পিনাকী চট্টোপাধ্যায়
সিডনিতে রবিবার সিরিজ শেষ হওয়ার পর পিলপিল করে মাঠে লোক ঢুকে গেল। এত বছর সিডনিতে আছি, এমনভাবে মাঠের গেট খুলে দিতে দেখিনি কোনওদিন। রবিবার মাঠে গিয়ে আরও একটা দৃশ্য চোখে পড়ল। ভিআইপি বক্সে অজিদের মদ খেয়ে মাতলামো। প্রচুর দর্শক খেলা নিয়ে মাতামাতি করেননি। কে কেমন খেলল, মাথাব্যথা নেই। ছুটির দিনে খাওয়াদাওয়া করতে, আড্ডা দিতে যেন হাজির।
অস্ট্রেলিয়ানদের দেখতে দেখতে ভাবছিলাম। ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের ফারাকটা এখন ঠিক কোথায়? পরিকাঠামোর দিক দিয়ে। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে। অর্থের বিচারে।
মনে পড়ে গেল, প্রায় চব্বিশ-পঁচিশ বছর আগে সিডনিতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের হোটেলের ঘরের এক দৃশ্য। সৌরভের সঙ্গে একই ঘরে রয়েছেন ভারতের বোলার দেবাশিস মোহান্তি। বিধ্বংসী সিরিজ। একদিকে গ্লেন ম্যাকগ্রা, অন্য প্রান্ত থেকে ব্রেট লি। সাঁড়াশি আক্রমণে বিধ্বস্ত ভারতের ব্যাটিং। ভারতের বোলাররা নাজেহাল হয়ে যাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ার সে আমলের বিশ্বত্রাস ব্যাটিংয়ের সামনে। ফেলুদার তোপসের মতো না হলেও প্রশ্নটা ছিল লালমোহন গাঙ্গুলির মানের। কাকে সামলানো কঠিন, ব্রেট লি নাকি ম্যাকগ্রা?
এমনই এক প্রশ্ন যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে সিডনির গ্যালারিতে। বোলান্ড না স্টার্ক–কে বেশি বিধ্বংসী? দেখলাম, বোলান্ডের জনপ্রিয়তা সিডনিতে গগনচুম্বী। বোলান্ড সিডনিতে মাঠের সীমানার ধারে বল কুড়োতে এলেই অভিবাদনের ঝড় উথলে পড়ছে। আর সীমানার ধারে ফিল্ডিং করতে এসে দাঁড়িয়ে থাকলে তো কথাই নেই- গ্যালারিজুড়ে সমস্বরে গান হচ্ছে, স্কট্টি, ইউ আর এ লেজেন্ড। স্কট বল হাতে নিলেই আওয়াজ উঠছে ছন্দ মিলিয়ে- স্কট্টি ইজ ইওর ড্যাডি।
এই স্লোগানটা নতুন। পরশু দিনেও ছিল না। আর এখানেই সৌরভের বহু বছর আগে উত্তরটা এখনও কানে বাজল– ‘ব্রেট লি-কে তবু খেলা যায়, গ্লেন ম্যাকগ্রা শ্বাস নেওয়ার জায়গা দেয় না।’
৮০-র দশকে ভারতের মাঠে এরকম ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন ম্যালকম মার্শাল। সিডনির গ্যালারির স্কটি ইজ ইওর ড্যাডির মতো একটা স্লোগান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল– ‘সানি তেরে পিছে মার্শাল আ রহা হ্যায়’।
ভারতের বিভিন্ন ক্রিকেট মাঠে এই একটা ব্যাপারে ভীষণ মিল। নিজেদের দেশের খেলোয়াড়দের টিকাটিপ্পনী কেটে হেয় করা, উত্ত্যক্ত করা যেন একটা রেওয়াজ। আশির দশকেই দেখেছি নিজের দেশের খেলোয়াড়দের উদ্দেশেই জলের বোতল ছোড়া। মাঠের সীমারেখা বরাবর ফিল্ডিং করতে এলে টিকাটিপ্পনী আর চোখা চোখা গালাগালে বিধ্বস্ত করে নির্লজ্জ হাসি মশকরায় মেতে ওঠা। এদেশে কি হয় না? অবশ্যই হয়। ২০০৮ সালে মাঙ্কিগেট-এর সময়ে এবং তার পরেও অধিনায়ক বিরাট কোহলির নালিশ মেনে নিয়ে একদল অস্ত্রেলিয়ানকে মাঠ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।
ভারতের ক্রিকেট মাঠে এখন কী হয় বলতে পারব না, তবে স্টেডিয়ামে স্টেডিয়ামে বিয়ার, ওয়াইন স্পিরিটের স্টল থেকে ঝরনার মতো বিয়ার গ্লাসে গ্লাসে করে এসে গ্যালারিতে ছড়িয়ে পড়ছে- এই দৃশ্য আমি ভারতে থাকতে দেখিনি।
অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় তিরিশ বছর কেটে গেল। দেশজ সংস্কৃতির সামান্য আন্দাজ এখন হয়েছে। ক্রিকেট মাঠে বিয়ার থাকবে না, মানে ক্রিকেটের মজাই থাকবে না। বিয়ার ছাড়া ক্রিকেট মানে সোনার পাথরবাটি। আসলে বিয়ার এবং ওয়াইন এদেশের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ। তার মানে আবার এমনও নয় এদেশে সবাই সোমবার সকাল থেকে বিয়ার খেয়ে রবিবার রাত পর্যন্ত বেহেড মাতাল হয়ে পড়ে থাকে।
তবে পাড়ায় পাড়ায় একটা করে পাব থাকবেই। আমার পাড়ায় যে পাবটা আছে সেটা ১৯০২ সালে অস্ট্রেলিয়া তৈরি হওয়ার আগে তৈরি হয়েছে। এখনও প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় দেখি গমগম করছে। এদেশের আমজনতা যখন ক্রিকেট মাঠে যায়, তারা আনন্দ করতে যায়। উপভোগ করতে যায়। তার মানে তাঁরা সবাই গ্লেন ম্যাকগ্রা, শ্যেন ওয়ার্ন, রিকি পন্টিং, স্টিভ স্মিথ নন। এঁরা পাড়ার খোকাদা, বুড়োদা, ভাইদা, বাচ্চু, মানিক, মদন আরও অনেকে।
বেয়ারা, চালাও ফোয়ারা- বলার জন্যও তো একটা উপলক্ষ্য লাগে, সেটা ক্রিকেট। আর ক্রিকেটের সঙ্গে যদি বিয়ার থাকে তার সঙ্গে একটু আধটু বেলেল্লাপনা থাকবে না, তাই কখনও হয়! তবুও বলব- ভয় পেও না, ভয় পেও না, এসেছে ক্রিকেট এসেছে। ক্রিকেট এদেশের উৎসব, বিশেষ করে ভারতীয় দল এদেশে এলে। আরও একটা ব্যাপার হল দেশের গ্যালারি টক্কর দেখতে চায়। সেয়ানে-সেয়ানে লড়াই হবে, জমে উঠবে আসর, ক্রিকেটের ফুলশয্যা। মেলবোর্নে নব্বই হাজার টিকিট নিমেষে শেষ। একটু দেরি করলে সিডনিতে ঝড়তি পড়তি যা পড়ে থাকে, তাই জুটবে।
নব্বই দশকে ভারতীয় দলের খেলা দেখেছি অস্ট্রেলিয়াতে। তাতে ভারতের সঙ্গে লড়াই সেয়ানে-সেয়ানে হত না। মাঠ ফাঁকা পড়ে থাকত। তারও আগে আশির দশকের মেলবোর্নে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার খেলা ইউটিউবে দেখেছি- ফাঁকা মাঠে গাভাসকার ব্যাট করছেন। মাঠে লোক ভেঙে পড়ত নব্বইয়ের দশকে অ্যাসেজ সিরিজে। ইংল্যান্ডের দাপট যখন চলে গেল, আবার ফাঁকা গ্যালারি। আরও ভালো উদাহরণ ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কয়েক বছর আগে এসেছিল এদেশে। কবে যে এল, আর কবে যে চলে গেল, টের পায়নি গোটা অস্ট্রেলিয়া। এবার মেলবোর্ন বা সিডনি দেখাল, ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়াই এদেশে এখন ক্রিকেটের সেরা দক্ষযজ্ঞ।
ভারতীয় সমর্থক চান, ভারত অচিরেই কচুকাটা করে ফেলবে প্রতিপক্ষকে। ব্যাটে সেরা, বোলিংয়ে সেরা, ফিল্ডিংয়ে সেরা তবে না খেলা। ইন্ডিয়া টুডে-তে সাক্ষাৎকারে গাভাসকার দ্বিতীয় দিনের শেষে বলেছেন সিডনির এই উইকেট টেস্ট ক্রিকেটের সেরা উইকেট নয়। এমন উইকেট ভারতে হলে অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া এবং প্রাক্তনরা তুলোধোনা করতেন। হতে পারে। তবে বহুদিন পরে আবার ক্রিকেট দেখলাম, যেখান বোলাররা বিস্মৃতপ্রায় প্রজাতি থেকে আবার আলোয়। অনিশ্চয়তার যে দোলাচল, ক্রিকেটের যে চেনা ছন্দ, সিডনি সেটা নিঃসন্দেহে ফিরিয়েছে ক্রিকেটপ্রেমীদের।
সিডনির গ্যালারিতে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার দর্শক একইসঙ্গে পাশাপাশি বসে খেলা দেখছে। প্রথম দিন আমার সামনেই ছিল এক কিশোর। সোনালি চুল, হাতে ব্যাটের রেপ্লিকা। সই শিকারি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সই পেলে?
না।
কার সই নেবে?
স্কট বোলান্ড, স্টার্ক, কোহলি। একটু অবাকই হলাম। আমার বিস্ময়ের উত্তর এল তার পাশে বসা মায়ের কাছ থেকে।
আমরা আসলে ইংলিশ। আমরা অস্ট্রেলিয়াতে বেড়াতে এসেছি। আমরা সাপোর্ট করছি ইন্ডিয়াকে। বলে একগাল হাসি। একাধিক শ্বেতাঙ্গকে নজরে পড়েছে, যাঁরা ভারতের জার্সি গায়ে দিয়ে ঘুরছেন স্টেডিয়ামে। কেউ ভারতের পতাকা হাতে নিয়ে ওড়াচ্ছিল- এটা বললে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। আমার পুত্র ভারতের জার্সি গায়ে প্রায় পরপর দু’দিন ম্লানমুখে বসেছিল। আমার কন্যা অস্ট্রেলিয়ার জার্সি গায়ে প্রথম দিনে অনেক হইচই করে পরের দিনে আর মাঠেই গেল না। আমাদের সন্তানদের প্রজন্মের অনেকেই অস্ট্রেলিয়ার হয়ে গলা ফাটাচ্ছে, আবার তাদেরই বন্ধুরা ভারতের হয়েও চিৎকার করছে।
বেঙ্গালুরু থেকে সিডনিতে ক্রিকেট দেখতে এসেছেন শুভাশিস চক্রবর্তী। ভারতের প্রথম সারির একটি কুরিয়ার কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এবং কর্ণধার শুভাশিস সত্তরে পা দিয়েছেন। ক্রিকেট পাগল মানুষ। পৃথিবীর সমস্ত দেশে ঘুরেছেন ক্রিকেটের টানে। খেলা দেখাই ওঁর একমাত্র নেশা। ১৯৮০ সালে মস্কো অলিম্পিকে শুরু, তারপর থেকে যত অলিম্পিক হয়েছে, এখনও পর্যন্ত প্রত্যেকটা গিয়ে দেখেছেন। ক্রিকেটেও তাই। কোনও বিশ্বকাপ বাদ যায় না। প্রথম দিনে আলাপ হল কলকাতার ভবানীপুরের তুহিনের সঙ্গে। তুহিন জানালেন ক্রিকেটের দর্শক হিসাবে এসেছেন অস্ট্রেলিয়াতে। বয়স তিরিশের কোঠায়।
মিলেমিশে ক্রিকেট দেখার মজা অস্ট্রেলিয়ায় ভালো মেলে। অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তারক্ষী, পুলিশ তো রয়েছেই। এবার চোখে পড়ল এসএমএস নম্বর। কোনও রকমের বাঁদরামির কড়া দাওয়াই এসএমএস করলেই হাজির। তাই উইকেট পড়লে উল্লাস আর বিরল বাউন্ডারির আনন্দ দু’পক্ষই ভাগ করে নিল নির্দ্বিধায়।
অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট পরিবেশের তুলনা নেই। আশা করি, এবার ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়বে রোহিতদের হারিয়ে তারা বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠায়। অস্ট্রেলিয়ায় জনপ্রিয়তায় কিন্তু ক্রিকেট এখনও অনেক পিছিয়ে অন্য খেলার তুলনায়।
(লেখক সিডনির বাসিন্দা)