাচ্ছে। বিহারে স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশনের প্রক্রিয়ায় অন্তত দুই বছর লাগবে বলে আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব যুক্তি দিয়েছেন। অথচ বিহারে বিধানসভা ভোটের বাকি আর মাত্র তিন থেকে চার মাস। এই সামান্য সময়ের মধ্যে ওই কর্মযজ্ঞ যে সেরে ফেলা যায় না সেটা কমিশন কেন খেয়াল করল না- প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
আবার ২০২৪ সালে লোকসভা ভোট হলেও ২০০৩ সালকে কেন ভিত্তি হিসেবে ধরা হল- সেই প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। রাহুল গান্ধি নির্বাচন কমিশনার ও মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। নিয়োগ কমিটি থেকে দেশের প্রধান বিচারপতিকে বাদ দেওয়ার কারণ জানতে চেয়েছেন তিনি। নির্বাচন কমিশনকে অতীতে কখনও এই ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি।
এই বিড়ম্বনা দূর করতে নির্বাচন কমিশনকেই উদ্যোগী হওয়া উচিত। যাবতীয় অভিযোগ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে অতীতের মতো উজ্জ্বল, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা এখন নির্বাচন কমিশনারের প্রধান কর্তব্য।