শুভঙ্কর চক্রবর্তী, ভেটাগুড়ি: ধানখেতের পাশে টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটি বাড়ি। ভেতরে দুটো চালাঘর। আর পাঁচটা গ্রাম্য বাড়ির মতন আপাতসাধারণ ওই বাড়ির ভেতরেই গোপনে তৈরি হচ্ছিল বিশাল বাংকার। গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, রাত হলেই বাড়িতে আনাগোনা শুরু হত বহিরাগতদের। যাতায়াত করত নানা ধরনের গাড়ি। দিনহাটার (Dinhata) ভেটাগুড়ির সিঙ্গিজানি গ্রামের রহস্যময় ওই বাড়িটিই আপাতত পুলিশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মঙ্গলবার বাড়িটিতে অভিযান চালায় পুলিশ। গ্রামবাসী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দাবি, অভিযানের সময় বাড়ি থেকে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। তারপর থেকে আরও জটিল হয়েছে রহস্য। ওই বাড়িতে ঘাঁটি গেড়ে কি পাচারচক্রের কারবার চলছিল, নাকি করা হচ্ছিল নাশকতার ছক? অভিযানের চারদিন পরও তা খোলসা করছেন না পুলিশের কর্তারা।
ওই বিষয়ে কোনও কথাই বলতে রাজি নন দিনহাটার এসডিপিও ধীমান মিত্র। সব শুনে তাঁর উত্তর, ‘এ বিষয়ে কিছু জানি না’। কোচবিহারের পুলিশ সুপার দ্যুতিমান ভট্টাচার্যকে ফোন করা হলে তিনিও ‘ব্যস্ত আছি, পরে কথা বলব’ বলে ফোন কেটে দেন। পুলিশি অভিযানের পর থেকেই গোটা বাড়িটি ভাঙচুর হওয়া অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কারা বাড়িটিতে ভাঙচুর চালাল তা-ও স্পষ্ট নয়।
রহস্যময় বাড়িটি ভেটাগুড়ি পুলিশ (Bhetaguri Police) ক্যাম্প থেকে ঢিল ছোড়া দুরত্বে অবস্থিত। পুলিশের নাকের ডগাতেই ডেরা বেঁধে বড় ছক কষা হলেও কেন কিছু টের পাওয়া গেল না তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। ভেটাগুড়ি-২ গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান প্রিয়াংকা সরকার দে’র কথা, ‘পুলিশ বাড়িটিতে অভিযান চালানোর পর অনেক কিছুই জানতে পেরেছি। বাড়িটিতে বিশাল বাংকার তৈরি করা হচ্ছিল। এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে জেনেছি বাইরের লোকজনও বাড়িটিতে আসত।’ প্রিয়াংকার স্বামী তৃণমূল নেতা গৌতম দে বলেন, ‘পুলিশ তল্লাশির সময় আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে বলেই শুনেছি। ভেতরে ভেতরে বড় কোনও পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে পারত। আমরা নজরদারি চালাচ্ছি।’
গ্রাম পঞ্চায়েত ও পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, রহস্যময় বাড়িটি মাস ছয়েক আগে তৈরি হয়েছিল। হোসেন আলি, তার দুই ছেলে হাসান, ওসমান এবং পরিবারের আরও দু’-তিনজন সদস্য সেখানে থাকতেন। কোচবিহারের ঘুঘুমারি এলাকাতেও হোসেনদের একটি বাড়ি ছিল। চলতি মাসের শুরুর দিকে গাঁজা পাচার করতে পুণ্ডিবাড়ি থানার পুলিশের হাতে গিয়ে ধরা পড়ে ওসমান। সে খবর জানাজানি হতে এলাকায় শোরগোল পড়েছিল। স্থানীয় এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার দুপুর দুটো নাগাদ বিশাল পুলিশবাহিনী বাড়িটি ঘিরে ফেলে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক তাঁরা অভিযান চালায়। বাড়ির এক সদস্যকেও আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ।
সিঙ্গিজানির পঞ্চায়েত সদস্য মৌমিতা বর্মনের কথায়, ‘তৈরির কিছুদিন পর থেকেই বাড়িটি সম্পর্কে নানা রসহ্যজনক তথ্য জানা যাচ্ছিল। বাড়ির ভেতরে গাড়ি মেরামতির কাজ হত। নানা ধরনের গাড়ি রাতে বাড়িটি থেকে বের হত। সম্প্রতি বাড়িটির চারদিকে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছিল। গ্রামের বাড়িতে সিসি ক্যামেরা দেখে প্রতিবেশীরাও অবাক হয়েছিলেন। পুলিশ অভিযানের পর জানলাম মাস দুয়েক ধরে বেশ কিছু বাইরের শ্রমিক বাংকার তৈরির কাজ করছিল।’
সূত্রের খবর, দিনহাটা ও সাহেবগঞ্জ থানার পুলিশের যৌথ দল ভেটাগুড়িতে অভিযান চালায়। ঘটনাস্থল থেকে একটি পুরোনো গাড়িও পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছে। রহস্যময় ওই বাড়িতে মালদা, মুর্শিদাবাদ, কিশনগঞ্জ সহ বিভিন্ন এলাকার মানুষের যাতায়াতের হদিস পেয়েছে পুলিশ। ঘটনার পর থেকেই রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দাদের বিশেষ দল এলাকায় নিয়মিত নজরদারি চালাচ্ছে। রহস্যময় বাড়ি থেকে বেআইনি কারবারে বাংলাদেশ-যোগের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না গোয়েন্দারা। পুলিশি অভিযানের পর থেকে আতঙ্কে রয়েছেন এলাকার বাসিন্দারাও। দু’দিন আগেই শিলিগুড়িতে প্রশাসনিক সভায় নাশকতা রুখতে বাড়তি নজরদারির নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই তিন দিকে সীমান্ত ঘেরা দিনহাটা মহকুমার ভেটাগুড়ির রহস্যবাড়িতে বাংকার উদ্বেগ বাড়াচ্ছে সাধারণের মধ্যে।
তথ্য সহায়তায়- অমৃতা দে