কৌশিক দাম
‘সেই সাপ জ্যান্ত, গোটা দুই আনতো’ সেই কবে থেকে আমরা সেই সাপ পছন্দ করি, যার বিষ নেই, অর্থাৎ ভয় পেতে ভালোবাসি। আমাদের, আরও ভালো করে বলতে গেলে নিয়ন্ত্রিত ভয় পাওয়া আজ সবচেয়ে পছন্দের বিনোদন।
বাংলা গল্পে তন্ত্র, বলি এখন ট্রেন্ডিং। সিনেমা হিট হয় বন্দুক দিয়ে নয়, রামদা-ভোজালি দিয়ে কতগুলো মুণ্ডু কাটা গেল তার ওপর। খবর সেটাই বেঁচে থাকে, যেটায় প্রচুর পাশবিক নির্যাতন থাকবে বা কোনও সাইকো দৃষ্টিকোণ থাকবে। দিনশেষে একটা ভয় খুব ভালো বিক্রি হয়।
স্কুইড গেমের মতো ওয়েব সিরিজ সুপার হিট, যেখানে মানুষ মরবে আর মজা দিয়ে যাবে দর্শককে, আর সবচেয়ে বড় রিয়েলিটি শো তো কয়েকদিন আগেই শেষ হল পৃথিবীতে, যেখানে মানুষ দেখল পাড়ায় পাড়ায় মৃত্যুমিছিল, স্তূপাকার লাশে পেট্রোল দিয়ে পোড়ানো, অথবা নদীর জলে ভেসে বেড়ানো কিছু দুর্ভাগার দেহ, তাই মঞ্চ তৈরিই আছে। এবার এই মঞ্চে যে কোনও হিট সিনেমার মতো সিক্যুয়েল আনার খবর দিতে পারলেই সুপার হিট, ‘আবার আসছে সেই মুখোশ চাপা দিন।’
সোশ্যাল মিডিয়া দেখলেই দেখা যাচ্ছে একটা নাম এইচএমপিভি। হিউম্যান মেটানিউমো ভাইরাস, অনেকেই বলছেন নতুন ভাইরাস। কিন্তু ইন্টারনেট দেখাচ্ছে ২০০১ সালে নেদারল্যান্ডসে একজন চিকিৎসক ভাইরাসকে চিহ্নিত করেন। আরও ভালো করে জানলে জানা যাবে এটির দাদু বা তার ঠাকুরদার বাবা ১০০ বছর ধরে এই পৃথিবীতে আছেন বা ছিলেন। উনি নতুন নন। বিশিষ্ট চিকিৎসকরা বলছেন, বিগত কিছু বছরে কিছু সিরিয়াস রোগীর কয়েকটা টেস্ট করলে তখনও হয়তো এই ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেলেও যেতে পারত।
এই টেস্টগুলোর গড় খরচ নাকি প্রায় পনেরো হাজার টাকা। এবার ভাবা দরকার শীতকালে লালমোহনবাবুর মাঙ্কি টুপি পরেও হাঁচি-কাশিতে ভোগেনি কোন বাঙালি? ওষুধ খেলে সাতদিনে সেরে গিয়েছে। না খেলে এক সপ্তাহ লেগেছে সারতে। কিন্তু নোবেল করোনা এখন কোনও কিছুকেই নর্মালভাবে নিতে দিচ্ছে না, আসলে ভাইরাসের মার্কেট এখন গরম অথচ নিউমোনিয়াতে বেশি মারা যাচ্ছে মানুষ ব্যাকটিরিয়ায়, অনেক বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন জীবাণু আক্রমণে। কিন্তু এদের দিকে কেউ ফিরে তাকাচ্ছে না।
এবার ক্ষুধার্ত শিয়ালের সামনে আপনি যদি একটা নধর মুরগি রাখেন, তাহলে খাওয়ার জন্য খুব দোষ দেওয়া যায়? এরকম চললে ভয় দেখানো যাদের ব্যবসা, তারা তো একটা হরর প্লট লিখবেই। তারা আপনাকে বাধ্য করবে সাধারণ সর্দিকাশিতে ২০ হাজার টাকার টেস্ট, আর অনেক অপ্রয়োজনীয় কিছু।
এবার আমরা তাই বলে সবাই ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেব এটাও হবে না। কারণ অনেক রাজ্য সরকার কিছু বিধিনিষেধ নিতে বলেছে, আর তারা সেটা এমনি এমনি নিশ্চয়ই করেনি।
তাই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে। সতর্ক থাকতে হবে প্যানিক না করে, কারণ এবার আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বাড়ির সবচেয়ে ছোট্ট সদস্যদের। যারা কিছু বুঝতে পারে না। এবার কিছুতেই একলা ঘরকে নিজের দেশ বানাতে দেওয়া যাবে না, নিজেকে বা নিজের প্রিয় মানুষগুলোকে কিছুতেই পণ্য হতে দেওয়া যাবে না।
(লেখক শিক্ষক। জলপাইগুড়ির বাসিন্দা)