মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি বিশ্বজুড়ে শেয়ার বাজারে ধস নামিয়েছে। ট্রাম্পের চড়া হারে শুল্কে অধিকাংশ রাষ্ট্রনেতাই তাঁর ওপর যথেষ্ট বিরক্ত। আন্তর্জাতিক মহলে যখন ট্রাম্প-বিরোধী মনোভাব স্পষ্ট, তখন স্বদেশেও তিনি খুব স্বস্তিতে নেই। প্রথমত, বিতর্কের কেন্দ্রে ট্রাম্পের পরামর্শদাতা, ধনকুবের এলন মাস্ক। বৈদ্যুতিক গাড়ি সংস্থা টেসলার কর্ণধার, মহাকাশ প্রযুক্তি সংস্থা স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স (পূর্বতন টুইটার)-এর কর্ণধার তিনিই।
মহাকাশে আট মাস আটকে পড়া সুনীতা উইলিয়ামস এবং বুচ উইলমোর স্পেসএক্সেরই তৈরি মহাকাশযানে চেপে ক’দিন আগে পৃথিবীতে ফিরে এলেন। উৎকণ্ঠার অবসানে দেশে দেশে তখন মাস্কের নামে জয়ধ্বনি শোনা গিয়েছিল। তাহলে মাস্ককে ঘিরে বিতর্কটা কীসের? আসলে তিনিই তো এখন ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি’র (ডিওজিই) মন্ত্রী। লক্ষাধিক সরকারি কর্মীকে ছাঁটাই করেছেন মাস্ক। সরকারের বিশাল অঙ্কের খরচ বাঁচিয়েছেন।
কিন্তু মাস্কের এই গণছাঁটাই মার্কিন জনগণ ভালো চোখে নেননি। মাস্কের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে টেসলার শোরুম ও গাড়ির ওপর হামলায়। আমেরিকার ৫০টি অঙ্গরাজ্যে টেসলার শোরুম, গাড়ি ভাঙচুর, টেসলা কর্মীদের বিক্ষোভ প্রতিদিনকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। শুধু আমেরিকায় নয়, আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা দেশে টেসলা কর্মীদের মধ্যে। আন্দোলনের নামকরণ হয়েছে ‘টেসলা টেকডাউন’।
দুনিয়া জুড়ে টেসলা’র শোরুমের সামনে কর্মীদের বিক্ষোভ আপাতত পরিচিত দৃশ্য। গাড়ির পর গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে আমেরিকা এবং জার্মানিতে। ট্রাম্প ও মাস্কের বিরুদ্ধে একদিনে দেশের সব অঙ্গরাজ্যে ১৭০০ বিক্ষোভ কর্মসূচি হয়েছে। টেসলা’র গাড়ির বিক্রি ব্যাপক হারে কমেছে। ২০০৪ সালে সর্বাধিক শেয়ার নিয়ে টেসলায় যোগ দিয়েছিলেন মাস্ক। হয়ে ওঠেন বিশ্বের ধনীতমদের একজন।
ধীরে ধীরে কট্টর ট্রাম্পভক্ত থেকে হলেন তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ। গত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের পক্ষে প্রচারে কোটি কোটি ডলার ঢেলেছিলেন মাস্ক। টেসলা কর্মীরা এখন মাস্কের মন্ত্রিত্ব ত্যাগের দাবি তুলেছেন। মাস্ক মুখ খোলেননি বটে, তবে তিনি ইস্তফা দেবেন বলে জল্পনা শোনা যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, গণছাঁটাই নিয়ে এই বিক্ষোভ-আন্দোলনের পাশাপাশি বাকস্বাধীনতা খর্ব করার অভিযোগেও ক্ষোভ বাড়ছে মার্কিন মুলুকে। শুধুমাত্র প্যালেস্তিনীয় আন্দোলনকে সমর্থনের অভিযোগে বহু বিদেশি পড়ুয়াকে নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। যা মার্কিন সংবিধান এবং গণতন্ত্রের পরিপন্থী। অবৈধ অভিবাসীদের হাতকড়া এবং পায়ে শিকল বেঁধে সামরিক বিমানে নিজের নিজের দেশে ফেরত পাঠানো নিয়ে শোরগোল কম হয়নি। যদিও সেটাই মার্কিন আইন বলে সরকারি স্তরে দাবি করা হচ্ছিল।
সমালোচনার মূল অভিমুখ আসলে ফেরত পাঠানোর ধরন নিয়ে। অবৈধ অভিবাসীদের নিজের দেশে ফেরত পাঠানোর মধ্যে বেআইনি কিছু নেই। ভারতও পাঠায়। কিন্তু আমেরিকায় যা ঘটছে, তা সম্পূর্ণ বেআইনি। বিদেশি পড়ুয়া ইজরায়েল বিরোধী বলে খবর পাওয়া মাত্র তাঁকে নিজের দেশে ফিরতে বলা হচ্ছে। তালিকায় ভারত, কানাডা সহ বেশ কয়েকটি দেশের পড়ুয়ারা আছেন।
বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সমাজমাধ্যমে গাজার আন্দোলন সংক্রান্ত কোনও পোস্ট শেয়ার করলেই ট্রাম্প প্রশাসনের বিরাগভাজন হতে হচ্ছে অনেককে। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিতর্ক পিছু নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের। অবৈধ অভিবাসন, মার্কিন নাগরিকত্ব, গণছাঁটাই, নিরীহ পড়ুয়াকে জেহাদি বানিয়ে দেশে ফেরানো ইত্যাদি একের পর এক নানা বিষয়।
তৃতীয়ত, তাল মিলিয়ে রিপাবলিকান দলের জনপ্রিয়তা কমছে কোনও কোনও অঙ্গরাজ্যে। উইসকনসিনের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পদের সাম্প্রতিক নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটপন্থী প্রার্থীর কাছে বিপুল ব্যবধানে রিপাবলিকানপন্থী প্রার্থীর হার তার প্রমাণ। এই নির্বাচন জিততেও রিপাবলিকান দলের প্রচারে মাস্ক বিপুল অর্থ ঢেলেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর রিপাবলিকান পার্টির বিজয়রথ ধাক্কা খেল এই প্রথম।