Wednesday, January 22, 2025
Homeসম্পাদকীয়উত্তর সম্পাদকীয়রাজধানীর রঙ্গমঞ্চে অস্বস্তিতে কেজরি

রাজধানীর রঙ্গমঞ্চে অস্বস্তিতে কেজরি

দিল্লি বিধানসভার ভোট ঘোষণা হল। সেখানে ইন্ডিয়া জোটে বিশাল ফাটল। মোদি কি আগের সব ব্যর্থতা ঢাকতে পারবেন?

গৌতম হোড়

নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর রাজনৈতিক সাফল্য নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। সেই সাফল্যের তালিকাটাও নেহাত কম বড় নয়। তবে তাঁর রাজনৈতিক ব্যর্থতা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না।

সেই ব্যর্থতার তালিকায় একেবারে ওপরের দিকে থাকবে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের জয়রথ থামাতে না পারা। ২০১৫ সালে দিল্লি বিধানসভার ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৭টি জিতেছিল কেজরিওয়ালের আপ। ২০২০ সালে তারা জেতে ৬২টি আসনে। যে দিল্লিতে বসে মোদি দেশ শাসন করেন, সেখানে তুলনায় এক অর্বাচীন রাজনীতিক বিজেপি-কে পরপর দুইটি নির্বাচনে একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়ে চলে যাবে, এই ব্যর্থতা হজম করাটা নিঃসন্দেহে শক্ত। এই ব্যর্থতা বিজেপির শীর্ষনেতৃত্বকে পীড়া দেবে এটাই স্বাভাবিক।

তবে মোদি এবং অমিত শা’র কাজের বৈশিষ্ট্য হল, তাঁরা কোনও কিছুতেই হার মানতে চান না। ব্যর্থতা কাটিয়ে সাফল্য পাওয়ার জন্য সমানে চেষ্টা করে যান। দিল্লির ক্ষেত্রেও গত দশ বছর ধরে তারা সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দশ বছর পর সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ কেজরিওয়ালকে তাঁরা বেশ কিছুটা কোণঠাসা করে ফেলেছেন। গত দশ বছরের মধ্যে এতটা চাপে থাকতে কেজরিওয়ালকে আগে কখনও দেখা যায়নি।

সেটা স্বাভাবিকও। মদের লাইসেন্স কেলেঙ্কারি নিয়ে জেলে যেতে হয়েছে অরবিন্দ কেজরিওয়াল, মণীশ সিসোদিয়া, সঞ্জয় সিং-কে। আরেকটি মামলায় জেলে গিয়েছেন আপের অন্যতম নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী সত্যেন্দ্র সিং। ফলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াকু বলে আপ নেতার যে ভাবমূর্তি ছিল তাতে ধাক্কা লেগেছে।

রাজনীতি হল ধারণা তৈরির খেলা। ফলে যে ধারণাটা কেজরিওয়াল গড়ে তুলেছিলেন, তা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ভারতীয় মানসিকতায় এরকম ক্ষেত্রে ভোটদাতাদের একটা বড় অংশের প্রথমে মনে হয়, বিরোধী রাজনীতিকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তারপর তিনি দিনের পর দিন যখন জেলে থাকেন, একের পর এক জামিনের আবেদন খারিজ হয়, তখন তাঁদের মনে হয়, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। কেজরিওয়াল আবার দীর্ঘদিন জেলে থেকেও মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়েননি। অনেক পরে গিয়ে ছেড়েছেন। এই সবকিছুর প্রভাব লোকসভা নির্বাচনের ফলে পড়েছে।

তবে এর আগেও লোকসভা নির্বাচনে কেজরিওয়াল কিন্তু মোদির সঙ্গে পেরে ওঠেননি। তার জোরের জায়গা হল বিধানসভা নির্বাচন। এবার সেই চেনা পিচে তিনি আবার খেলতে নামবেন।

তাহলে তাঁর চিন্তাটা কোথায়? চিন্তার কারণ হল, ওই ধারণা তৈরির খেলায় বিজেপি এবার অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে। আর নয়াদিল্লির মধ্যবিত্ত ভোটারদের যে বড় অংশ কেজরিওয়ালকে ভোট দিতেন, তাঁরা আপ নয়, বিজেপির দিকে চলে যেতে পারেন, এমন আশঙ্কা আপের নেতাদের ষোলোআনা রয়েছে। কেজরিওয়াল হিন্দুত্বের পথে চলার জন্য সংখ্যালঘু ভোটও পুরোপুরি কংগ্রেসের দিকে চলে যেতে পারে। এই দুই সম্ভাবনা যদি সত্যি হয়, তাহলে কেজরিওয়ালের পক্ষেও ২০১৫ বা ২০২০ সালের ফলের কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়।

কিন্তু কেজরিওয়ালও তো ২০১৩ সাল থেকে রাজনীতিতে হাত পাকিয়েছেন। কোনও সন্দেহ নেই, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্না হাজারের সঙ্গে থেকে কেজরিওয়াল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। কিন্তু ২০১৫ ও ২০২০ সালের সাফল্যের পিছনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের থেকে ঢের বেশি কাজ করেছে, দিল্লির মানুষকে কিছু পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি।

‘বিজলি হাফ, পানি মাফ’-কে হাতিয়ার করে তিনি ২০১৫-র নির্বাচনে অভূতপূর্ব ফল পেয়েছিলেন। ২০২০ সালে তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল, মেয়েদের বাসে বিনা পয়সায় যাতায়াতের সুবিধা, মহল্লা ক্লিনিক, সরকারি স্কুলের মানোন্নয়ন। অর্থাৎ, একটার পর একটা জনমোহিনী প্রতিশ্রুতি ও আর্থিক সুযোগসুবিধা দেওয়ার সুফল তিনি পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার করে যে সুবিধা পেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে কৃষকদের বছরে ছয় হাজার টাকা দিয়ে যে সুবিধা পেয়েছিলেন মোদি। মধ্যপ্রদেশে, মহারাষ্ট্রে, কর্ণাটকে মেয়েদের প্রতি মাসে টাকা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে যে সুবিধাটা পেয়েছে বিজেপি ও কংগ্রেস, সেই সুবিধাটাই দিল্লিতে আবার পেতে চান কেজরিওয়াল।

দিল্লিতে এবার কেজরিওয়ালের তুরুপের তাস এরকমই একটা প্রতিশ্রুতি। ক্ষমতায় এলে তিনি দিল্লির মেয়েদের ২১০০ টাকা করে প্রতি মাসে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক চমক দিয়ে তিনি আপের তরফ থেকে শিবির খুলে মেয়েদের নাম নথিভুক্ত করার কাজটাও সেরে নিয়েছেন। চিত্তরঞ্জন পার্কের মতো বাঙালিপ্রধান এলাকায় আপের শিবিরে প্রায় বারোশো মেয়ে নাম নথিভুক্ত করেছেন। আয়কর দেন না, এমন প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা এই সুবিধা পাবেন বলে কেজরিওয়াল ঘোষণা করেছেন।

দিল্লি সরকার ঘোষণা করেছে, তারা এরকম কোনও প্রকল্প হাতে নেয়নি, কেউ যেন আধার কার্ডের নম্বর দিয়ে কোনও ফর্ম পূরণ না করেন। কিন্তু তারপরেও লাখ লাখ নারী দিল্লিতে এই ফর্ম ভরে তাঁদের নাম আপের কাছে নথিভুক্ত করিয়ে রেখেছেন। এবার এই টাকাটা হাতে পাওয়ার জন্য তাঁরা যদি কেজরিওয়ালকে ভোট দেন, তাহলে এবারও মোদির লড়াইটা কঠিন হয়ে যাবে। বিজেপি এবার দিল্লির জন্য কোনও মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি। এর আগে তারা দিল্লিতে যতবার এই ঘোষণা করেছে, ততবারই হেরেছে। কিরণ বেদী, বিজয়কুমার মালহোত্রা, সুষমা স্বরাজ কেউই মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হয়ে দলকে জেতাতে পারেননি। তাই এবার বিধানসভাতেও কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে মোদিকে সামনে রেখেই লড়বে বিজেপি।

আসলে নয়াদিল্লির মধ্যে অনেকগুলি নয়াদিল্লি আছে। বিত্তশালী দিল্লি, উচ্চবিত্তদের দিল্লি, মধ্যবিত্তদের দিল্লি ছাড়াও আছে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষের দিল্লি। যাঁরা লুটিয়েন্স সাহেবের তৈরি মধ্য দিল্লিকে দেখেন বা দক্ষিণ দিল্লির বৈভবশালী মানুষের বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি, অসম্ভব দামী গাড়ি, বিলাসী জীবনযাপন দেখেন, তাঁরা ভাবতেও পারেন না, এর পাশাপাশি গরিব মানুষের নয়াদিল্লির চেহারা কতটা হতশ্রী।

একসময় সেখানকার মানুষ ছিলেন কংগ্রেসের মূল শক্তি। এখন তারাই কেজরিওয়ালকে এইভাবে জেতানোর পিছনে আছেন। আপের নেতাদের দাবি, এই বিত্তহীন দিল্লির মানুষ এখনও তাঁদের সঙ্গে আছেন। কারণ, তাঁরা কেজরিওয়ালের কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছেন। এই আর্থিক সুবিধা তাদের জন্য খুবই জরুরি, বিজেপি ক্ষমতায় এলে তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ২০২০ সালে দেখেছিলাম, মধ্যবিত্ত ও কট্টর বিজেপি সমর্থকরাও এই কারণে বিধানসভায় আপকে ভোট দিয়েছিলেন।

প্রশ্ন হল, এবার তাঁরা কী করবেন? লড়াইটা তো শুধু বিজেপির সঙ্গে নয়, কংগ্রেসও ময়দানে আছে। গত দু’বার তারা একটা আসনেও জেতেনি। এবার তাদের কী হবে?

দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনের দিন ঘোষণা হয়েছে মাত্র। ভোটপ্রচার সেভাবে শুরু হয়নি। শুরু হলে হয়তো ছবিটা কিছুটা স্পষ্ট হবে। তবে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে প্রধান প্রশ্নটা হল, ২০১৫ বা ২০২০-র মতোই সব হিসাব বদলে দিতে পারবেন কেজরিওয়াল, নাকি তার আসন কমলেও তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন? অথবা এই প্রথমবার মোদির মনোবাসনা পূর্ণ হবে, দিল্লিতেও আবার বিজেপি ক্ষমতায় আসবে? ২০১৩ সাল থেকে অনেক ম্যাজিক দেখিয়েছেন কেজরিওয়াল।

কোনও সন্দেহ নেই, হাতি এবার কাদায় পড়েছে। তাই বলে তাঁকে সহজেই হারিয়ে দেওয়া যাবে, এমন আশা বিজেপি নেতারাও করছেন না। আর দু’বার শূন্য পাওয়া কংগ্রেস এবার অন্তত খাতা খুলতে চাইছে। সেইসঙ্গে চাইছে, কেজরিওয়ালের যাত্রাভঙ্গ করতে। ফলে আপ তাদের বিজেপির ‘বি টিম’ বলছে। রাজনীতির খেলাও বড় বিচিত্র, কে যে কখন কার বি টিম হয়ে যায়!

এর মধ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অখিলেশ যাদব আপকে সমর্থন জানিয়েছেন। তবে তাঁদের সমর্থনের নৈতিক বল থাকতে পারে, ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে কেজরিওয়ালের খুব একটা সুবিধা হবে না। উত্তরপ্রদেশের মতোই দিল্লিতে বাঙালির সংখ্যাও প্রচুর। কিন্তু তাঁরা মমতা বা অখিলেশের অনুরোধের ভিত্তিতে ভোট দেন না। গত দুইটি বিধানসভায় দিল্লির বাঙালিপ্রধান চিত্তরঞ্জন পার্কে আপ ও বিজেপি প্রায় সমান ভোট পেয়েছিল। লোকসভায় বিজেপি পেয়েছিল ৬০ ভাগ ও আপ ৪০ ভাগ ভোট। ফলে কেজরিওয়ালকে বাঙালিরা ভোট দেন, বিজেপিকেও দেন। এবারেও সেই হিসাব বদলাবে বলে মনে হয় না।

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

নিঃশ্বাসে সমস্যা! দিনহাটা উৎসবের মঞ্চে অসুস্থ মোনালি ঠাকুর, ভর্তি হাসপাতালে

0
দিনহাটা: দিনহাটা উৎসবে গান গাইতে গিয়ে হটাৎই অসুস্থ হয়ে পড়লেন জনপ্রিয় গায়িকা মোনালি ঠাকুর। অনুষ্ঠান চলাকালীন তাঁর নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিল। সেই কারণে স্টেজ...

R G Kar case | আরজি কর-কাণ্ডে বুধবার ‘সুপ্রিম’ শুনানি, উপযুক্ত তদন্ত চেয়ে আবেদন...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ আরজি কর কাণ্ডে সোমবারই দোষী সাব্যস্ত সঞ্জয় রায়কে আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা শুনিয়েছে শিয়ালদা আদালত। নিম্ন আদালতের রায়ের দুদিন পরই আরজি...

SuryaKumar Yadav | ‘ওডিআই ফর্ম্যাটে আমার পারফরম্যান্স ভালো নয়’, অকপট স্বীকারোক্তি সূর্যর    

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে দলে জায়গা হয়নি টিম ইন্ডিয়ায় টি২০ ফর্ম্যাটের অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদবের। এমনকি ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওডিআইতেও দলে রাখা হয়নি সূর্যকে।...

Asfakulla Naiya | প্রমাণ ছাড়াই এফআইআর! আসফাকুল্লার বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে বিচারপতির প্রশ্নে অস্বস্তিতে পুলিশ

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: আরজি কর হাসপাতালের জুনিয়ার চিকিৎসক ও অন্যতম ‘প্রতিবাদী মুখ’ আসফাকুল্লা নাইয়ার (Asfakulla Naiya) বিরুদ্ধে দায়ের করা এফআইআর নিয়ে প্রশ্ন তুলল...

Donald Trump | ‘বেআইনি অভিবাসীদের থাকতে দেব না’, শপথ নিয়েই কঠোর অবস্থান ট্রাম্পের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ৪৭তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট (US President) হিসেবে মসনদে বসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump)। দ্বিতীয়বার দায়িত্ব নেওয়ার পরই একাধিক বিষয়ে চমক দিয়েছেন...

Most Popular