- পূর্বা সেনগুপ্ত
এক একটি পরিবার স্থানীয় অঞ্চলে একটি প্রতিষ্ঠানের মতো বিরাজ করে। বহু বছর আগে মুগবেড়িয়া অতিক্রম করার সময় পাশের সঙ্গী বলেছিলেন, এই মুগবেড়িয়া অঞ্চল গড়ে উঠেছে নন্দ পরিবারের মাধ্যমে। সমস্ত অঞ্চলটিই ওঁদের জমিদারি! শুনে আশ্চর্য হয়েছিলাম খুব। কিন্তু পরবর্তীকালে এই পরিবারের সম্বন্ধে জেনেছিলাম ধীরে ধীরে। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ভাবনায় এই পরিবারের অবদান এত বেশি যে তাঁদের গৃহের দেবতা ও দেবী সকলের দেবদেবী হয়ে ওঠেন। আজ আমরা পূর্ব মেদিনীপুরের মুগবেড়িয়ার নন্দ পরিবারের ইতিহাস ও তাঁদের অর্চিত দেবীর কাহিনী আলোচনা করব।
পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর অঞ্চলকে ওডিশার সীমান্ত অঞ্চল বলা যায়। প্রমোদ স্থান দিঘা থেকে কিছুটা দূরে গেলেই চন্দনেশ্বর শিবের মন্দির কিন্তু ওডিশা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। তাই এই অঞ্চলের মানুষের ভাষার মধ্যেও আছে ওডিশাবাসীর নিজস্ব ভাষা উড়িয়ার টান। আর তার সঙ্গে ওডিশার প্রভু জগন্নাথের প্রতি অসাধারণ ভক্তি!
এখন থেকে প্রায় তিনশো বছর আগের কথা। তখন সমুদ্রের পার্শ্ববর্তী এই অঞ্চল ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। সেই সময় ওডিশার সাক্ষীগোপাল থেকে অপর্ত্তি নন্দ নামে এক ব্রাহ্মণ মুগবেড়িয়া অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেন। জগন্নাথধাম পুরী থেকে ভুবনেশ্বরগামী রাস্তায় সাক্ষীগোপাল অঞ্চল। এই সাক্ষীগোপাল কেবল গোপালের কাহিনীতে আবদ্ধ নয়, শিল্পের দিক দিয়েও উন্নত এক অঞ্চল। সেই অঞ্চলের বীররামচন্দ্রপুর নামে একটি গ্রাম থেকে বঙ্গভূমিতে উপস্থিত হয়েছিলেন অপর্ত্তি নন্দ। তিনি কেন এসেছিলেন তাঁর কারণ অজানা। কিন্তু তাঁর আগমনের পরবর্তীকালের ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য!
অপর্ত্তি নন্দ বঙ্গে বসতি স্থাপন করলে ওডিশা থেকে গোবিন্দজির এক মূর্তি নিয়ে কয়েকজন ব্রাহ্মণ মিলে এই অঞ্চলে এসে পৌঁছান। তাঁরা সেই বিগ্রহ নিয়ে বেশ কিছুদিন সেই ঠাকুরের সেবা ও পুজো করে কিছু আয় করতেন। তারপর আবার ওডিশায় ফিরে যেতেন। তাঁরা এসে একেক দিন এক এক পরিবারের অতিথি হতেন। এই সময় যে অপর্ত্তি নন্দের গৃহের অতিথি হয়েছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নীলাচল শ্রীক্ষেত্রধাম বৈষ্ণবদের এক উল্লেখযোগ্য তীর্থক্ষেত্র। সেখান থেকে গোবিন্দজির বিগ্রহ নিয়ে এখানে কেন আসতেন, আবার তা বেশ কয়েকজন মিলে আসা, আবার চলে যাওয়া! এই আগমনের কোনও গূঢ় ইতিহাস ছিল কি না জানা না গেলেও এটি একটি চিত্তাকর্ষক ঘটনা।
ইতিহাস বলে একদিন এই গোবিন্দজির বিগ্রহ মুগবেড়িয়ার বাড়িতে উপস্থিত হলে সমস্ত দিন ধরে তাঁর সেবাপুজো চলল। রাতে যে ব্রাহ্মণরা বিগ্রহকে বহন করে এনেছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন স্বপ্নাদিষ্ট হলেন, ‘আর এখানে-ওখানে বিগ্রহ নিয়ে ঘোরাফেরা নয়, অপর্ত্তি নন্দের গৃহেই গোবিন্দজি চিরস্থায়ী রূপে থাকতে আগ্রহী।’ পরদিন সকালে ব্রাহ্মণরা অপর্ত্তি নন্দকে স্বপ্নের কথা জানিয়ে তাঁর অধীনেই গোবিন্দজিকে রাখার সিদ্ধান্ত জানালেন, স্বপ্নের কথা জানাতে ভুল হল না তাঁদের। একান্ত গোবিন্দভক্ত অপর্ত্তি নন্দ পারিবারিক শিকরচ্যুত হয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন বঙ্গভূমে। নীলাচলবাসী প্রভু আবার তাঁকে বাঁধলেন গৃহদেবতার বাঁধনে। এই নন্দ পরিবারের প্রথম গৃহদেবী হলেন গোবিন্দজি।
কিন্তু পরিবারে ইতিহাস গড়ার সূত্র সেখানেই শেষ হয়ে গেল না। বংশের ধারা বয়ে চলল ভক্তের ধারাকে অনুসরণ করে। এতক্ষণ আমরা দেখলাম এই পরিবার পুরোপুরি বৈষ্ণব এবং এমন স্থান থেকে গৃহদেবতা এসেছেন যা বৈষ্ণবদের শ্রেষ্ঠ তীর্থক্ষেত্র। কিন্তু কয়েক প্রজন্ম পর দেখতে পাচ্ছি , বৈষ্ণব ছিলেন এই পরিবার ঠিকই কিন্তু তাঁদের মধ্যে কোনও ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না। অপর্ত্তি নন্দের তিন পুত্র, বনমালি, দামোদর ও ভিখারিচরণ। এই ভিখারিচরণের সন্তান হরেকৃষ্ণ, হরেকৃষ্ণের সন্তান খগেশ্বর। খগেশ্বর নন্দ ছিলেন নিঃসন্তান। দীর্ঘদিন কোনও সন্তানের মুখ না দেখতে পেয়ে খগেশ্বর নন্দ চললেন দেওঘর, বৈদ্যনাথধামে। গৃহে গোবিন্দজি থাকতেও তিনি কেন বৈদ্যনাথধামে গেলেন? এ এক আশ্চর্য ধর্মভাবনার গতি। নিশ্চয় কোনও কারণে তিনি শৈবধারায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। তাই সন্তান কামনায় তিনি উপস্থিত হলেন দেওঘরে। সেখানে গভীর মনোযোগের সঙ্গে শিবের উপাসনা শুরু করলেন। তাঁর সাধনায় তুষ্ট হয়ে স্বয়ং বাবা বৈদ্যনাথ জানালেন, ‘গৃহে পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করবে, কিন্তু শর্ত আছে। শর্ত হল সেই সন্তানের নাম রাখতে হবে ‘ভোলানাথ’। খগেশ্বর নতমস্তকে রাজি হলেন।
ভোলানাথের জন্ম হল। এক অদ্ভুত বলশালী, অকুতোভয় মানুষ। আমরা আগেই বলেছি যে অঞ্চলে কাশ্যপ গোত্রীয়, সামদেবীয় ব্রাহ্মণ অপর্ত্তি নন্দ বসতি তৈরি করেছিলেন সেই স্থান তখনও ঘন জঙ্গলে আবৃত ছিল। ছিল হিংস্র জীবজন্তুর বসবাস। ভোলানাথ নন্দ ঠিক করলেন, সেই ঘন জঙ্গল কেটে মানুষের বসতি স্থাপন করবেন। তিনি জঙ্গলকে ধীরে কাটতে শুরু করলেন। এই সময় বাঁশের বেড়া দেওয়া মাটির একটি ঘর তৈরি করেছিলেন যে ঘরের মধ্য থেকে তিনি বন্যজন্তুদের গতিবিধি লক্ষ করতেন। তাঁর সঙ্গে থাকত দীর্ঘ, উজ্জ্বল ধারালো এক তরোয়াল। এক রাতে সেই মাটির ঘরটি থেকে জন্তুদের গতিবিধি লক্ষ করছেন, এমন সময় হঠাৎ সেই বেড়া ভেদ করে এক বন্য বরাহ তাঁকে আক্রমণ করল। সেই আক্রমণ এতই আকস্মিক ছিল যে ভোলানাথ নন্দ হতচকিত হয়ে গেলেন। তিনি অস্ত্রচালনা করার আগেই বরাহ তাঁকে জখম করে চলে যায়। ভোলানাথ চৈতন্যহীন হয়ে পড়ে থাকেন।
সেখানে কতক্ষণ তিনি পড়েছিলেন তা জানা নেই, কিন্তু যখন জ্ঞান ফিরল তখন তিনি দেখলেন চারিদিক আলোয় আলোকিত। সেই আলোর জ্যোতি থেকে তিনি মাতৃআদেশ লাভ করলেন। তিনি সুস্থ হয়ে ওঠার পর, বনের মধ্যে দেখা আলোকিত স্থানে নিজের বসতবাড়ি তৈরি করলেন আর তার সঙ্গে সেই গৃহে শুরু হল বাসন্তীপুজো। এই বাসন্তীপুজো বা দেবী দুর্গার আরাধনা করার কথা কি সেই আলোকিত জ্যোতিরই আদেশে হয়েছিল? না তা স্পষ্ট নয়। তবু বলা যায় নিশ্চয়ই কিছু কারণ ছিল এর পিছনে। কাহিনীর গতিকে অনুসরণ করলে আমরা একটা বিষয়ে বলতে পারি, প্রথমে এই পরিবারের গৃহদেবতা হলেন ওডিশা থেকে আগত গোবিন্দজিউ। পরবর্তী তিন প্রজন্মের পরই আমরা দেখছি শাক্ত ধারা পরিবারের মধ্যে প্রবেশ করেছে। প্রথমে বৈদ্যনাথধামে যাওয়া এবং পরে বাসন্তীপুজোর জন্য নাটমন্দির ও বাসন্তীপুজোর আয়োজন করা। শুধু তাই-ই নয়, গৃহদেবতার আরাধনা পৃথকীকরণের মধ্য দিয়ে যেন বসতবাটীও পৃথক হয়ে উঠল। আমরা এই ধারাটিকে নিয়ে আমাদের আলোচনায় অগ্রসর হব।
ভোলানাথ নন্দ দেবী বাসন্তীর জন্য যে নাটমন্দিরটি তৈরি করলেন সেই নাটমন্দির একটি ইতিহাস গড়ে তুলেছিল। এখানে ভোলানাথ ১২২৭ সালে ভোলানাথ চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন। যে চতুষ্পাঠী পরবর্তীকালে ভোলানাথ সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। ভোলানাথ নন্দের তিন পুত্র- গোবিন্দপ্রসাদ, দিগম্বর, তৃতীয় হলেন গঙ্গাধর। এখানে আমরা দিগম্বর নন্দের প্রসঙ্গ আলোচনা করব, কারণ দিগম্বরনন্দ ছিলেন একাধারে মেধাবী, তিনি পণ্ডিত দিগম্বর বিদ্যানিধি নামে সম্মানিত হয়েছিলেন। বিখ্যাত পণ্ডিত পঞ্চানন তর্করত্ন তাঁর বন্ধু ছিলেন। কেবল পাণ্ডিত্য নয়, দিগম্বর নন্দ ছিলেন স্বদেশি চেতনায় উদ্ধুব্ধ হওয়া এক বিপ্লবী সত্তা। তিনি ছিলেন অনুশীলন সমিতির সদস্য। এছাড়া যুগান্তর গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সক্রিয় যোগাযোগ ছিল। এই দুই বিপ্লবী প্রতিষ্ঠানের জন্য তিনি প্রভূত অর্থও ব্যয় করতেন। এ প্রসঙ্গে নন্দ পরিবারের সূত্রে জানা যায়, দিগম্বর নন্দ বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুকে মেদিনীপুরে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। গৃহদেবী বাসন্তীর নাটমন্দিরে ক্ষুদিরাম গোপনে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। সেই নাটমন্দিরেই তিনি এলাকার ছেলেদের লাঠি খেলা, ছোরা খেলা ইত্যাদি শেখাতেন। মুগবেড়িয়াকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি বিপ্লবী আখড়াও গড়ে উঠেছিল। যখন কিংসফোর্ড হত্যা নিয়ে অভিযুক্ত ক্ষুদিরাম বসুকে এই মুগবেড়িয়া থেকেই নাকি ব্রিটিশ গ্রেপ্তার করেছিল। কেবল ক্ষুদিরাম বসু গ্রেপ্তার হলেন না, তার সঙ্গে ব্রিটিশের রাগ গিয়ে পড়ল দিগম্বর নন্দের উপরও। দিগম্বর নন্দ পালিয়ে কাশীবাসী হলেন। ছদ্ম নাম নিলেন কালীকিঙ্কর ভট্টাচার্য। পিছনে পড়ে রইল দেবীর নাট মন্দির। স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম ফাঁসি যাওয়া তরুণ তুর্কি যে মন্দিরের আঙিনায়, যে দেবীর পদতলে নির্ভয় ও অনুপ্রাণিত হয়েছেন সেই দেবীস্থান। সুদূর কাশীতে বসে দিগম্বর নন্দ সেই দেবীকে স্মরণ করে লিখেছিলেন ‘কালীকুসুমাঞ্জলী’। এর মধ্য দিয়ে একশো আঠারোটি শ্লোকে দেবী বন্দনাই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর।
ভোলানাথ নন্দের কনিষ্ঠ পুত্র গঙ্গাধর নন্দের দুই পুত্র শৈলজাচরণ আর বিরজাচরণ। আমরা আমাদের কাহিনীর অভিমুখটি এবার বিরজাচরণের দিকে রাখব। বিরজাচরণের জন্ম ১২৯২ সালে। শোনা যায় ঠাকুমা, অর্থাৎ গঙ্গাধর নন্দের স্ত্রী সুধাময়ী দেবী তীর্থ করতে পুরী গিয়েছিলেন। জগন্নাথ দর্শন করে ফিরবার সময় যাজপুরে মা বিরজাদেবীর মন্দিরে দেবীদর্শন করে কৃতার্থ হন। গৃহে ফিরে এসে নাতির নাম রাখেন বিরজাচরণ! বিরজাদেবীর কৃপাতে হোক বা অন্য যে কোনও কারণেই হোক, বিরজাচরণ ছিলেন অত্যন্ত কালীভক্ত। অত্যন্ত মেধাবী বিরজাচরণ পরবর্তীকালে সুচিকিত্সক রূপে খ্যাতিলাভ করেন। তিনি যখন ছাত্রাবস্থায় হিন্দু হস্টেলে ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের সঙ্গে থাকতেন বলে পরিবার সূত্রে জানা যায়। কালীভক্ত বিরজাচরণ পিতা গঙ্গাধর নন্দের কাছে কালীমূর্তি বা শ্যামামায়ের মূর্তি ও মন্দির প্রতিষ্ঠার অনুমতি চাইলেন। গঙ্গাধর অনুমতি দিলেন। গঙ্গাধর কিন্তু তার সঙ্গে এও জানালেন তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন, তাই যা করার এক বছরের মধ্যে করতে হবে।
পিতার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি মন্দিরের কাজ শুরু হল। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, মন্দির নির্মাণের প্রায় আট বছর আগে কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে এক শিল্পীর কাছে তিনি কষ্টিপাথর নির্মিত এক দেবী মূর্তি নির্মাণের বায়না দিয়ে এসেছিলেন, মন্দির নির্মাণ হলে কাশী থেকে নৌকাযোগে সেই মূর্তি মুগবেড়িয়াতে এসে পৌঁছায়। ভাটপাড়ার পণ্ডিতদের দিয়ে হোমযজ্ঞ করিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা হল। কিন্তু এবারও ঘটল একটি অদ্ভুত অলৌকিক কাণ্ড। বিরজাচরণ নন্দের ইচ্ছা ছিল দেবীর সম্মুখে বলি দেওয়ার। কিন্তু একদিন রাত্রে তিনি স্বপ্ন দেখলেন দেবী তাঁকে বলছেন, ‘আমি কাশী থেকে তোমার কাছে এসেছি , তোমার কাছেই থাকব। কিন্তু কথা দাও এখানে বলি দেবে, না এখানে চিরকাল আমার নিরামিষ ভোগ হবে।’ সেই থেকে বিরজাচরণ মায়ের সম্মুখে বলি দেওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করলেন এবং চিরকাল নিরামিষ ভোগের ব্যবস্থাই করা হল। বিরজাচরণের ভক্তি একটি দেখবার বিষয় ছিল, তিনি যখন দেবী মন্দিরে ‘মা তারা ব্রহ্মময়ী’ বলে চিত্কার করতে করতে ঢুকতেন তখন চারিদিক গমগম করে উঠত। তাঁর শ্রীশ্রী চণ্ডীপাঠ শুনে মনে হত, এ যেন মাতা–পুত্রের একান্ত আলাপচারিতা। এই শ্যামা বিগ্রহ সমস্ত নন্দ পরিবারের ধর্মীয় অনুভূতির মোড়টিকে ঘুরিয়ে দিল। পূর্বপুরুষের গোবিন্দজিউ, বাসন্তী দেবী ও তাঁর নাট মন্দির সব কিছুর মধ্যে দেবী যেন বেশি উজ্জ্বল অস্তিত্ব হয়ে উঠলেন। সমস্ত পরিবারের আকর্ষণ সেই দেবীর দিকেই ছুটে গেল।
এই হল ধর্মীয় ভাবনার বিচিত্র গতি। এক বৈষ্ণব পরিবারের শাক্ত পরিবার হয়ে ওঠার ইতিবৃত্তান্ত। কিন্তু এ শেষ হয়েও হইল না শেষ। এত বিচিত্র গতিতে এসে পরিবারে ধর্মীয় অনুভূতির চলন এই শ্যামামায়ের মন্দিরে তার ছাপ রেখে গিয়েছে। বিরজাচরণই প্রতি একাদশী তিথিতে মায়ের মন্দিরে হরিনাম সংকীর্তনের ব্যবস্থা করেছিলেন। একাদশী তিথি বৈষ্ণবদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। সেই পবিত্র অঙ্গটিকে সংযোজন করেছেন দেবী মন্দিরে। এছাড়াও, জন্মাষ্টমী, দক্ষিণায়ন সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি, চৈত্র সংক্রান্তি, দুর্গাপুজোর মহাঅষ্টমী ও মহানবমী, ফলীরণী কালীপুজো, রটন্তীকালীপুজো ইত্যাদি বিশেষভাবে পালিত হয়।
বাসন্তী দেবীর নাট মন্দিরের মতো এই শ্যামামায়ের নাট মন্দিরও কিন্তু কম উল্লেখযোগ্য নয়, এই মন্দিরে মুকুন্দদাস শ্যামাসংগীত শুনিয়েছেন দেবীকে। নন্দ পরিবারের মধ্যে সংগীতচর্চার ধারা ছিল তাই বাড়ির সদস্যগণ নানা অনুষ্ঠানে গীত ও বাদ্যে ভরিয়ে দিতেন মায়ের পাদপদ্ম। এই বিরজাচরণ নন্দের পুত্রই ছিলেন প্রখ্যাত পণ্ডিত শ্রীযুক্ত জ্যোতির্ময় নন্দ। একদিকে পাণ্ডিত্য, অন্যদিকে জনসেবা আর তার সঙ্গে গৃহদেবীর প্রতি ভক্তি– এই ত্রিবেণিসঙ্গমে ধন্য এই বিখ্যাত নন্দ পরিবার।