- পূর্বা সেনগুপ্ত
শ্রীখণ্ডের নরহরি সরকারকে নিয়ে লেখালেখি হয়েছিল পূর্ববর্তী পর্বে। গৃহে তিনটি শ্রীমন্দির, তিন দেবতা। প্রথমে ছিলেন একা গোপীনাথ। তারপর বংশলতিকা বৃদ্ধি পেতে থাকলে তা তিনভাগে বিভক্ত হয়েছে। উত্তরদিকে নরহরি সরকারের অন্দরমহল। এটি উত্তরের বাড়ি। এখানে রাধা- মদনগোপাল বিগ্রহ সেবিত হয়ে আসছেন। এটি রঘুনন্দনের বংশধরেরা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ইনি চিনিপ্রিয়। চুরি করে চিনি খেয়ে ভক্তকে অপ্রস্তুতে ফেলেন বলে প্রচলিত। এরপরে রয়েছে বাড়ির মধ্য অংশ বা মাঝের বাড়ি। এই মাঝের বাড়ির শ্রীমন্দিরে রাধা- মদনমোহন রূপে প্রতিষ্ঠিত। এখানেই বিখ্যাত নরহরি সরকারের ভজনকুটির আছে। কুটিরের সামনে লেখা ‘আরতি করে নরহরি–গোরাচাঁদের বদন হেরি।’ শোনা যায়, নরহরি নাকি এই ভজনকুটিরের বাইরের দেওয়ালে মিলিয়ে যান। তাঁর মৃতদেহ কখনও পাওয়া যায়নি। যেমন শ্রীচৈতন্যকৃষ্ণের দেহ জগন্নাথের দেহলগ্ন হয়ে যান, ঠিক নরহরি সরকারের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। মাঝের বাড়ির দক্ষিণ দিকে দক্ষিণবাড়ি। এখানেই প্রতিষ্ঠিত আছেন গৌড়–গোপীনাথ আর সঙ্গে রয়েছেন নাটুয়া গৌড় এবং বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী।
সমস্ত ভারতে হাতে গোনা কয়েকটি মন্দিরেই বিষ্ণুপ্রিয়া নিমাইচাঁদের সঙ্গে পূজিত হন। এই মন্দির তার মধ্যে একটি। উত্তরবাড়িতে গৌড় গোপীনাথ দশদিন বাস করেন, মাঝের বাড়িতে পাঁচদিন, আর দক্ষিণ বাড়িতে পনোরোদিন পুজো গ্রহণ করেন দেবতা। এইভাবে বংশধরদের গৃহে ভ্রাম্যমাণ তাঁরা।
শ্রীপাট শ্রীখণ্ড সম্বন্ধে বলতে হলে নরহরি সরকারের শ্রীচৈতন্যের প্রতি ভক্তির কথা বলতেই হবে। কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থে বলা হয়েছে,
‘দক্ষিণেতে নরহরি বামে গদাধর
শ্রীবাস অঙ্গনে নাচে গৌরাঙ্গ সুন্দর।
নরহরি ভুজে আর ভুজ আরোপিয়া
শ্রীবাসের ঘরে নাচে রাম–বিনোদিয়া
গৌর দেহে শ্যাম-তনু দেখে ভক্তগণ।
গদাধর রাধারূপ হইলা তখন
মধুমতী নরহরি হৈলা সেইকালে
দেখিয়া বৈষ্ণব সব হরি হরি বলে। ( ২/১৫)
নরহরি সরকারের স্বরূপ উন্মোচন করতে স্বয়ং নিত্যানন্দ প্রভু শ্রীখণ্ডে উপস্থিত হয়েছিলেন। এই সময় তিনি জল চাইলে সামনের পুষ্করিণী থেকে জল তুলে এনে দিলেন নরহরি। সেই জল তখন মধুতে পরিণত হয়েছে। নিত্যানন্দ সেই পুষ্করিণীর নাম দিলেন ‘মধু–পুষ্করিণী’। সেই পুষ্করিণী আজও আছে । তাঁর ঘাটের পাশে লেখা আছে,
‘কহে নিত্যানন্দ রাম শুনি মধুমতী নাম
আসিয়াছি তৃষিত হইয়া।
এত শুনি নরহরি নিকটেতে জল হেরি
সেই জল ভোজনে ভরিয়া।…
যত জল ভরি আনে মধু হয় ততক্ষণে
পুন পুন খাইতে আবদ্ধ।’ (লেখাটি অস্পষ্ট)
এই মধু-পুষ্করিণীর পাশেই একটি কদম ফুলের গাছ আছে। যে গাছে বারোমাস ফুল ধরে। এই গৌড় লীলায় পরিপূর্ণ রয়েছে শ্রীপাট শ্রীখণ্ড। এখানে বড়ডাঙা নামে একটি অঞ্চল আছে, যেখানে অভিরাম গোস্বামীর সঙ্গে রঘুনন্দনের দেখা হয়েছিল। নিত্যানন্দ যেমন নরহরির স্বরূপ উন্মোচনের জন্য শ্রীখণ্ডে এসেছিলেন, ঠিক তেমনই রঘুনন্দনের স্বরূপ উন্মোচনের জন্য অভিরাম গোস্বামী শ্রীখণ্ডে উপস্থিত হয়েছিলেন।
অভিরাম এত তেজস্বী ছিলেন যে তিনি যাঁকে প্রণাম করতেন, তিনি হয় বিকলাঙ্গ হতেন বা কখনও মারা যেতেন। ব্রজলীলায় নাকি তিনি কৃষ্ণ সখা শ্রীদাম ছিলেন। তাঁর নাকি জন্ম হয়নি, তিনি বৃন্দাবন থেকে সরাসরি গৌড়লীলায় আসেন। তিনি বিগ্রহকে প্রণাম করলে সেই সময়ের অনেক নকল বিগ্রহ ধ্বংস হয়ে যায়। বিষ্ণুপুরের মদনমোহনের মধ্যে সত্যবস্তুর দেখা পান অভিরাম। বিষ্ণুপুর তাই গুপ্ত বৃন্দাবন। অভিরাম যখন শ্রীখণ্ডে এসে রঘুনন্দনের সঙ্গে দেখা করতে চান, তখন রঘুনন্দনের পিতা মুকুন্দদাস তাঁর সঙ্গে রঘুনন্দনের দেখা করতে দেননি।
অভিরাম ঠাকুরকে বলেছিলেন, ‘রঘু বাড়িতে নেই।’ একথা শুনে অভিরামের চোখে জল। রঘু তখন লুকিয়ে এই বড়ডাঙায় এসে অভিরাম ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করেন। এই বড়ডাঙা অঞ্চলটিতে আছে নরহরি বিলাস কুঞ্জ। রাসপূর্ণিমার পরের একাদশীতে গৌড়-গোপীনাথ এখানে আসেন এবং চারদিন থাকেন। তখন এখানে বিরাট মেলা হয়।
লোচন দাস চৈতন্যমঙ্গল কাব্য রচনা করেন এই বড়ডাঙায় হাজার বছরের পুরাতন বটবৃক্ষের নীচে। সেখানে লোচনদাসের কুঠিয়া আজও রয়েছে। যে বটবৃক্ষের তলায় লোচনদাস গ্রন্থ রচনা করেন সেই বৃক্ষের তলা ও বড়ডাঙাকে গুপ্ত বৃন্দাবন বলা হয়।
বাংলায় কিছু কিছু স্থান আছে, যেখানে গৌড় লীলা ও বৃন্দাবন লীলা একাকার। যেগুলির আধ্যাত্মিক তাৎপর্য অসীম। শ্রীখণ্ড এরমধ্যে একটি। আগেই তুলেছিলাম আমার নিজের গৃহদেবতার উৎস দিয়ে। আমরা শ্রীখণ্ডবাসী ছিলাম, তার প্রমাণ দেয় এই অঞ্চলে বৈদ্যদের প্রাধান্যের ক্ষেত্র। কিন্তু যিনি শ্রীখণ্ড ত্যাগ করে অধুনা বাংলেদেশের ফরিদপুরে উপস্থিত হয়েছিলেন, সেই কালিকাপ্রসাদ সেনগুপ্তের চার ছেলের মধ্যে কনিষ্ঠ ছিলেন ভগবান সেনগুপ্ত। তিনি বিবাহ করেননি, বড় সাধক ছিলেন। তাঁর জীবনেই আমরা তন্ত্রসাধনার ধারাটিকে মূর্ত হতে দেখি।
সেই থেকে আমরা শাক্ত, কিন্তু তবু আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা কৃষ্ণভক্ত। প্রথমেই আমি আমার এক কাকা পবিত্র সেনগুপ্তের কথা উল্লেখ করেছি। তাঁর বাবা সতীশচন্দ্র সেনগুপ্ত ছিলেন তন্ত্রসাধক। কামাখ্যায় গিয়ে সাধন করেছিলেন বহুদিন। তাঁর রচিত The Mother মূলত শাক্তসাধন বিষয়ে এক বিখ্যাত গ্রন্থ। আমার সেই ঠাকুমাও ছিলেন স্বামীর যোগ্য সহধর্মিণী। স্বামীর শিষ্যগণ ও নিজের সংসারকে নিয়ে এক বিরল ভক্ত ভগবানের সংসার গড়ে তুলেছিলেন। জীবনযাপন করেছেন পরম কৃচ্ছ্রর সঙ্গে।
আমি শুনেছি, তিনি একদিন দুপুরে স্বপ্ন দেখছেন, শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর গৃহের উপর দিয়ে আকাশমার্গী হয়েছেন অর্থাৎ উড়ে যাচ্ছেন। তিনি প্রণাম করতেই মহাপ্রভু মৃদু হেসে তাঁর গায়ে নিষ্ঠীবন বা থুতু ত্যাগ করলেন। সেই থুতুর স্পর্শে ঠাকুমার ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড় করে উঠে বসলেন। ঠাকুরদা জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল? – ঠাকুমা স্বপ্নের কথা জানাতেই ঠাকুরদা হেসে বললেন, ‘ওটা থুতু নয়, তিনি তোমাকে কৃপা করলেন।’
বৌদ্ধ তন্ত্র ও শাক্ত তন্ত্র মিশে যাওয়ার কাল হল বারো থেকে তেরো শতাব্দী। ঠিক এমন ভাবেই বৈষ্ণব তন্ত্র ও শাক্ত তন্ত্র মিশে যাওয়ারও একটি কাল ছিল। আর সেই সময়ই সৃষ্টি হয়েছিল বারোশো নেড়া–তেরোশো নেড়ির দল। এঁদের সঙ্গে শ্রীচৈতন্য পার্ষদ নিত্যানন্দ প্রভুর পুত্র বীরভদ্রের সংযোগের কাহিনী আছে। সেই সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছিল বৈষ্ণব কুঠিয়া, তান্ত্রিক আখড়া। ধর্মভাবনার সংযোগের ফলে বৈষ্ণব স্রোত থেকে শাক্ত স্রোত ধারায় প্রবাহিত হয়েছে বহু পরিবারের ধর্মভাবনা। কখনও বা বিপরীতে প্রবাহিত! কখনও দুটি ধারাকেই অঙ্গে ধারণ করে পারিবারিক ধর্মভাবনা সমৃদ্ধ। এরই ফলে সৃষ্টি হয়েছে একই মন্দির প্রাঙ্গণে কালী মন্দির, রাধা-কৃষ্ণ বিগ্রহ সেবা ও দ্বাদশ শিব মন্দির। সমাজ মন তৈরি করে, মন সৃষ্টি করে দেবালয়। সামাজিক প্রবাহ থেকে গৃহদেবতাকে তাই পৃথক করা সম্ভব হয় না।