- পূর্বা সেনগুপ্ত
জেলা বীরভূম। দ্বারকা নদী তার ক্ষীণস্রোতা প্রবাহ নিয়ে গোলাকারে বেষ্টনী সৃষ্টি করে এগিয়ে চলেছে। সেই গোলাকার বাঁকটির সম্মুখে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরলেই দেখা যাবে আধুনিক যুগে নির্মিত কংক্রিটের তৈরি শ্মশানের চূড়া। সেখানে পোড়া কাঠের দেখা মিললেও নদীর পাড়ে নলখাগড়ার জঙ্গলের মাঝে পড়ে আছে মৃত মানুষের সঙ্গে বাহিত ছিন্ন কন্থা বা বস্ত্রের টুকরো, যেগুলি মনকে বৈরাগ্য আগুনের তাপে রঞ্জিত করবেই করবে। কারণ কেবল শ্মশানের অস্তিত্ব নয়, এই স্থানেই বিরাজ করছেন দেবী দ্বারবাসিনী। যিনি প্রকৃতপক্ষে দুর্গা রূপে বিরাজিতা। দেবীর পুজোর প্রণাম মন্ত্রে দেবীকে জয়দুর্গা রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দেবীর নাম দ্বারবাসিনী কেন? তিনি পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ড দুই রাজ্যের দুয়ার দেশে অবস্থিত বলে? না, তিনি যখন বিরাজিত হয়েছেন তখন এই দুই রাজ্যের বিভাজন হয়নি, তার অস্তিত্বও ছিল না। স্বাধীনতার অনেক আগে, বীরভূম অঞ্চল যখন সামন্ত রাজাদের অধীন- সেই যুগেরও পূর্ব সময়ে এই দেবীটির অস্তিত্বের দেখা পাওয়া যায়। তাহলে কি দ্বারকা নদীর তীরে বলে তিনি দ্বারবাসিনী নামে পরিচিতা? নদী কি দেবী স্বরূপের নির্দেশক হতে পারে? নদী তাঁর গতি অহরহ পরিবর্তন করে। তবে কী কারণে তিনি দ্বারবাসিনী রূপে চিহ্নিত? আমাদের মনে হয় এই দেবী মানবকে ইহজগৎ থেকে অধ্যাত্মজগৎ অভিমুখে নিয়ে যান। তাই তিনি দ্বারবাসিনী। দেবী ইহলোক আর পরলোকের দুয়ারে দণ্ডায়মান তাই তিনি দ্বারবাসিনী।
দেবীর নাম যে কারণেই দ্বারবাসিনী হোক না কেন, দেবী যে ব্যাঘ্রবাহিনী তা পুরোহিতদের স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়েই পরিস্ফুট হয়। তাঁর মন্দির, সেই মন্দিরের চারপাশের বাতাবরণ ক্ষণিকের জন্য আপনাকে থামিয়ে দেবে। মনকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বহুকাল আগের পৃথিবীতে। যখন ঘন জঙ্গলের মধ্যে আরাধিত হতেন দেবী শক্তি, কখনও তিনি ডাকাতদের মাধ্যমে পূজিত হতেন কখনও বা গুপ্ত সাধকের মাধ্যমে আরাধিত হতেন। দেবীর জাগরণ ও অধিষ্ঠান ঠিক কবে হয়েছিল, ঠিক কে প্রথম দ্বারবাসিনী দেবীবন্দনা সম্পন্ন করেছিলেন তা ঠিক জানা যায় না। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি বিরাজ করেছেন বিভিন্ন সামন্ত রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়, কিন্তু একটি বিশেষ পরিবার পুরুষানুক্রমে দেবীর পুজো সম্পন্ন করে চলেছেন। তবুও এই দেবীকে গৃহদেবী বলা যায় কি? হয়তো না, আবার তিনি গৃহদেবীও। কারণ এই দেবীর ইতিহাস এতটাই দীর্ঘ যে তাকে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা যায়। আমরা সেই ইতিহাসের পাতায় উঁকি দেওয়ার আগে মন্দির চত্বরে ভালো করে ঘুরে নেব।
আমরা গড় পঞ্চকোট রাজা কল্যাণ শেখরের প্রতিষ্ঠিত কল্যাণেশ্বরী দেবীর কথা আলোচনা করেছি। দেবী দ্বারবাসিনীর অবস্থান সেই পাহাড়ের পিছনের দিকে। স্থানীয়দের মতে দেবী কল্যাণেশ্বরী, দেবী দ্বারবাসিনী ও দ্বারবাসিনী দেবীর মন্দিরে আসার সময় কিছু দূরে অধিষ্ঠিত পলাশবাসিনী নামে যে দেবীর দেখা পাওয়া যায়। শোনা যায়, এঁরা হলেন তিন বোন। এইরকম বোনের ধারণা আমরা অন্য অনেক স্থানেও দেখতে পাই। এক অঞ্চলের মধ্যে যখন অনেক মৌলিক আকৃতির জাগ্রত দেবীর অধিষ্ঠান দেখা যায় তখন কিন্তু তাঁদের পরস্পরকে বোন বা দিদি বলে চিহ্নিত করা হয়। এই দেবীক্ষেত্রের আলোচনা আমরা এই কারণেই নির্দিষ্ট করলাম।
আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে দেবীদের একটি স্থানে একত্রিত অবস্থানের কারণ কী? উত্তর একটাই, যেখানে শাক্ত তন্ত্র ও বৈষ্ণব তন্ত্রের প্রভাব বেশি সেই অঞ্চলে বিভিন্ন সাধকের সিদ্ধিলাভের স্থানে গড়ে ওঠে বিভিন্ন দেবী মন্দির। আমরা আগের দিন করুণাময়ী দেবীর কথা আলোচনা করেছিলাম। তার সঙ্গেও এই ভগ্নী সম্বন্ধ যুক্ত কয়েকটি দেবীর উল্লেখ করা হয়। দ্বারবাসিনী দেবী পঞ্চপীঠস্থান বীরভূমে অধিষ্ঠিত।
এই রাঢ় অঞ্চল দেবী সাধনার জন্য প্রখ্যাত। পাঁচটি শক্তিপীঠের ধারক হল এই বীরভূম। যা একসময় প্রাচীন বীর রাজাদের অধিকৃত ছিল। তার সঙ্গে তারাপীঠের মতো অতিজাগ্রত সিদ্ধপীঠও আছে। তারাপীঠ থেকে দ্বারবাসিনী প্রায় পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার পথ। শাল, সেগুন, অর্জুন আর মহুয়ার ঘন জঙ্গলের মধ্যে হিংল মৌজায় এই দেবীর স্থান। দ্বারকা নদী হল একটি সীমান্তবর্তী নদী। যে নদীর মাধ্যমে ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের সীমানার বিভাজন সম্ভব হয়েছে। তাই মন্দিরের একদিক নদীর বিস্তৃত চড়া, নির্জন একেবারে। দূর থেকে দেখা যায় পাহাড়ের সারি। মাঝে মাঝে নদীর বালুকাবেলায় শ্মশানযাত্রীরা এসে বসে। তারা এলে কিছুটা মুখরিত হয় এই বনভূমি। তীর্থযাত্রী গুটিকয়েক।
আশ্চর্যের ব্যাপার, বিকেল চারটে বাজতে না বাজতে কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে আসে চারিদিক। দুটো থেকে আড়াইটার মধ্যে পুজো সেরে দর্শনার্থীদের পায়েস ভোগ নিবেদন করে পূজারিরা ফিরে যান। তখন সেখানে কেউ যেতে সাহস পায় না। সেই নির্জনে নাকি দেবী একাকী বিচরণ করেন। চারিদিকে ইলেক্ট্রিসিটি বন্দোবস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে অনেকবার। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি কখনও। দেবীর গর্ভগৃহ অন্ধকার থাকে সেখানেই তিনি প্রস্তর রূপে পূজিত হন।
মন্দির চত্বরে প্রবেশ করেই আশ্চর্য লাগবে। যেন একটা প্রাচীন স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষের উপর নতুন মন্দির দাঁড়িয়ে আছে। মন্দির নতুন হলেও খুব নতুন নয়। তার আকৃতিটি খুব অদ্ভুত। এমন ত্রিকোণাকার মন্দির আগে দেখিনি। শোনা যায়, সেই ত্রিকোণাকার মন্দিরের চূড়া নির্মাণ করার সময় মন্দিরে যে আন্দোলন হয় তাতে মন্দিরের তিন কোণের মধ্যে অগ্নিকোণে প্রতিষ্ঠিত মনসা মূর্তিটি থেকে সিঁদুরের মোটা প্রলেপ যা মুখোশের আকার ধারণ করেছিল তা খুলে আসে। আর সেটা খুলে আসতেই ভিতর থেকে বের হয়ে আসে আসল দেবী মনসার অবয়ব। কালো পাথরে নির্মিত এই মূর্তির অপূর্ব গঠনশৈলী দেখে মনে হয় সেন বা পাল যুগের বা তার থেকেও আরও প্রাচীন। এ মূর্তি সত্যই মনসাদেবীর তো। দেবী জয়দুর্গার তালুকে হঠাৎ মা মনসা এলেন কেন তা কিছুতেই বোধগম্য হল না।
আমরা মন্দিরের গঠনের কথা বলছিলাম, এই ত্রিকোণাকৃতি মন্দির আসলে দেবী যন্ত্র বলে বোধ হয়। মনে হল মন্দিরটিই একটি যন্ত্র, আরাধনার স্থান। আবার এই মন্দিরে গর্ভগৃহে একটি মাঝারি মাপের আসনে দেবী দ্বারবাসিনী বিরাজিত। তাঁর পাশে মহাকাল ভৈরব। বাঁ-পাশে গণেশ আর সরস্বতী। তাহলে লক্ষ্মী আর কার্তিক কোথায় গেলেন? দেবী আসলে এক গোলাকার পাথর। পাশের পাথরের সঙ্গে এমনভাবে সংযুক্ত যে দুটি মিলে একটি যোনিক্ষেত্রের রূপ নিয়েছে। প্রতিটি পাথরে গাঢ় করে লেপা আছে পলাশ রঙের সিঁদুর। গর্ভগৃহ ভালো করে নিরীক্ষণ করলে বোঝা যায় মন্দিরের কোণে প্রতিষ্ঠিত দেবী মনসা রূপে যিনি পূজিত হন তিনিই মূল বিগ্রহ আর এই দেবী মনসার পরিবর্তে কোনও বৌদ্ধদেবী হবেন, যেমন বজ্রতারা। এই দেবী স্থানের ইতিহাস আলোচনা করে বেশ কয়েকটি বিচিত্র ঘটনা ও বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। উঠোনের একদিকে একটি মাথার উপর ঘেরা আসনে বাঘরাই চণ্ডীদেবী।
এমন চণ্ডীরূপের কথা প্রথম শুনলাম। শোনা যায়, দেবীর জন্য বছরে দুটি দিন রাত্রে ভোগ নিবেদিত হয় আর সেই ভোগ একটি লম্বা বাঁশের মতো কংক্রিটের তৈরি খুঁটির মাথায় নিবেদন করা হয়। প্রাচীনকালে সেই নিবেদিত ভোগ বাঘ এসে খেয়ে যেত। এখন কাকপক্ষীর আহার হয়। এই বাঘরাই চণ্ডীর পাশে একটি গাছের নীচে গোলাকার কৃপানাথ ভৈরব। পাশে ত্রিশূল গোঁজা। বলা হয় এই ভৈরব দেবীকে রক্ষা করেন। তার পাশে কাক সমাধি। শোনা যায়, একটি সাদা ও একটি কালো কাক এখানে ছিল তাদের একই দিনে মৃত্যু হয়। তাদের দুজনকে সমাধিস্থ অবস্থায় পুজো কেন করা হয় সেটাই বুঝলাম না। সেই সমাধির কাছে দেবীর পুরোহিতদের নাভি মন্দির। পুরোহিত বংশের যাঁরা মারা যান তাঁদের প্রত্যেকের নাভি চারটি টুকরো করা হয়। আর তার মধ্যে একটি এই মন্দিরে রাখা হয়। সেই নাভি মন্দিরে প্রতিদিন পুরোহিতদের নাভিপুজো গ্রহণ করা। চারভাগে বিভাজন করার অর্থ মূল নাভির চারভাগের একভাগ গ্রহণ করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট মাপ আছে। এই প্রথাটিও খুব আশ্চর্যজনক।
সমস্ত দেবীস্থান জুড়ে সারমেয় বা কুকুরের আধিক্য চোখে পড়ার মতো। দেবী পুজোর ঢাক বাজতে শুরু করলে তারাও চিৎকার করে দেবী বন্দনা শুরু করে দেয়। মন্দিরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে একটি ছোট নদী, যার নাম সন্ন্যাসী কাঁদড়৷ কিংবদন্তি অনুসারে এক সন্ন্যাসী তান্ত্রিক ঘুরতে ঘুরতে এই দ্বারবাসিনী দেবী স্থানে উপস্থিত হন। সেখানে সাধনা করে দেবী মাহাত্ম্য হৃদয়ঙ্গম করেন তিনি। পরিকল্পনা করেন দেবীকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে স্থানত্যাগ করবেন। তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর গোপনে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত কিন্তু দেবীর ভৈরব জানতে পেরে যান। তিনি তান্ত্রিক সন্ন্যাসীকে হত্যা করতে উদ্যত হন। ভীষণ যুদ্ধ হয় দুজনের মধ্যে। ভৈরব তিন তিনবার সন্ন্যাসীর মুণ্ড দেহ থেকে ছিন্ন করে ফেলেন। কিন্তু তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর এত বিভূতি ছিল তিনি অনায়াসে নিজের দেহে নিজের কাটা মুণ্ডটিকে জুড়ে দিতে সমর্থ হন।
মহাকাল তখন আরেকবার মুণ্ডচ্ছেদ করতে সেই কাটা মুণ্ডটিকে কুকুর দিয়ে চাটিয়ে দেন৷ কুকুর মুণ্ড স্পর্শ করার ফলে মুণ্ডটি উচ্ছিষ্ট হয়ে যায় এবং সেই উচ্ছিষ্ট মুণ্ড সন্ন্যাসী নিজ দেহে জুড়তে পারেন না। দেবী কিন্তু সন্ন্যাসীকে একটি বরদান করেন। তিনি বলেন, তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর মুণ্ড নিঃসৃত রক্ত থেকে দহের সৃষ্টি হবে। সেই দহের জল দিয়েই তৈরি হবে মায়ের ভোগ। সন্ন্যাসীর মুণ্ডটি একটি উঁচু স্থানে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় আর তখন থেকে ধারণা করা হয় সন্ন্যাসীর মুণ্ড থেকে নিঃসৃত রক্ত থেকেই দহের সৃষ্টি। এখনও সেই দহের জল বেশ লাল রং ঘেঁষা। আগে নাকি রক্তবর্ণই ছিল। এই মন্দিরের প্রথম পৃষ্ঠপোষক বীরভূমের বীর রাজারা সেই দহের সঙ্গে নদীর সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু এর ফলে মাছের আনাগোনা শুরু হয়৷ তাই সেই প্রচেষ্টা বন্ধ করা হয়। মায়ের মন্দিরের পায়েস ভোগে আমিষ স্পর্শ থাকবে না। সন্ন্যাসী কাঁদড়ের পাশেই সেই তান্ত্রিকের পঞ্চমুণ্ডীর আসন। তবে সন্ন্যাসী কাঁদড়ের জলেও ছোট মাছ আছে কিন্তু ভোগের জন্য জল নিলে তাতে মাছ পাওয়া যায় না। এটাই কাঁদড়ের বিশেষত্ব।
দেবীর ভোগের ব্যাপারে একটা প্রশ্ন আমার মনে দেখা দিয়েছিল। কোনও দেবী স্থানে নিরামিষ ভোগ দেওয়ার প্রথার প্রচলন নেই। এই দেবীস্থানে কিন্তু ভিন্ন যদিও হাড়িকাঠ জানান দেয় বলি সেখানে হত। তবে কেন প্রতিদিনের পুজোর ভোগে নিরামিষ? শ্মশানের মধ্যস্থলে বৈষ্ণবদের সমাধিক্ষেত্র। বীরভূমের ফুল্লরা শক্তিপীঠের চারপাশেও এই সমাধিক্ষেত্র চোখে পড়বে। এই দেবীস্থানেও আমরা বৈষ্ণবদের সমাধি দেখতে পাই। ধর্ম প্রবাহের ইতিহাস অন্বেষণ করলে দেখতে পাই, বৈষ্ণব তন্ত্র আর বৌদ্ধ তন্ত্রের আবার শাক্ত তন্ত্রের ধারা ও বৌদ্ধ তন্ত্রের ধারার মধ্যে যখন মিশ্রণ এসেছিল। সৃষ্টি হয়েছিল নতুনভাবে ভাবিত আরাধনার স্থান। দ্বারবাসিনী দেবী হল মন্দির এমনিই কোনও মিশ্রণের ইতিহাস বহনকারী দেবস্থান। এটাই আমাদের মনে হয়। স্থানটি অত্যন্ত প্রাচীন, মন্দিরের সম্মুখে পড়ে থাকে মাঝারি আকৃতির দুটি পাথর। যে পাথর দুটির আয়তন দেখে অনায়াসে বলা যায়, তাদের তুলে ফেলা মোটেই অসম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে এদের কিছুতেই তোলা যায় না।
কিংবদন্তি অনুযায়ী, এই পাথর দুটি তুলতে দেবী কৃপার প্রয়োজন হয়। দেবী যাঁকে কৃপা করেন তিনিই পাথরটি অনায়াসে তুলে ফেলতে পারেন। মাঘ মাসে বিরাট মেলা বসে এই মন্দির প্রাঙ্গণে। তখন বহু মানুষ এই পাথর দুটি তোলার প্রতিযোগিতায় নামেন। কেউ পারেন, কেউ পারেন না। কী আছে এই দুটি পাথরে? যুক্তিবাদী মন বলে, এ হল আকাশপথ থেকে উড়ে আসা কোনও উল্কার টুকরো। যার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অন্য কিছুর তুলনায় বেশি। অন্য মন বলে তবে বেছে বেছে কি মন্দির প্রাঙ্গণেই তাদের পতন হল? এর মধ্যে নিশ্চিত দেবীকৃপা রয়েছে।
সব কিছু নিয়ে দেবী দ্বারবাসিনীর অস্তিত্ব খুবই চমকপ্রদ। এখানে প্রশ্ন হল এই মন্দিরের আবির্ভাব কবে তা জানা যায় না ঠিকই কিন্তু দেবীপুজোর ইতিহাস কতটুকু আমরা জানি? ইতিহাস বলে এই মন্দির একসময় বীর রাজাদের অধীনে ছিল, তারপর ওডিশার রাজা নরসিংদেবের পৃষ্ঠপোষকতাও লাভ করে। পরে পাঠান রাজত্বে রণমস্ত খাঁয়ের পুত্র আসিউজ্জুমান খাঁ এই মন্দিরের দেখভাল করতেন। তিনি ভাগলপুর থেকে এক তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ তিলকনাথ শর্মাকে এই মন্দিরের পূজারির দায়িত্ব দিয়ে নিয়ে আসেন। এই পরিবারই বংশানুক্রমে আজও দেবী পুজো করে চলেছেন। শোনা যায়, বীরভূম ব্রিটিশ শাসনাধীন হলে হেতমপুরের রাজারা এই অঞ্চলের সামন্ত রাজ হিসেবে দেবী দ্বারবাসিনীর সেবা করে এসেছেন। একবার কোনও রাজা তাঁর নায়েবকে পাঠান, এই মন্দিরে পুজো, আরতি ঠিকভাবে হচ্ছে কি না তা দেখবার জন্য। নায়েব পৌঁছাতে দেরি করে ফেললেন। কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যা নামবে। হঠাৎ দূর থেকে শুনলেন, ঘণ্টা, আরতি আর সুবাসিত ধূপের গন্ধ। তিনি আর অগ্রসর না হয়ে রাজ্যে ফিরে গিয়ে রাজাকে জানালেন, হ্যাঁ, রাতেও মন্দিরে আরতি ধূপ দিয়ে পুজো সম্পন্ন করা হচ্ছে। কিন্তু সেদিন কেউই সেখানে ছিলেন না। কারণ বিকেল চারটের আগেই মন্দিরে তালা দিয়ে মন্দির সংলগ্ন অঞ্চল খালি করে দিতে হয়। আজও এই নিয়ম চলে আসছে সমমান্যতা দিয়েই।
দ্বারবাসিনী দেবী আজ পূজারি পরিবারের গৃহদেবী রূপে পূজিত হয়ে আসছেন। কিন্তু তিনটি গ্রামের মধ্যস্থলে বিরাজিত এই মন্দিরে দেবী দুর্গা বিরাজ করেন বলে সেই তিন গ্রামে কিন্তু কখনোই শারদীয়া দুর্গাপুজো করা যায় না। আজও দ্বারবাসিনী দেবীর জনমনে এতটাই মান্যতা।