দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। সর্বশেষ নজির, গত ৮ জানুয়ারি দুবাইয়ে ভারতের বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রি ও আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলবি আমির খান মুত্তাকির বৈঠক। গত বছরের অগাস্টে বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতনের পর দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির দৃশ্যপট দ্রুত বদলেছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস ভারতকে যাবতীয় সহায়তা বজায় রাখতে বারবার অনুরোধ জানানোর পাশাপাশি পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকছেন। ওই দেশ থেকে গোলাবারুদ, খাদ্যশস্য আমদানি করা হচ্ছে।
পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহম্মদ ইশাক দারের আসন্ন বাংলাদেশ সফরও যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী। ইউনূস ও পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের বৈঠকে ছিল সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা। ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনর্নির্মাণে ঢাকার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখলেও পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সামরিক সহযোগিতা বাড়ছে। পাকিস্তান থেকে স্বল্পপাল্লার ব্যালেস্টিক মিসাইল, চিনের তৈরি অত্যাধুনিক জেএফ-১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমান ও তুরস্ক থেকে ট্যাংক কিনছে বাংলাদেশ।
গত ১৫ জানুয়ারি ইসলামাবাদে পাক সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের সঙ্গে বাংলাদেশের লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসএম কামরুল হাসানের বৈঠকে অস্ত্র কেনার সিদ্ধান্তের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য হল ফেব্রুয়ারিতে এক পাক মেজর বাংলাদেশের চার সেনানিবাসে প্রশিক্ষণ দিতে আসার খবর। পাকিস্তানের ইন্ধনে বাংলাদেশে মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত ও ভারত-বিরোধিতা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতি চললে ভারত-বাংলাদেশ সামরিক সম্পর্কও ভিন্ন দিকে মোড় নিতে বাধ্য৷
পাকিস্তান সরাসরি বাংলাদেশে ঢুকলে চিন বসে থাকবে না। সেটা হবে আরও উদ্বেগের। ভারত-বিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে প্রশিক্ষণ দিতে নতুন শিবির তৈরি করবে আইএসআই। কাশ্মীরি জঙ্গিদের ভারতে পাঠাতে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে নয়া পথ। এই পরিস্থিতিতে মিস্রি-মুত্তাকির বৈঠক আসলে ইসলামাবাদের উদ্দেশে সতর্কবার্তা৷ বাংলাদেশকে প্ররোচিত করলে ফল কী হতে পারে, ভারত তা বোঝাতে চাইছে।
পাক-আফগান সম্পর্ক এখন সাপে-নেউলে৷ আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে তেহরিক-ই-তালিবান জঙ্গি গোষ্ঠীটি পাকিস্তান ও বালুচিস্তানে আক্রমণের ঝাঁঝ বাড়িয়েছে৷ পাক সেনা পালটা ওই গোষ্ঠীর ডেরায় বিমান হানা চালালে মূলত পাকিস্তানি শরণার্থী প্রায় ৫০ জন মহিলা, শিশু নিহত হয়। ভারতের বিদেশমন্ত্রক এর তীব্র নিন্দা করে বলেছে, ‘অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতায় প্রতিবেশীদের দোষারোপ পাকিস্তানের পুরোনো বদভ্যাস।’ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আফগানিস্তানকে ভারতের সমর্থন এতে সুস্পষ্ট।
আফগানিস্তানে এখন সবচেয়ে ঘৃণিত পাকিস্তান ও ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (আইএসআইএস)৷ আইএসআইএস-কে ইসলামাবাদের সমর্থন আফগানদের নাপসন্দ। ভারত একেই পুঁজি করছে৷ দুবাইয়ের বৈঠকে উন্নয়নমূলক বিবিধ প্রকল্প, সহযোগিতা, চাবাহার বন্দর ব্যবহার ইত্যাদি আলোচনা হয়েছে৷ ভারতে আফগান দূতাবাস বন্ধ৷ যদিও কাবুলে ভারতীয় দূতাবাস খোলা। ভারত এখনও তালিবানদের স্বীকৃতি দেয়নি। যদিও কাবুলে ভারতের উপস্থিতির অর্থ, পাকিস্তানকে আরও বেশি করে আক্রমণ শানানো সম্ভব।
গত বছরের মে মাসে মার্কিন বিদেশ কমিটি এক বিবৃতিতে বলে, ‘২০১২-এর অগাস্টে আফগানিস্তান থেকে বাইডেনের সেনা প্রত্যাহারের পর দেশটি তালিবানদের দখলে যায়৷ সেখানে তৈরি মানবিক সংকট মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি খরচ করেছে।’ তালিবানরা এ কথা অস্বীকার করে বলে, ‘বাস্তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক পয়সাও দেয়নি। বরং, তারা কোটি কোটি ডলার আটকে রেখেছে।’
দ্বিতীয়বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আফগানিস্তানকে সাহায্য বন্ধ করা হবে৷ আফগানিস্তানের সমর্থনে ভারতের এগিয়ে আসার লক্ষ্য অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা নয়। তবে, এটা পাকিস্তানের জন্য বড় সতর্কবার্তা হিসেবে কাজে লাগানো হবে। তারা বাংলাদেশকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলে ভারতও কাবুলকে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে তেহরিক-ই-তালিবান ও বালুচদের কাজে লাগাবে। ফলে, পাকিস্তানের জন্য পরিস্থিতি কঠিন হবে। ভৌগোলিক নৈকট্যের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে সামলাতে, আফগানিস্তানকে সামনে রেখে পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করার ভারতীয় কৌশল এই পদক্ষেপে সুস্পষ্ট।