শুভঙ্কর সাহা, দিনহাটা: মাসদুয়েক আগে ধরলা নদী গিলে খেয়েছিল সামাদ মিয়াঁ, আবুল হোসেনদের বাড়ি। ভিটেমাটি হারিয়ে অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়ে কোনওরকমে দিন গুজরান করছিলেন। নদীভাঙনে তাঁদেরও ভিটেমাটি নদীতে চলে যেতে পারে, এরকম একটা আশঙ্কা ছিল দরিবস গ্রামের ফারুক হোসেন, সবুজ হকদের। সেই আশঙ্কাই যেন সত্যি হল।
শনিবার বিকেল থেকে রবিবার দুপুর পর্যন্ত ১২টি বাড়ি নদীগর্ভে তলিয়ে গেল। ভিটেমাটি হারিয়ে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে বাসিন্দাদের ক্ষোভ চরমে। সবুজ হক বললেন, ‘হয়তো বাঁধ আর দেওয়া হবে না। এভাবে ভাঙতে ভাঙতে একদিন গোটা গ্রামটা নদীগর্ভে চলে যাবে।’
স্থানীয়দের অভিযোগ, ভোট আসে, ভোট যায়। কিন্তু তাঁদের সমস্যার সুরাহা হয় না। নেতারা গ্রামে এসে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। কিন্তু ভোট পেরোলে আর নেতাদের টিকিটাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তারপর আর তাঁদের গ্রামে আসারও প্রয়োজন পড়ে না।
স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য আবুল কালাম আজাদ জানালেন, বিষয়টি কোচবিহারের সাংসদকে জানানো হয়েছে। সাংসদ জগদীশ বর্মা বসুনিয়া বলেন, ‘ওই এলাকায় অনেকটা নদীভাঙন রয়েছে। বাঁধ নির্মাণে অনেক টাকার দরকার। সেচ দপ্তর ব্রহ্মপুত্র বোর্ডে বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে কিছু করা যায় কি না দেখছি।’
গিতালদহ-২ গ্রাম পঞ্চায়েতে রয়েছে জারিধরলা এবং দরিবস গ্রাম দুটি। ওই দুই গ্রামের বাসিন্দার সংখ্যা সাত হাজারেরও বেশি। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে গ্রাম দুটিকে বিচ্ছিন্ন করেছে ধরলা নদী। বাজার কিংবা স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার জন্য বাসিন্দাদের নদী পেরোতেই হয়। স্থানীয়দের সবচেয়ে বড় সমস্যা নদীভাঙন। ইতিমধ্যে বিঘার পর বিঘা চাষের জমি, বাড়িঘর নদীর গ্রাসে চলে গিয়েছে।
ফি বছর অন্তত ৩০-৪০টি করে বাড়ি নদীগর্ভে চলে যায় বলে স্থানীয়দের ক্ষোভ। ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব বাসিন্দারা কখনও আত্মীয়ের বাড়িতে, আবার কখনও অন্যের জমিতে আশ্রয় নেন। কেউ কেউ আবার পরিবার-পরিজন নিয়ে ভিনরাজ্যে কাজের সন্ধানে চলে যান। কিন্তু নদীভাঙন রোধে প্রশাসন কোনও ভূমিকা নেয় না বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ। রবিবার সকালে ধরলা নদীতে বাড়ি তলিয়ে গিয়েছে ফারুখ হক, হাসেন আলিদের। ফারুকের কথায়, ‘আমাদের আর কী করার আছে? ভিটেমাটি নদীতে চলে গেল। বাড়ি রাস্তার ওপারে নিয়ে গেলাম। জানি না, এভাবে কতদিন থাকতে হবে।’
এর আগে সেচ দপ্তরের আধিকারিকরা দরিবস গ্রামে গেলে এক বৃদ্ধ সেচ দপ্তরের আধিকারিকের পায়ে ধরে বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান। তারপর গত জুলাই মাসে পুলিশ এবং শাসকদলের নেতারা দরিবস গ্রামে গেলে বাসিন্দারা ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখান। নেতা এবং পুলিশ আধিকারিকদের পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়, বাঁধ নির্মাণ না হলে তাঁরা যেন গ্রামে না ঢোকেন। বারবার শুধু মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কোনও মানে হয় না।
এরপরই নড়েচড়ে বসে সেচ দপ্তর। এস্টিমেট করে কেন্দ্রের ব্রহ্মপুত্র বোর্ডের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র বোর্ডের তরফে এখনও কিছু জানানো হয়নি। এরই মধ্যে পুজোর আগে নতুন করে নদীভাঙন শুরু হয়। নদীর তীরবর্তী এলাকায় বাকি যাঁরা রয়েছেন তাঁরা তাঁদের বাড়িঘর অন্যত্র সরাতে শুরু করেছেন।