শুভজিৎ দত্ত, নাগরাকাটা: ওটিটি প্লাটফর্মে মুক্তি পাওয়া ওয়েব সিরিজ ‘তালি’ দেখে ফেলেছেন অনেকেই। দেশের শীর্ষ আদালতে আবেদন করে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকার আদায়ের অন্যতম কারিগর গৌরী সাওয়ান্ত এর ওই বায়োপিক সাড়াও ফেলেছে যথেষ্ট। গণেশ থেকে গৌরীতে উত্তরণের পথে তাঁর ঘাত প্রতিঘাত ভরা জীবন কাহিনী নিখুঁত অভিনয়ে ওই ওয়েব সিরিজে ফুটিয়ে তুলেছিলেন প্রাক্তন বিশ্ব সুন্দরী সুস্মিতা সেন। বলিউডের ত্রিসীমানায় থাকা তো দূরের কথা। জলপাইগুড়ির অরবিন্দ মাধ্যমিক (উচ্চতর) বিদ্যালয়ের লক্ষ্মী রায়, মুন দে কিংবা বিশ্বজিৎ রায়, ইমন দাস ও বিশ্বরূপ রাজবংশীদের মত ছাত্রছাত্রীদের গৌরীর মত মানুষের জীবন যন্ত্রণার কথা আগে সেই অর্থে জানাই ছিল না। একেবারে প্রান্তিক স্তর থেকে উঠে আসা সেই ৫ পড়ুয়াই এবারের রাজ্য কলা উৎসবে মঞ্চস্থ করতে চলেছে তৃতীয় লিঙ্গের (Third Gender) মানুষকে নিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের নাটক (Drama)। নাম ‘অন্য রঙ এর ফুল’। মাত্র ৮ মিনিটের সংক্ষিপ্ত নাটকের মূল কথাই হল তৃতীয় লিঙ্গ আদৌ কোনও অভিশাপ নয়। তাঁদের কেউ অচ্ছুতও হতে পারে না। এমন মানুষদের হয়ে বাস্তব সমানাধিকারের কথা তুলে ধরে ওই নাটকের থিম- আর বাজবে না তালি। যেদিন মিলবে কাজ।
আগামী ১৪ নভেম্বর প্রতিযোগিতামূলক ওই আসরে সল্টলেকের ইস্টার্ন জোনাল কালচারাল সেন্টারে নবম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের নাটকটি অনুষ্ঠিত হবে। এতে অংশ নিতে বুধবার ওরা কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত দিনভর রিহার্সালে মেতে ছিল প্রত্যেকে। প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার মিলবে কিনা সেই প্রশ্ন এখন গৌণ। কিন্নর, রূপান্তরকামী ও তৃতীয় লিঙ্গ সহ শিক্ষা মহলের প্রত্যেকে এমন একটি বিষয়কে বেছে নেওয়ার জন্য কুর্নিশ জানাচ্ছে সমগ্র শিক্ষা মিশনের জলপাইগুড়ি শাখা ও স্কুল কর্তৃপক্ষকে। এই নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখেছেন জলপাইগুড়ির দুই শিক্ষক তমোজিৎ রায় ও সব্যসাচী দত্ত। নির্দেশনায় রয়েছেন সব্যসাচী নিজেই। একেবারে আনকোরা ছাত্রছাত্রীদের একাজে এগিয়ে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে মূল কান্ডারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ক্ষৌণিশ গুহ, সহ শিক্ষিকা শাশ্বতী গুপ্তভায়া ও সমগ্র শিক্ষা মিশনের কোঅর্ডিনেটর রাজা দত্ত। টানা কয়েকদিন ধরে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সঙ্গে থেকে নাটকের কুশলীরা যাতে তাদের মনস্তত্ব, আদবকায়দা, চালচলন বুঝতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হয়। এরপর শুরু হয় মহড়া। নানা ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়ে এখন মাত্র ৮ মিনিটই ওই নাটক মুখরিত হয়ে কয়েকশো মিনিটের কথা বলে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত তা নিয়ে সংশয় নেই কারোরই।
নির্দেশক সব্যসাচী বলছেন, ‘পৃথিবীটা সবার। লিঙ্গবৈষম্য এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে কখনোই কোনও অন্তরায় হতে পারে না। সেটাই ফুটে উঠবে অন্য রঙের ফুলে।’ অরবিন্দ মাধ্যমিক (উচ্চতর) বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কথায়, ‘এই লড়াইয়ে গৌরীদের শরিক হওয়ার জন্যেই এমন ছোট একটি প্রচেষ্টা।’ পেডাগোজি কো-অর্ডিনেটার রাজা দত্ত বলেন, ‘তৃতীয় লিঙ্গদের নিয়ে কোর্টের পরিষ্কার নির্দেশ থাকলেও সরকারি অধিকার প্রাপ্তি ও বাস্তবের ছবির আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। অরবিন্দ মাধ্যমিকের পড়ুয়ারা যে বার্তা দিতে চলেছে তাতে ভাবনার পরিবর্তনের ডাক প্রতিটি সংলাপের ছত্রে ছত্রে।’
শহরের রূপান্তরকামী বিশিষ্ট সমাজকর্মী সৌগত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘এভাবেই তো একটু করে এগোনোর পর দিন বদলের প্রত্যাশা জাগে। প্রতিযোগিতায় ছেলেমেয়েরা কী হল, তা বড় কথা নয়।’ জলপাইগুড়ি আস্থা বৃহন্নলা ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সম্পাদক পিপাসা হিজড়া বলেন, ‘সুদিন কখনও ফিরবে কিনা জানা নেই। তবে আমাদের কথা বলার জন্যে কেউ এগিয়ে এসেছে এটা ভাবলেই গর্ববোধ হচ্ছে।’