মিঠুন ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: রাজ্য সরকার উন্নয়নের কাজে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করছে। কিছু ক্ষেত্রে বরাদ্দ আসছে কেন্দ্র থেকেও। কিন্তু সেই টাকার বেশিরভাগই স্থানীয় ‘দাদা’দের পকেটে ঢুকে যাচ্ছে। অভিযোগ, রাজ্যজুড়ে টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজের বরাত দিতে গিয়ে কাটমানি খাচ্ছেন এলাকায় শাসকদলের (TMC) নেতা-কর্মীরা।
ইতিমধ্যে দুর্নীতির (Corruption) সেই খবর পৌঁছেছে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষমহলেও। সেই কারণেই কি কয়েকদিন আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (CM Mamata Banerjee) তাঁর ভার্চুয়াল প্রশাসনিক সভা থেকে স্থানীয় স্তরে টেন্ডার বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে মন্তব্য করেছেন? এখন সেই প্রশ্নই ঘুরে বেড়াচ্ছে দলের নেতা এবং ঠিকাদারদের মনে।
কিন্তু কীভাবে এই দুর্নীতি হয়? কাজ শুরুর আগে প্রথমে কাজের এস্টিমেট তৈরি করতে হয়। সেইমতো দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার কাজের মান অনুযায়ী খরচ ঠিক করেন। তারপর ঠিকাদারি সংস্থাগুলি অনলাইন টেন্ডারে অংশ নেয়। কিন্তু ‘মিলিয়ে নেওয়ার’ কারণে অনেক জায়গায় অনলাইন টেন্ডার প্রক্রিয়া কোনও কাজেই আসে না।
প্রতিটি অঞ্চলে ঠিকাদাররা নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নেওয়ার ফলে দর নিয়ে আর প্রতিযোগিতা থাকছে না। নিয়ম মোতাবেক তিনটি সংস্থা টেন্ডারে অংশগ্রহণ না করলে টেন্ডার বাতিল হয়ে যায়। সে কারণে নাম কা ওয়াস্তে তিনটি সংস্থা টেন্ডারে অংশ নেয়। সেগুলোর মধ্যে কোন সংস্থা কাজ পাবে সেটাও ঠিক করে দেওয়া হয়। জলপাইগুড়ির এক ঠিকাদার বলেন, ‘এক্ষেত্রে টেন্ডারের দর নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকে না। প্রতিযোগিতা হলে সাধারণত ১০-৩০ শতাংশ ছাড় দিয়ে ঠিকাদারি সংস্থাগুলো কাজ পায়।’ কিন্তু প্রতিযোগিতা না হওয়ার কারণে সরকারি কোষাগার থেকে প্রায় ১০০ শতাংশ বা তার থেকে একটু কম টাকা দিতে হয়। সরকারি কোষাগারের এই বাড়তি খরচই ঘুরপথে কাটমানি হয়ে নেতা ও দাদাদের পকেটে ঢুকছে বলে জানা গিয়েছে। রাজগঞ্জ ব্লকের এক ঠিকাদার বলেন, ‘শুধুমাত্র পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতি নয় পূর্ত দপ্তর, জেলা পরিষদ সহ রাজ্যের বড় বড় সংস্থাগুলিতেও চলছে একই প্রথা।’
গত ২৪ জুন একটি ভার্চুয়াল সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এরপর থেকে আর স্থানীয় স্তরে টেন্ডার হতে দেব না। সমস্ত টেন্ডার কেন্দ্রীয়ভাবে হবে। সমস্ত তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে মজুত থাকবে।’ এই বিষয়ে রাজ্যস্তরের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের নিয়ে একটি কমিটিও তৈরি করে দেওয়া হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন।
জানা গিয়েছে, গোটা রাজ্যের বহু পুরসভা, গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিগুলিতে এভাবে টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারি কোষাগারের কোটি কোটি টাকা ধ্বংস করা হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকার জনপ্রতিনিধিরা অবশ্য ঘটনার দায় অস্বীকার করেছেন। জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার সহ গোটা উত্তরবঙ্গের বহু জনপ্রতিনিধি জানিয়েছেন, সরকারি নিয়ম মেনে টেন্ডার বণ্টন করা হয়। তবে মিলিয়ে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করলেন জলপাইগুড়ি জেলার একটি পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি। তাঁর কথায়, ‘সারা রাজ্যেই টেন্ডারের ক্ষেত্রে মিলিয়ে নেওয়া হয়।’
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চলতি বছরে উত্তরবঙ্গের গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতিগুলো মিলিয়ে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের প্রায় ১৮০ কোটি টাকারও বেশি অর্থের কাজের অনুমোদন হয়েছে। এটা শুধু মাত্র একটি প্রকল্পের হিসেব। পঞ্চায়েত স্তরের অন্যান্য কাজ, সঙ্গে পুরসভা ও অন্যান্য সংস্থানগুলির খতিয়ান তুলে ধরলে সংখ্যাটা কোথায় দাঁড়াবে, সেটা বলাই বাহুল্য।